রচনা লিখঃ ইসলামে ভ্রাতৃত্ববোধ 

অথবা, ভ্রাতৃত্ব অথবা, বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব

উপস্থাপনাঃ সাম্য, মৈত্রী, ভ্রাতৃত্ব ও মানবতার ধর্ম ইসলাম। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ইসলাম স্বীকার করে না। ইসলামের মূল লক্ষ্য হলো অন্যকে সৌহার্দ্যের বন্ধনে আবদ্ধ করে সমাজে অনাবিল শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। তাই জনৈক দার্শনিক ইসলামের এ ভ্রাতৃত্বকে চমৎকারভাবে বর্ণনা করেছেন—

“No distance breaks the tie of Blood

Brothers and brothers evermore.”

ভ্রাতৃত্বের পরিচয়ঃ মানবতাবোধের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ভ্রাতৃত্ব। পারিভাষিক অর্থে পরস্পরের সহমর্মিতা ও সুখ-দুঃখের সমভাগী হওয়াকে ভ্রাতৃত্ব বলা হয়। ইসলাম এ ভ্রাতৃত্ব রক্ষার জন্য উৎসাহিত করেছে।

ভ্রাতৃত্বের রূপরেখাঃ ভ্রাতৃত্ব প্রধানত দুই প্রকার। যথা-

ক. ঔরসজাত ভ্রাতৃত্বঃ ঔরসজাত দু’ভায়ের মাঝে যে সম্প্রীতি গড়ে ওঠে তাকে ঔরসজাত ভ্রাতৃত্ব বলে।

খ. আদর্শিক ভ্রাতৃত্বঃ যখন মানুষ সত্যকে আঁকড়ে ধরার জন্য এক আদর্শের অনুসারী হয় তাই আদর্শিক ভ্রাতৃত্ব।

ইসলামে ভ্রাতৃত্ববোধের ধারণাঃ ইসলামে ভ্রাতৃত্ববোধ বা ভ্রাতৃত্ববন্ধন ‘ঝানোর জন্য আরবি উখওয়াত শব্দ ব্যবহার হয়েছে। এ শব্দটি ইখওয়াতুন মূল থেকে ৎপন্ন। ইসলামের পরিভাষায় মুসলমানদের মধ্যে পারস্পরিক সহমর্মিতা, সুখ-দুঃখের মভাগী হওয়াকে ভ্রাতৃত্ববন্ধন বা উখওয়াত বলা হয়। মহাগ্রন্থ আল কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে, “নিশ্চয়ই মুমিনগণ পরস্পর ভাই ভাই; সুতরাং তোমরা ভ্রাতৃত্বের ভিত্তিতে পরস্পরের মাঝে সংশোধন কর।”

ঐক্য গঠনে ভ্রাতৃত্বঃ ইসলামী ভ্রাতৃত্ব পরস্পরের মাঝে সম্প্রীতি স্থাপন করে। এই মানসিকতার ভিত্তিতে মানুষের মাঝে ঐক্য গড়ে তোলে। মহানবী (স) আরবের সেই শতধাবিভক্ত ও কলহে লিপ্ত জাতিকে একই কালেমার সোনালি সূত্রে গ্রথিত করে একটি ঐক্যবদ্ধ উম্মাহ হিসেবে সংগঠিত করেছিলেন।

ইসলামী ভ্রাতৃত্ব ঈমানের অনিবার্য দাবিঃ পরস্পরের মাঝে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন ঈমানের অনিবার্য দাবি। এর তাৎপর্য এত গুরুত্বপূর্ণ যে, পারস্পরিক সম্পর্কচ্ছেদের ব্যাপারে ইসলাম কঠোর সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছে।

ইসলাম প্রসারে ভ্রাতৃত্বঃ বিশ্বব্যাপী ইসলামের প্রচার প্রসারের ক্ষেত্রে ইসলামী ভ্রাতৃত্ব এক তাৎপর্যপূর্ণ দিক।

সমাজে শান্তি শৃঙ্খলা সৃষ্টিঃ ইসলামী ভ্রাতৃত্ব সমাজে এক অনুপম শান্তি শৃঙ্খলা আনয়ন করে। যে সমাজের মানুষ একতার ভিত্তিতে পরস্পর সহমর্মিতার নিরিখে কাজ করবে, সে সমাজে শান্তির ফল্গুধারা সৃষ্টি হবেই।

স্বার্থপরতার মূলোৎপাটনঃ ইসলামী ভ্রাতৃত্ব স্বার্থপরতার মূলোৎপাটন করে ন্যায় ও সাম্যের সমাজ গঠন করে। ইসলামে স্বার্থপরতার স্থান নেই। তাই ইসলাম নিঃস্বার্থভাবে ভ্রাতৃত্বের ভিত্তিতে আত্মত্যাগের মহান দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে অনুপ্রাণিত করেছে।

পারস্পরিক কল্যাণ কামনাঃ ইসলামী ভ্রাতৃত্বের অনুসারীদের পরস্পরের মান সম্মানের নিরাপত্তা বিধান, দুঃখ কষ্টে অংশগ্রহণ, গঠনমূলক সমালোচনা ও উপদেশ নসীহত, অসুস্থ ভাইয়ের সেবা, সালাম, সাক্ষাৎ, মুসাফাহা, উপঢৌকন ইত্যাদি ব্যাপারে পরস্পরের জন্য প্রার্থনা ও কল্যাণ কামনা.একান্ত কর্তব্য।

অপরকে সাহায্য করাঃ ভ্রাতৃত্বের বন্ধন দৃঢ় করার জন্য ইসলাম অপরের সুখ-দুঃখে এগিয়ে আসার জন্য উৎসাহিত করে। অন্যের বিপদ-আপদে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে বলেছে।

মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকাঃ ইসলামী ভ্রাতৃত্বের অনুসারী ব্যক্তিরা অনধিকার হস্তক্ষেপ, অন্যায় রক্তপাত, কটু ভাষা, গালাগাল, গীবত, চোগলখুরী, অপরের ক্ষতি সাধন, অন্যকে কষ্ট দেয়া, হিংসা, বিদ্বেষ প্রভৃতি মন্দ কাজ হতে বিরত থাকে।

ইহলৌকিক ও পারলৌকিক কল্যাণঃ ইসলামী ভ্রাতৃত্ব ইহলৌকিক কল্যাণ ও পারলৌকিক মুক্তির সহায়ক। মানুষকে ভালোবাসলে আল্লাহকে ভালোবাসা হয়৷ আর আল্লাহকে ভালোবাস র মাধ্যমে ইহকালে শান্তি ও পরকালে মুক্তি নিশ্চিত হয়।

সম্প্রীতি স্থাপনঃ সহোদর ভাইয়ের মধ্যে যেমন সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি বিরাজ করে, তেমনি ইসলামী ভ্রাতৃত্ব তুচ্ছ পার্থিব স্বার্থ ও পরস্পরের হিংসা হানাহানি পরিহার করে মানুষের মাঝে শান্তি আনয়ন করে। ফলে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়।

বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের চেতনাঃ ইসলামই প্রথম বিশ্বভ্রাতৃত্বের ধারণা দিয়েছে। এক বিশাল জনগোষ্ঠীকে নিয়ে বিশ্বভিত্তিক ভ্রাতৃত্বের সমাজ বাস্তবে প্রতিষ্ঠা করে দেখিয়েছে ইসলাম। ভ্রাতৃত্বের এ স্থূল্যবোধ পৃথিবীর অন্য কোনো ধর্মে খুঁজে পাওয়া যায় না। আল্লামা ইকবাল বলেন-

ভ্রাতৃত্বের বিশ্বব্যাপকতা প্ৰেম প্ৰাচুৰ্য

এই হল মুসলমানের মূল তত্ত্ব; 

রক্ত ও বর্ণ বিচূর্ণ কর

আত্মবিলোপ কর মুসলিম মিল্লাতের মাঝে,

তোমার পরিচয় হবে না তুরানী, ইরানী আফগানী বলে।

উপসংহারঃ মানবতার সেবায় নিয়োজিত মানুষই ভ্রাতৃত্বের অভিব্যক্তি ও পূর্ণ বিকাশের সহায়ক। ভ্রাতৃত্বের অভাবে আজ বিশ্বে অশান্তির দাবানল জ্বলছে। সুতরাং এক অখণ্ড ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পৃথিবীকে নতুন করে গড়তে হবে। তাহলেই পৃথিবীর বুকে শান্তি ফিরে আসবে।