মূল কথা: যৌথ ব্যবস্থামূলক সমাজতন্ত্রবাদ বা গোষ্ঠী-সমাজতন্ত্রবাদের উদ্দেশ্য হল এক বিশেষ সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলা। এই সমাজব্যবস্থা গঠিত হবে যুক্তরাষ্ট্রীয় ধরনের স্ব-শাসিত শিল্প সংস্থাসমূহকে নিয়ে। গোষ্ঠী-সমাজতন্ত্র হল সমাজতন্ত্রবাদের আর একটি ধরন। এই ধরনের সমাজতন্ত্রের মূল শক্তি হল। শ্রমিকসংঘ বা সিন্ডিকেট (Syndicate)। এই শ্রেণীর সমাজতন্ত্রীদের অভিমত অনুসারে সমাজের মূল শক্তি নিহিত আছে আর্থনীতিক ব্যবস্থার মধ্যে। তাঁরা পুঁজির বিরোধিতা করেছেন। পুঁজিকে তাঁরা চৌর্যবৃত্তির ফলশ্রুতি হিসাবে দেখেছেন। পুঁজির বিরুদ্ধে সংগ্রামের উপায় হিসাবে তাঁরা শ্রমিক আন্দোলন ও সাধারণ ধর্মঘটের উপর জোর দিয়েছেন। গোষ্ঠী-সমাজতন্ত্রবাদীরা গণতন্ত্র ও রাষ্ট্রের বিরোধিতা করেছেন। এঁদের মতানুসারে কিছু ব্যক্তি গণতন্ত্রের নামে ক্ষমতা কায়েম করে। জনসাধারণের সরকার হল আসলে একটি অবাস্তব ধারণা বিশেষ। রাষ্ট্রের বিরোধিতা করে তাঁরা বলেছেন রাষ্ট্র মানুষকে শ্রমজীবীদের প্রতি সহানুভূতিশূন্য ও আমলাতান্ত্রিক প্রকৃতিযুক্ত করে। গোষ্ঠী-সমাজতন্ত্রীরা কল্যাণকামী রাষ্ট্রকেও প্রগতির পরিপন্থী বলে প্রতিপন্ন করেন। এঁরা ঐতিহাসিক বস্তুবাদ, সামাজিক বিপ্লব এবং মার্কসবাদের দর্শনের বিভিন্ন মৌলিক দর্শনের বিরোধিতা করেছেন।

শঙ্কর প্রকৃতির সমাজতন্ত্র: গোষ্ঠীসমাজতন্ত্রবাদ হল এক সঙ্কর প্রজাতির সমাজতন্ত্র। মার্কসের সমাজতন্ত্রবাদ এবং প্রুধোঁর নৈরাজ্যবাদের সমন্বয়ে গোষ্ঠী-সমাজতন্ত্রবাদের সৃষ্টি। মার্কসবাদ থেকেই গোষ্ঠী সমাজতন্ত্রবাদের সূচনা হয়েছে। এই কারণে একে সমাজতন্ত্রবাদেরই একটি প্রকার বা রূপ হিসাবে গণ্য করা হয়। সমাজতন্ত্রের এই প্রকারটির পরিণতি ঘটে নৈরাজ্যবাদের মধ্যে। এই কারণে এই সমাজতন্ত্রবাদকে ‘নৈরাজ্যমূলক গোষ্ঠী সমাজতন্ত্রবাদ’ (anarcho-syndicalism) বা ‘সংগঠিত নৈরাজ্যবাদ’ (organised anarchy) নামেও আখ্যায়িত করা হয়। গোষ্ঠী-সমাজতন্ত্রীরা মার্কসবাদ থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছেন। এই কারণে তাঁরা বলেছেন যে, মূল্যের (value) প্রকৃত উৎপাদক হল শ্রমিকরা। সুতরাং শ্রমিকরাই হবে সমগ্র উৎপাদনের মালিক। আবার পরবর্তী কালে নৈরাজ্যবাদের থেকে অনুপ্রেরণা পেয়ে তাঁরা বলেছেন যে ভবিষ্যতের সমাজব্যবস্থায় শ্রমিকসংঘসমূহের (syndicates) হাতেই সমস্ত ক্ষমতা ন্যস্ত থাকবে।

শ্রমিকরা মূল্য সৃষ্টি করে এবং এই শ্রমিকরাই সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করবে। শ্রমিকরাই হল উৎপাদক। এই সুবাদে শিল্পক্ষেত্রের মত রাজনীতিক ক্ষেত্রের উপরও শ্রমজীবীদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হবে। গ্রে তাঁর So cialist Tradition শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: “…syndicalism is that form of socialism which looks to the achievement of a revolution as the outcome of a class war, waged through the instrumentality of the ‘syndicates’ or trade unions, which are destined to displace and supplant the state and the machienery the state.” গোষ্ঠী-সমাজতন্ত্রবাদীরা ‘syndicates বা শ্রমিক সংঘসমূহের ভূমিকার উপর বিশেষ গুরুত্ব ও আস্থা আরোপ করেছেন। এই শ্রমিকসংঘসমূহই একটি সফল বিপ্লব সংঘটিত করবে। তারপর নতুন একটি সামাজিক অবস্থার সৃষ্টি হবে। এই নতুন সমাজে এই সমস্ত সংগঠনের হাতে যাবতীয় ক্ষমতা ন্যস্ত থাকবে। জোড় তাঁর Introduction to Modern Political Theory শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন: “…..that the political sphere, with its organ (the state) should cease to exist as such, and that its functions should be taken even by the bodies of the producers organised on a vocational basis.”

বার্কার (Ernest Barker): বার্কার তাঁর Political Thought in England শীর্ষক গ্রন্থে গোষ্ঠী সমাজতন্ত্রবাদ (Syndicalism) সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। তিনি মার্কসবাদ ও গোষ্ঠী সমাজতন্ত্রবাদের মধ্যে সামঞ্জস্য ও অসামঞ্জস্যের দিকগুলি তুলে ধরেছেন। মার্কসবাদের মত গোষ্ঠী সমাজতন্ত্রবাদও বুর্জোয়া রাষ্ট্র পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের বিরোধী। মার্কসবাদে সমগ্র সর্বহারা শ্রেণীকে বুর্জোয়া রাষ্ট্রের প্রতিপক্ষ হিসাবে প্রতিপন্ন করা হয়। এবং মার্কসবাদে বলা হয় যে এই সর্বহারা শ্রেণীই গড়ে তুলবে একটি নতুন রাষ্ট্র। এই নতুন রাষ্ট্র সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্বের প্রতিনিধিত্ব করবে। গোষ্ঠী-সমাজতন্ত্রবাদে স্বতন্ত্রভাবে বুর্জোয়া রাষ্ট্রের বিরোধিতার কথা বলা হয়েছে। এ ধরনের সমাজতন্ত্রবাদে বুর্জোয়া রাষ্ট্রের বিরোধী শক্তি হিসাবে বিভিন্ন ও স্বতন্ত্র ‘সিন্ডিকেট’ (Syndicate) বা শ্রমিক সংঘগুলিকে তুলে ধরা হয়। প্রতিটি শ্রমিকসংঘই নিজের শিল্প বা পেশাগত ভিত্তিতেই ভূমিকা পালন করে। এই সংস্থাসমূহ স্ব স্ব পদ্ধতিতে শিল্পধর্মঘট বা পেশাগত ধর্মঘটের সামিল হয়। কিন্তু তারা তাদের পৃথক পৃথক ধর্মঘটগুলিকে সচেতন ও স্বতস্ফূর্তভাবে একই সময়ে একটি সাধারণ ধর্মঘটের মধ্যে সমন্বিত করে।

ব্যাখ্যা: ফরাসী শব্দ ‘সিন্ডিকেট’ (Syndicate) থেকে ‘সিন্ডিকেলিসম’ (Syndicalism) শব্দটির সৃষ্টি। ‘শ্রমিকসংঘ’ (trade union) অর্থে ‘সিন্ডিকেট কথাটি ব্যবহার করা হয়। ফ্রান্সে অনেক সময় এবং সাধারণভাবে ‘শ্রমিকসংঘবাদ’ (trade unionism) অর্থেই ‘সিন্ডিকেলিসম’ কথাটি ব্যবহার করা হয়। তবে সাধারণভাবে বলা যায় যে, ‘গোষ্ঠী-সমাজতন্ত্রবাদ (syndicalism) হল ‘বৈপ্লবিক শ্রমিকসংবাদ’। এই মতাদর্শের মধ্যে আগাগোড়াই কর্তৃপক্ষের বিরোধিতা ও বৈপ্লবিক প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। জর্জ সোরেল-এর অভিমত অনুযায়ী গোষ্ঠী-সমাজতন্ত্রবাদ হল বামপন্থীদের সংশোধনবাদী মতাদর্শ। এ হল নতুন অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে মার্কসবাদের পুনরীক্ষণ। এই নতুন অভিজ্ঞতার সুযোগ মার্কসের ছিল না। গোষ্ঠী-সমাজতন্ত্রবাদ হল শ্রমিকসংঘের ভিত্তিতে এক নতুন রাষ্ট্রহীন ও শ্রেণীহীন সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি। মহাজন তাঁর Political Theory শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন: “It (syndicalism) is frankly socialistic in the sense that it adopts the general socialistic view of capital as theft, endorses or rather extends the nation of class war as fundamental in a capitalist society and proposes to abolish pri vate ownership of the means of production and substitutes ownership by the commu nity. Syndicalism insists on the importance of the producer.’ Recent Politi cal Thought শীর্ষক গ্রন্থে এ বিষয়ে বলেছেন: “Syndicalism, loosely defined, holds that the workers alone must control the conditions under which they work and live, the social changes they need can be achieved only by their own efforts by direct action in their own associations and through means suited to their peculiar needs.”

যৌথ ব্যবস্থামূলক সমাজতন্ত্রবাদের উদ্ভব ও বিকাশ

গাউবা তাঁর An Introduction to Political Theory শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন: “It fact, Syndicalism originated as a trend in the Franch labour movement which considers labour unions and their federations as calls of the future socialist order. It insists on the complete independence of labour unions from political parties.” ফ্রান্সে শ্রমিকসংঘ আন্দোলনের হাত ধরেই গোষ্ঠী সমাজতন্ত্রবাদ (syndicalism)-এর আবির্ভাব ঘটেছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগে ফরাসী সরকার আইন করে শ্রমিকদের স্বার্থের প্রতিবন্ধকতাগুলিকে অপসারিত করার ব্যবস্থা করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা দরকার যে, আগে ফরাসী শ্রমিকদের শ্রমিকসংঘ বা কোন সংগঠন গড়ে তোলার অধিকার ছিল না। ফরাসী শ্রমিকরা এই সমস্ত অধিকার পায় কতকগুলি আইনের মাধ্যমে। এ প্রসঙ্গে ১৮৬৪, ১৮৬৮ ও ১৮৮৪ সালের আইনগুলি উল্লেখযোগ্য। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রাক্কালে গোষ্ঠী সমাজতন্ত্রবাদীদের মধ্যে ভাঙ্গন দেখা দেয়। একদল নরমপন্থী বা মধ্যপন্থী (moderate) হিসাবে পরিচিতি লাভ করেন এবং আর একদল সংগ্রামপন্থী (Militant) হিসাবে পরিচিতি পান। গোষ্ঠী-সমাজতন্ত্রবাদ ফ্রান্সের সীমানাকে অতিক্রম করে ইংল্যান্ড, স্পেন, ইতালী ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ছড়িয়ে পড়ে। ইংল্যান্ডে গোষ্ঠী সমাজতন্ত্রবাদী ধ্যান ধারণার বিস্তারের ফলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ও অঞ্চলে ধর্মঘটের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। কিন্তু ইংল্যান্ডের মানুষ সংগ্রামশীল শ্রমিকসংঘের বিরোধিতা করে। এই বিরোধিতার কারণ ইংল্যান্ডে গোষ্ঠী সমাজতন্ত্রবাদের বিকাশ ও বিস্তার ঘটেনি। ইতালীতে মুসোলিনী গোষ্ঠী-সমাজতন্ত্রবাদকে দমিয়ে দেন। স্পেনেও এই সমাজতন্ত্রবাদকে প্রতিহত করা হয়। ফ্রান্সে এই সমাজতন্ত্রবাদ সংগ্রামপন্থী প্রকৃতি প্রাপ্ত হয়। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই সমাজতন্ত্রীরা ছিলেন নরমপন্থী। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বেশ কিছু শান্তিপূর্ণ ধর্মঘট সংগঠিত হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই সমস্ত ধর্মঘটকে দাবিয়ে দেয়। যুদ্ধোত্তরকালে মার্কিনমুলুকে এই শ্রেণীর সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন স্তিমিত হয়ে যায়।

গোষ্ঠী সমাজতন্ত্রবাদের প্রবক্তাদের মধ্যে প্রথমেই জর্জ সোরেল (George Sorel)-এর নাম উল্লেখ করা দরকার। এ ছাড়া হুবার্ট লাগারদেলে (Hurbert Lagardelle)-র নাম উল্লেখ করা দরকার। এই দু’জন রাষ্ট্রদার্শনিক গোষ্ঠী সমাজতন্ত্রবাদের দার্শনিক ভিত্তি গড়ে তোলেন। এ ছাড়া যাঁদের নাম উল্লেখ করা দরকার তাঁরা হলেন পেল্লোউটিয়ার (Fernand Pelloutier), পোউগেট (Emile Pouget), ব্লাঙ্কুই, এডওয়ার্ড বার্থ প্রমুখ। গোষ্ঠী সমাজতন্ত্রবাদের প্রবক্তাদের মধ্যে শ্রমিক সংঘ আন্দোলনের সক্রিয় নেতারা এবং বিচক্ষণ বুদ্ধিজীবীরা ছিলেন।

গোষ্ঠী-সমাজতন্ত্রবাদের মূল বৈশিষ্ট্যসমূহ

গোষ্ঠী সমাজতন্ত্রবাদীরা তাঁদের মতবাদের সুস্পষ্ট ও সম্পূর্ণ পরিচয় প্রদানের ব্যাপারে অনাগ্রহী ছিলেন। জর্জ সোরেলের অভিমত অনুযায়ী ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রের পরিষ্কার চিত্র প্রদান করাটা শ্রমিক শ্রেণীর স্বার্থের পরিপন্থী হবে। স্বভাবতই গোষ্ঠী সমাজতন্ত্রবাদী সমাজের পরিপূর্ণ পরিচয় প্রদান সহজে সম্ভব নয়। তবে গোষ্ঠী সমাজতন্ত্রবাদের কতকগুলি মূল বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করা সম্ভব।

এক: রাষ্ট্রবিরোধী: গোষ্ঠী-সমাজতন্ত্রবাদের অভিযোগ অনুযায়ী রাষ্ট্র হল একটি বুর্জোয়া এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণীর প্রতিষ্ঠান। এই কারণে তাঁরা রাষ্ট্রের বিরোধিতা করেন। পুঁজিপতিরা কেবলমাত্র এই রাষ্ট্রের সাহায্যেই নিজেদের এবং নিজেদের বিশেষাধিকারসমূহের সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে। রাষ্ট্রের অস্তিত্ব অন্যায়-অবিচারকে অব্যাহত রাখে। রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব সর্বদাই সম্পত্তিবান শ্রেণীর পক্ষে এবং শ্রমজীবীদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হয়। এবং এই কারণে রাষ্ট্রের মাধ্যমে বহু রক্তপাতের ঘটনা ঘটে। পুঁজিবাদের সুবিধার দিকে তাকিয়েই রাষ্ট্রীয় কাঠামোকে সংগঠিত করা হয়। রাষ্ট্র ভোক্তাদের স্বার্থ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে, উৎপাদকদের নয়। শ্রমিক শ্রেণীর স্বার্থের বিচারে রাষ্ট্র সহায়ক বা সহানুভূতিশীল নয়। উৎপাদনের প্রকৃত কাজে নিযুক্ত বলতে শ্রমিকদের বোঝায়। রাষ্ট্রের পরিষেবা তাদের জন্য নয়। রাষ্ট্রের পরিষেবা যারা পায় তারা বুর্জোয়া মানসিকতা সম্পন্ন এবং শ্রমজীবীদের প্রতি সহানুভূতিহীন। রাষ্ট্র হল সমাজকে শোষণের একটি পুঁজিবাদী যন্ত্র। এবং প্রকৃতিগত বিচারে আগামী দিনের সমাজেও রাষ্ট্র একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর প্রতিষ্ঠান হিসাবে ভূমিকা পালন করবে।

দুই: সমাজের উপর শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণ: গোষ্ঠী-সমাজতন্ত্রবাদে সমাজের উপর শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করার কথা বলা হয়। ব্যাখ্যা করে বলা হয় যে, সমস্ত মূল্য সৃষ্টি করে শ্রমিকরাই। সুতরাং তারাই হবে সমাজের নিয়ন্ত্রক। তারা আর্থনীতিক ক্ষেত্রের মত রাজনীতিক ক্ষেত্রের উপরও নিয়ন্ত্রণ কায়েম করবে। শিল্প-পরিচালনায় শ্রমিকরা ব্যক্তিগতভাবে উদ্যোগী ও সংযুক্ত হবে। তার ফলে কাজে কর্মে তাদের গর্ববোধ সৃষ্টি হবে এবং উৎপাদিত সামগ্রির পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে এবং গুণগত মান উন্নততর হবে। এই শ্রেণীর সমাজতন্ত্রীদের অভিমত অনুযায়ী পেশাগত ভিত্তিতে সংগঠিত উৎপাদকদের সংস্থাসমূহ রাষ্ট্রের কার্যাবলী করায়ত্ত করবে। শ্রমিকরা উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করলে শ্রমিকদের স্বাধীনতা সম্প্রসারিত হবে এবং শিল্পের দক্ষতা বাড়বে।

তিন: গণতন্ত্রবিরোধী: গোষ্ঠী-সমাজতন্ত্রবাদীরা গণতন্ত্রের বিরোধিতা করেন। তাঁদের মতানুসারে গণতন্ত্র হল হাস্যকর। গণতন্ত্রের নামে মুষ্টিমেয় মানুষ-রাজনীতিক ক্ষমতা কায়েম ও কার্যকর করে। আধুনিককালের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা রাজনীতিক দলব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল। কিন্তু এই শ্রেণীর সমাজতন্ত্রীদের মতানুসারে রাজনীতিক দলগুলি হল কৃত্রিম গোষ্ঠীসমূহ। প্রতিষ্ঠান হিসাবে রাজনীতিক দল বা রাজনীতিক দলব্যবস্থার উপর তাঁরা আস্থাশীল নন।

চার : যুদ্ধ বিরোধী: গোষ্ঠী-সমাজতন্ত্রবাদীরা সংগ্রাম বা যুদ্ধের বিরোধী। যুদ্ধে শ্রমিকদের কোন রকম স্বার্থ নেই। পৃথিবীর সকল শ্রমিকের স্বার্থ অভিন্ন। সুতরাং উদ্দেশ্যহীন বা অর্থহীনভাবে তারা রক্তপাতের মধ্যে জড়িয়ে পড়বে না। যুদ্ধে বিবদমান কোন পক্ষের সঙ্গে শ্রমিকরা যোগ দেবে না। পুঁজিপতিদের পরস্পর বিরোধী স্বার্থের ফলশ্রুতি হল যুদ্ধ। সুতরাং শ্রমজীবী জনতা যুদ্ধ থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখবে।

পাঁচ : সংসদীয় ব্যবস্থার বিরোধী: গোষ্ঠী-সমাজতন্ত্রীরা সংসদীয় ব্যবস্থা ও উপায়-পদ্ধতির বিরোধিতা করেন। তাঁদের অভিযোগ অনুযায়ী সংসদীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ হল বুর্জোয়াদের তৈরী। সুতরাং এই সমস্ত প্রতিষ্ঠান শ্রমিকস্বার্থের সহায়ক হতে পারে না। তাই এই শ্রেণীর সমাজতন্ত্রবাদীরা সকল সংসদীয় প্রতিষ্ঠানকে বয়কট করার কথা বলেন। বিদ্যমান পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার অবসান আবশ্যক। তারজন্য শ্রমজীবীদের মধ্যে শ্রেণী সচেতনতা সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী হওয়া দরকার। শ্রমিকদের সংগঠনসমূহ সংসদীয় প্রতিষ্ঠান সমূহের সঙ্গে সংযুক্ত হলে শ্রমজীবীদের মধ্যে শ্রেণীসচেতনতা শিথিল হয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দেবে। গোষ্ঠী-সমাজতন্ত্রীরা বলেছেন যে, কোন শ্রমিক আইনসভার সদস্য হলে এবং মন্ত্রী হলে সংশ্লিষ্ট শ্রমিক শ্রমজীবীদের জন্য তার উৎসাহ-উদ্দীপনা হারিয়ে ফেলে।

ছয় : শ্রমিকদের সৃষ্টি সমাজতন্ত্রবাদ: গোষ্ঠী-সমাজতন্ত্রবাদীরা মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সমাজতন্ত্রবাদকে বিশ্বাস করেন না। এঁরা দাবি করেন যে, গোষ্ঠী-সমাজতন্ত্রবাদই হল একমাত্র সমাজতান্ত্রিক মতবাদ যা শ্রমিকরা নিজেরাই সৃষ্টি করেছে। অন্য কোন ধরনের সমাজতান্ত্রিক মতবাদ শ্রমিক শ্রেণীর সৃষ্টি নয়। বাকি বিভিন্ন ধরনের সমাজতন্ত্রবাদ হল চতুর মধ্যবিত্ত শ্রেণীর তাত্ত্বিকদের মস্তিষ্কপ্রসূত। এই সমস্ত সমাজতন্ত্রবাদ শ্রমজীবী জনতার প্রয়োজনের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত নয়। শ্রমিক শ্রেণীর বহুবিধ চাহিদার সম্যক অভিব্যক্তি ঘটতে পারে কেবলমাত্র সেই ব্যবস্থা বা মতাদর্শের মাধ্যমে যা শ্রমজীবীদের নিজেদের সৃষ্টি। অন্যান্য ধরনের সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শে শ্রমিকশ্রেণীর স্বার্থসমূহকে প্রাধান্যমূলক গুরুত্ব প্রদান করা হয় না। সমাজতন্ত্রবাদের অন্যান্য ধরন সম্পর্কে জোহারী জোডকে অনুসরণ করে বলেছেন: “They show a tendency to regiment the workers in conformity with some pre-arranged system of society which has seemed good to a clique of intellectuals.”

সাত: সংখ্যালঘু সংগ্রামীদের উপর আস্থা: সমগ্র সর্বহারা শ্রেণীর বিপ্লবের উপর গোষ্ঠী-সমাজতন্ত্রবাদীরা আস্থাশীল নন। এই শ্রেণীর সমাজতন্ত্রীরা সচেতন ও সংগ্রামী সংখ্যালঘুদের উপর অধিক নির্ভরশীল। সর্বহারাদের অবশিষ্ট অংশ সাধারণত নির্লিপ্ত প্রতিপন্ন হয়। সচেতন-সংখ্যালঘুরাই এদের অনুপ্রাণিত করবে এবং নেতৃত্ব দেবে। অল্পকিছু সংগ্রামী মানুষই সর্বপ্রথম ধর্মঘট বা বৃহত্তর আন্দোলনের সূত্রপাত করে। কতিপয় স্থির সংকল্প সচেতন সংখ্যালঘু মানুষই চিরকাল অসচেতন ও অনবহিত সর্বহারাদের নেতৃত্ব দেয়। অর্থাৎ গোষ্ঠী সমাজতন্ত্রবাদীরা কার্যত এলিটবাদের উপর আস্থাশীল হয়ে পড়েছেন। লেনিনবাদের মধ্যেও এই প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়।

আট: শ্রমিক সংগঠনের উপর আস্থা: রাজনৈতিক সমস্যাদির মীমাংসার ব্যাপারে গোষ্ঠী-সমাজতন্ত্রীবাদীরা আপস-রফা বা সমঝোতা প্রক্রিয়ার সামিল হওয়ার বিরোধী। এই শ্রেণীর সমাজতন্ত্রীদের অভিমত অনুসারে বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণী এবং তাদের অবস্থার ক্ষেত্রে অঞ্চলভেদে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। বিভিন্ন বিষয় বিচার-বিবেচনার ক্ষেত্রে প্রত্যেক সমাজের নিজস্ব ধারা এবং মান বা মাত্রা থাকে। নিজের নীতি ও কর্মপদ্ধতি নির্ধারণের ব্যাপারে প্রত্যেক শ্রমিকসংঘের স্বাধিকার আছে। গোষ্ঠী-সমাজতন্ত্রীরা স্বাধীন সমাজে স্বাধীন কাজের আদর্শের কথা বলেন। শ্রমিকসংঘসমূহকে সঠিকভাবে সংগঠিত করতে পারলে বিদ্যমান সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন সাধন সম্ভব। বিদ্যমান রাষ্ট্র ও সমাজে শাসন ক্ষমতা আছে সম্পত্তিবান শ্রেণীর হাতে। কেবলমাত্র শ্রমিক শ্রেণীর সংগঠনসমূহের মাধ্যমে এই রাষ্ট্রব্যবস্থার ও সমাজব্যবস্থার সংস্কার সাধন সম্ভব। শ্রমিক শ্রেণীর সংগঠনসমূহ শ্রমজীবীদের বৈষয়িক স্বার্থ সংরক্ষণ করবে এবং মেহনতী মানুষকে শিক্ষিত ও সচেতন করে তুলবে।

নয়: গোষ্ঠী-সমাজতান্ত্রিক সমাজের ভিত্তি হল শ্রমিক সংঘ (Syndicate)। নির্দিষ্ট কাজে নিযুক্ত শ্রমিকদের নিয়েই শ্রমিকসংঘ। শ্রমিক সংঘসমূহ সামাজিক সম্মতিসহকারে সমাজের স্বার্থে সামাজিক সম্পদ ব্যবহার করবে। শ্রমিকসংঘ (Syndicate) এবং সমাজের বাকি অংশের মধ্যে সংযোগ সম্পর্ক রক্ষা করবে ‘সিটি ট্রেড ইউনিয়ন কাউন্সিল (City Trade Union Council) এবং ‘জেনারেল কনফেডারেশন অব লেবার’ (General Confederation of Labour)। জোহারী এ বিষয়ে মন্তব্য করেছেন: “Like the anarchists the syndicalists, have a picture of their own about the future society in which all power would be with the trade unions.”

দশ: জঙ্গী ও বৈপ্লবিক কার্যকলাপ: গোষ্ঠী-সমাজতন্ত্রীরা উদ্দেশ্য সাধনের জন্য কার্যাবলী সম্পাদনের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ প্রক্রিয়ার সামিল হওয়ার পক্ষপাতী। তাঁরা সহিংস ও বৈপ্লবিক উপায়-পদ্ধতি অনুসরণের কথা বলেন। শাসনতান্ত্রিক এবং শান্তিপূর্ণ পদ্ধতিতে তাঁরা বিশ্বাস করেন না। এই শ্রেণীর সমাজতন্ত্রীরা ধর্মঘট, অন্তর্ঘাত, বয়কট প্রভৃতি সরাসরি বিরোধিতার সামিল হওয়ার পক্ষপাতী। তবে ধর্মঘটের উপরই তাঁরা সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করেন। তাঁদের অভিমত অনুযায়ী বিভিন্ন সংস্থায় কর্মরত শ্রমিকদের ঘন ঘন ধর্মঘটের সামিল হতে হবে। বিভিন্ন সংস্থায় এ রকম ধর্মঘট প্রায়শই সংগঠিত হবে। তারপর চূড়ান্তভাবে সংগঠিত হবে সাধারণ ধর্মঘট। এই সাধারণ ধর্মঘটের উদ্দেশ্য হবে পুঁজিপতিদের ক্ষমতা থেকে অপসারিত করা এবং রাষ্ট্রযন্ত্র দখল করা। গোষ্ঠী-সমাজতন্ত্রবাদীদের মতানুসারে ধর্মঘটের শিক্ষামূলক মূল্য অনস্বীকার্য। ধর্মঘটের প্রাক্কালে শ্রমিকরা আনুগত্য ও শৃঙ্খলার শিক্ষা লাভ করে। ধর্মঘট শ্রমিকদের মধ্যে সংহতি চেতনাকে সমৃদ্ধ করে। মজুরী বৃদ্ধি, কাজের সময় হ্রাস প্রভৃতি নানা কারণে শ্রমিকরা ধর্মঘটের সামিল হতে পারে। এর মধ্যে অন্যায় বা আপত্তিকর কিছু নেই। ধর্মঘট ছাড়া অন্তর্ঘাতও হল শ্রমিকদের হাতে একটি বড় হাতিয়ার। অন্তর্ঘাত শান্তিপূর্ণ হতে পারে, আবার জঙ্গী প্রকৃতির হতে পারে। অন্তর্ঘাতের উদ্দেশ্য হল মালিকদের বা পুঁজিপতিদের যথাসম্ভব ক্ষয়ক্ষতি সাধন করা। বয়কট নীতির উদ্দেশ্যও অভিন্ন। জোহারী তাঁর Principles of Modern Political Science শীর্ষক গ্রন্থে এ বিষয়ে বলেছেন: “The syndicalists reject all peaceful and constitutional method and instead advocate the use of very revo lutionary means what they term ‘direct action”. It may assume any form like general strike, sabotage, bycott, label and go-slow work. “

এগার: মার্কসবাদের মত গোষ্ঠী-সমাজতন্ত্রবাদেও রাষ্ট্রের অস্তিত্বের প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করা হয়েছে। বলা হয়েছে যে, রাষ্ট্র হল স্বৈরাচারমূলক ও পীড়নমূলক প্রকৃতির। স্বৈরাচারী শ্রেণীশাসনের হাতিয়ার হিসাবেই রাষ্ট্র ভূমিকা পালন করে। পীড়নমূলক রাষ্ট্রযন্ত্রের বিলোপ সাধনের পর নতুন সমাজে রাষ্ট্রের জায়গায় আসবে স্থানীয় এবং জাতীয় সংগঠনসমূহ।

বার: গোষ্ঠী-সমাজতন্ত্রবাদীরা বৈপ্লবিক বা আমূল সামাজিক পরিবর্তনের পক্ষপাতী। তাঁরা একটু একটু পরিবর্তনের বিরোধিতা করেন। কারণ এ ধরনের আংশিক পরিবর্তন সাধনের মাধ্যমে শ্রমিকদের প্রভাবিত করা হয়। পরিশেষে জোহারীর একটি মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন: “….that syndicalism is in its early part Marxian and its later part anarchistic. Its attack on the system of capitalism and its faith in the doctrine of class war are distinctly Marxian, but its hope for a future society with all powers to the trade unions is patently, anarchistic with this line of difference, that he here all significance has been attacted to the role of trade unions.” গাউবা তাঁর An Introduction to Political Theory শীর্ষক গ্রন্থে গোষ্ঠী-সমাজতন্ত্রবাদের চারটি মূল বৈশিষ্ট্যের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। (এক) গোষ্ঠী-সমাজতন্ত্রবাদে মার্কসীয় দর্শনের শ্রেণী সংগ্রামের তত্ত্বকে গ্রহণ করা হয়েছে। (দুই) গোষ্ঠী-সমাজতন্ত্রবাদে রাজনীতিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে রাষ্ট্রের বিলোপ সাধনের কথা বলা হয়েছে। (তিন) সমাজে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধনের জন্য গোষ্ঠী-সমাজতন্ত্রবাদে কার্যকর উপায় হিসাবে শিল্প বিষয়ক ক্রিয়াকর্মের উপর জোর দেওয়া হয়েছে এবং শিল্পের উপর শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করার জন্য সাধারণ ধর্মঘটের উপর জোর দেওয়া হয়েছে। (চার) উৎপাদকদের যাবতীয় ক্ষমতা প্রদানের কথা বলা হয়েছে এবং বলা হয়েছে যে, ব্যবসা ও শিল্পক্ষেত্রের ইউনিয়নগুলি সমাজের আর্থনীতিক কাঠামো হিসাবে কাজ করবে।

যৌথ ব্যবস্থামূলক সমাজতন্ত্রবাদের সমালোচনা ও মূল্যায়ন

‘সিন্ডিকেলিসম’ বা গোষ্ঠী-সমাজতন্ত্রবাদ সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। সমালোচকরা এই ধরনের সমাজতন্ত্রবাদের বিবিধ সীমাবদ্ধতার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। সিন্ডিকেলিসমের বিরুদ্ধে সমালোচকরা বহু ও বিভিন্ন যুক্তির অবতারণা করেছেন। সংশ্লিষ্ট যুক্তিসমূহের মধ্যে কতকগুলি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

এক: রাষ্ট্রবিরোধিতার সমালোচনা: সমালোচকদের অভিযোগ অনুযায়ী গোষ্ঠী-সমাজতন্ত্রবাদ অবাস্তবতা দোষে দুষ্ট। এ ধরনের সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ও মর্যাদাকে টেনে একেবারে নীচে নামিয়ে নিয়ে আসা হয়। রাষ্ট্রের মেরুদন্ডকে একেবারে ভেঙ্গে দেওয়া হয়। তার ফলে নৈরাজ্যবাদের আশঙ্কা একেবারে অনিবার্য হয়ে পড়ে। হিংসামূলক জঙ্গি কার্যকলাপ বৃদ্ধি পায়। বিভিন্ন ধরনের ব্যক্তিগত ও সামাজিক ত্রুটি-বিচ্যুতি মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। গোষ্ঠী-সমাজতন্ত্রবাদ রাষ্ট্র-বিরোধী এবং যে কোন রকমের রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে অসহিষ্ণু। এ রকম ধ্যান-ধারণা বিদ্যমান রাজনীতিক বাস্তবতা সম্পর্কে গোষ্ঠী সমাজতন্ত্রবাদীদের সচেতনতার অভাবই সুচীত করে। রাষ্ট্রকে পুরোপুরি বাদ দেওয়ার পরিকল্পনা উদ্যোগ আয়োজন নিতান্তই অবাস্তব। বৃহৎসমাজে একটি সংহতিসূচক শক্তি হিসাবে রাষ্ট্রের উপযোগিতার স্বীকৃতি অনস্বীকার্য। বিদ্যমান রাষ্ট্রের কাঠামো ত্রুটিপূর্ণ হতে পারে। সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর সংস্কার সাধন বা পুনগঠন প্রয়োজন। জোহারী তাঁর Principles of Modern Political Science শীর্ষক গ্রন্থে এ বিষয়ে বলেছেন: “It is true that the syndicalists donot advocate abolition of state like the anar chists, but the logical conclusion of the application of their doctrine would be the same. In this way, syndicalism becomes another variety of revolutionary anarchism.”

দুই: নতুন সমাজের সমালোচনা: গোষ্ঠী-সমাজতন্ত্রবাদীরা ভবিষ্যতের নতুন সমাজব্যবস্থার এক রূপরেখা রচনা করেছেন। নতুন সমাজব্যবস্থার সংশ্লিষ্ট পরিকল্পনা বিরূপ সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে। এই পরিকল্পনায় উৎপাদকদের অধিকার ও কর্তব্যের উপর অতিমাত্রায় গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। কিন্তু ভোক্তাদের বিষয়টিকে বা দিকটিকে কার্যত উপেক্ষা করা হয়েছে এবং জাতীয় নিয়ন্ত্রণের পরিবর্তে স্থানীয় নিয়ন্ত্রণের উপর জোর দেওয়া হয়েছে। এ ধরনের সমাজতান্ত্রিক দর্শন নতুন সমাজের কেবলমাত্র একটি দিকের চিত্র চিহ্নিত করে। এই দর্শনে উৎপাদকের স্বার্থকেই বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয় এবং ভোক্তাদের স্বার্থকে উপেক্ষা করা হয়। তারফলে ভোক্তাদের স্বার্থসমূহ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে। স্বভাবতই সমাজে অশান্তির আশঙ্ক। অনিবার্য হয়ে পড়ে। লেইভলার তাঁর Social Economic Movements শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: “Too much attention has been given to the rights and responsibilities of producers; too little to those of consumers. Too much emphasis has been put on control by the local bourses; too little on control by national units.”

তিন: ধর্মঘটীদের ভূমিকার সমালোচনা: গোষ্ঠী- মাজতন্ত্রবাদীরা শ্রমিকদের সাধারণ ধর্মঘটের উপর জোর দেন। এবং শ্রমিক আন্দোলনের হাতিয়ার হিসাবে অন্তর্ঘাতমূলক কাজকর্ম, ধীরে চল নীতি ও আনুষঙ্গিক ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের কথা বলা হয়। গোষ্ঠী-সমাজতন্ত্রীদের এই সমস্ত হাতিয়ার সমাজ ও মানুষের স্বার্থের হানিকর। সাধারণ ধর্মঘটের প্রতি সমর্থন এবং শ্রমিকদের ধর্মঘটী কার্যকলাপ প্রসঙ্গে গোষ্ঠী সমাজতন্ত্রবাদীদের বক্তব্য বিপজ্জনক ও আপত্তিকর। অন্তর্ঘাতের নামে পুঁজিপতিদের ঘরবাড়ি ও যন্ত্রপাতির ক্ষতিসাধন কোনভাবেই সমর্থন করা যায় না। শিল্পের উৎপাদন হ্রাসের উদ্দেশ্যে বা উৎপাদনের জনপ্রিয়তা হ্রাসের জন্য শ্রমিকদের ‘ধীরে চল’ নীতি অনুসরণ করতে বলা অর্থহীন। শ্রমিকদের অন্তর্ঘাতমূলক কাজকর্মের পরিণামে সমগ্র সমাজের অপূরণীয় ক্ষতি ও অনিষ্টের আশঙ্কা অমূলক নয়। অপ্রয়োজনীয় অপচয়ের জন্য সমগ্র সমাজকেই ভুগতে হবে। উৎপাদন প্রক্রিয়ায় অন্তর্ঘাতের কারণে শ্রমজীবী মানুষের উপরও প্রতিকূল প্রভাব-প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হবে। গোষ্ঠী-সমাজতন্ত্রবাদে ভবিষ্যতের যে নতুন সমাজব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে সেখানে শ্রমিকসংঘের নেতাদের সীমাহীন ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব দেওয়া হয়েছে। শ্রমিকসংঘের নেতাদের ক্ষমতার অপব্যবহারের আশঙ্কা অমূলক নয়। এ বিষয়টি গোষ্ঠী-সমাজতন্ত্রবাদীরা এড়িয়ে গেছেন। রামসে ম্যাক্‌ডোনাল্ড (Ramsay MacDonald) এ বিষয়ে মন্তব্য করেছে: “The creative vitality of society is neither expressed nor strengthened by sabotage, riots, destruction of industrial capital or any one of other minor violences of the syndicalist programme.” The Socialist Tradition শীর্ষক গ্রন্থে গোষ্ঠী সমাজতন্ত্রবাদের সমালোচনা করে বলেছেন: “(Syndicalism) is a political theory, which with little modification, may be used to defend any tyranny, any dictatorship, or any other manifestation of gangsterdom.” গোষ্ঠী-সমাজতন্ত্রবাদের মধ্যে দেশপ্রেমের অভাব আছে। এ ধরনের সমাজতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণা জাতীয়তার বিরোধী।

চার: গোষ্ঠী-সমাজতন্ত্রীরা জঙ্গী ও হিংসাত্মক কার্যকলাপকে সমর্থন করেছেন। সমালোচকরা এই বিষয়টির বিরূপ সমালোচনা করেছেন। জঙ্গী, সহিংস ও বলপ্রয়োগমূলক কার্যকলাপের পরিণামে রক্তক্ষয়, জীবনহানি ও জাতীয় সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতি ঘটবে। সমালোচকদের অভিমত অনুযায়ী গোষ্ঠী-সমাজতন্ত্রবাদীদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার বাস্তবায়ন শাসনতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ পথেও সম্ভব। সাধারণ নির্বাচনের সুযোগ যখন আছে সাধারণ ধর্মঘটের সামিল হওয়ার কোন প্রয়োজন নেই।

পাঁচ: ভবিষ্যৎ সমাজের চিত্র অনির্দিষ্ট ও অস্পষ্ট: গোষ্ঠী-সমাজতন্ত্রবাদীদের ভবিষ্যতের নতুন সমাজব্যবস্থা সম্পর্কিত ধারণা অস্পষ্টতা দোষে দুষ্ট। সমালোচকদের অভিযোগ অনুসারে গোষ্ঠী-সমাজতন্ত্রবাদীরা সুপরিকল্পিতভাবেই তাদের ভবিষ্যতের রূপকল্পকে অস্বচ্ছ অনির্দিষ্ট করে রেখেছেন। এই অস্পষ্টতা এই মতাদর্শের দুর্বলতারই সূচক। ভবিষ্যৎ সম্পর্কিত ধারণা অন্ধকারাচ্ছন্ন হওয়ার কারণে শ্রমিকদের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনার অভাব দেখা দিতে পারে। ভবিষ্যতের পরিকল্পনা সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট হলে শ্রমজীবী জনতার মধ্যে উদ্যোগ-আয়োজনের আধিক্য দেখা দেওয়া স্বাভাবিক। এমনকি, সেক্ষেত্রে শ্রমিকরা আত্মত্যাগেও আগ্রহী হতে পারে। নৈরাজ্যবাদীদের মত গোষ্ঠী-সমাজতন্ত্রবাদীরা ভবিষ্যতের এক স্বর্ণযুগের সম্ভাবনার কথা বলেন। তাঁদের মতানুসারে ভবিষ্যতের এই স্বর্ণযুগে যাবতীয় বিষয় শ্রমিক সংগঠনসমূহের দ্বারা পরিচালিত হবে। এর বাইরে ভবিষ্যতের নতুন সমাজ সম্পর্কে গোষ্ঠী-সমাজতন্ত্রবাদীরা বিস্তারিতভাবে কিছু বলেন নি। জোেড তাঁর Introduction to Modern Political Theory শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন? “While; however, the syndicalist plan of action is direct, vigorous and well-defined, the state of society which it seeks to realise is extremely nebulous. The general out lines are indicated, though even these are hazy, but the details are wanting.”

ছয়: সাধারণ ধর্মঘটের সাফল্য সুনিশ্চিত নয়: গোষ্ঠী-সমাজতন্ত্রবাদে শ্রমিকদের সাধারণ ধর্মঘটের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়। এই সাধারণ ধর্মঘটের সাফল্যের ভিত্তিতে ভবিষ্যৎ নতুন সমাজের রূপরেখা রচনা করা হয়। কিন্তু শ্রমিকদের সাধারণ ধর্মঘট সফল হবেই এমন কথা জোর দিয়ে বলা যায় না। সাধারণ ধর্মঘট ব্যর্থ হতে পারে এবং সে ক্ষেত্রে শ্রমিকদের মনোবল একেবারে ভেঙ্গে পড়বে। রাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনী বলপ্রয়োগের মাধ্যমে ধর্মঘটকে গুঁড়িয়ে দিতে পারে। দুর্বল অবস্থানের জন্য শ্রমিকরা তাদের দাবি-দাওয়াকে নিয়ে বেশি দূর অগ্রসর নাও হতে পারে। ধর্মঘট চলাকালীন প্রয়োজনীয় সামর্থ্যের অভাবে তারা পিছিয়ে যেতে পারে।

সমালোচকরা গোষ্ঠী-সমাজতন্ত্রবাদের বিবিধ সীমাবদ্ধতার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। সংশ্লিষ্ট যুক্তিসমূহের সারবত্তাকে একেবারে অস্বীকার করা যায় না। এতদ্‌সত্ত্বেও রাষ্ট্রনীতিক চিন্তাজগতে গোষ্ঠী-সমাজতন্ত্রবাদের কতকগুলি অবদানকে অস্বীকার করা যায় না।

  • (ক) শ্রমজীবী জনতার দুনিয়ায় গোষ্ঠী-সমাজতন্ত্রবাদের সদর্থক অবদান অনস্বীকার্য। এই মতাদর্শ শ্রমিকশ্রেণীর মধ্যে সচেতনতার সৃষ্টি করে এবং শ্রমিকদের শ্রেণীস্বার্থ সংরক্ষণে উজ্জীবিত ভূমিকা গ্রহণে অনুপ্রাণিত করে।

  • (খ) সমাজতান্ত্রিক চিন্তাভাবনাকে গোষ্ঠী-সমাজতন্ত্রবাদ অধিকতর সমৃদ্ধ করেছে। ফ্রান্সের গোষ্ঠী সমাজতন্ত্রবাদী আন্দোলন পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে সমাজতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণার বিকাশ ও বিস্তারে সাহায্য করেছে। সংঘমূলক সমাজতন্ত্রবাদীরা (guild socialist) ফ্রান্সের গোষ্ঠী-সমাজতন্ত্রবাদীদের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছেন।

  • (গ) গোষ্ঠী-সমাজতন্ত্রবাদের মাধ্যমে সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতাসমূহ প্রকাশিত হয়েছে। রাষ্ট্রীয় সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় আমলাতান্ত্রিক বিকৃতির ঘটনা ঘটে। গোষ্ঠী-সমাজতন্ত্রবাদী এই সমস্ত বিকৃতিকে ব্যক্ত করেছে।

  • (ঘ) বলশেভিক আন্দোলনের গোড়ার দিকে প্রগতিবাদী সংগ্রামশীল সংখ্যালঘুদের নেতৃত্বের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছিল। চিন্তাবিদদের অভিমত অনুসারে গোষ্ঠী-সমাজতন্ত্রবাদীদের মতাদর্শই এক্ষেত্রে প্রেরণা যুগিয়েছে। 

  • (ঙ) গোষ্ঠী-সমাজতন্ত্রবাদে পুঁজিবাদীদের সীমাবদ্ধতাসমূহকে সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে।

বিশ্ববন্দিত দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল (Bertrand Russell) গোষ্ঠী-সমাজতন্ত্রবাদ সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন: “Whatever may be thought of the practicability of syndicalism, there is no doubt that ideas which it has put into the world have done a great deal to revive the labour movement and to recall it to certain things of fundamental importance which it had been in danger of forgetting” গাউবা তাঁর An Introduction to Political Theory শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন : “Syndicalism achieved great ideological success in France in the period between 1899 and 1937. Initially, the movement insisted on the exclusive right of workers to control industry. But after First World War (1914-19) it expended its scope and conceded the equal right of consumers in this sphere of control. Syndicalism stood for ‘socialization without state”.”