শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘যেত পারি কিন্তু কেন যাব’—একই শিরোনাম যুক্ত কাব্যের প্রথম কবিতা। গ্রন্থটি ১৯৮২-এর মার্চ মাসে প্রথম প্রকাশিত হয়, আবার ১৯৮০ সালে এপ্রিল মাসে প্রকাশিত ‘আমি চলে যেতে পারি’ শিরোনামাঙ্কিত কাব্যেও এটি ছিল প্রথম কবিতা, একই কবির কবিতা দুটি পৃথক কাব্যের প্রথম কবিতারূপে অবস্থান নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ ; বিরল দৃষ্টান্ত তো বটেই।

‘যেতে নাহি দিব’ কবিতায় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ যেমন মৃত্যু ও প্রেমের দ্বন্দ্বে প্রেমের জয় ঘোষণা করেছেন ; তেমনি শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও তাঁর যেতে পারি কিন্তু কেন যাব’ কবিতায় মৃত্যু ও জীবনের দ্বন্দ্বে জীবনের জয় ঘোষণা করেছেন, কবি জানেন ‘জন্মিলে মরিতে হবে—তথাপি তিনি মর্ত্যলোকের প্রেম ভালোবাসার মধ্যে জগতের চিরন্তন সত্যতাকে অনুভব করেছেন।

ভাবছি ; ঘুরে দাঁড়ানোই ভালো 

এত কালো মেখেছি দু হাতে–

এত কাল ধরে

কখনও তোমার করে তোমাকে ভাবিনি।

জীবন ও মৃত্যুর মধ্যে কবি অবশেষে জীবনের দিকে ঘুরে দাঁড়ানোই শ্রেয় বলে বিবেচনা করেছেন। চারিদিকে আবর্জনা, ও অদ্ভুত এক আঁধারে ঘেরা পৃথিবীতে বাস করতে করতে কবি চারপাশের সবকিছুতেই দেখেছেন অপর শূন্যতা। জীবনানন্দের মতো তাঁর ও মনে হয়েছে ‘পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এমন’ জীবনের সবকিছু হয়ে গিয়েছিল এলোমেলো। কিন্তু এখন সেদিন অতিক্রান্ত—এখন—

এখন খাদের পাশে বাড়ির দাঁড়ালে 

চাঁদ ডাকে—আয়-আয়-আয়

এখন গঙ্গার তীরে ঘুমন্ত দাঁড়ালে

চিতাকাঠ ডাকে—আয় আয় আয়

জীবন ও মৃত্যু কবিকে নিয়ে খেলা করে, এখন স্বপ্নে যখন খাদের পাশে একাকী দাঁড়ান, তখন শূনতে পান জীবনরূপী চাঁদের মায়ারী কণ্ঠস্বর। আবার ঘুমের মাসে স্বপ্নে গঙ্গার তীরে দাঁড়ালে শুনতে পান মৃত্যুরূপী চিতা কাঠের আহ্বান। জীবনের আকুতি ও মৃত্যুর সম্ভাবনা মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে এক চিত্রকল্পে এমতাবস্থায়—

যেতে পারি

যে কোনো দিকেই আমি চলে যেতে পারি

কিন্তু কেন যাবো 

সন্তানের মুখ ধরে একটি চুমো খাবো

কবি চলে যেতে পারেন যে কোনো দিকেই; বাছতে পারেন নির্বিচারে জীবনের আলোক কিংবা মৃত্যুর অমানিশাকে। কিন্তু কেন যাবেন ? সংগ্রাম করেই তিনি বেঁচে থাকবেন। সন্তানের সুখে স্নেহ চুম্বন এঁকে দেবেন তিনি; মৃত্যুকে হেলায় হারিয়ে দেবেন তিনি। সন্তানের প্রতি প্রেম—তা এতই গভীর ও অনন্ত যে তা মৃত্যুকে অস্বীকার করতে একটুও দ্বিধাচিত হন না—সন্তানের মধ্যেই কবি তখন নিজেকে খুঁজে বেড়ান—

থাকে

কিন্তু এমনি যাবো না

তোমাদের ও সঙ্গে নিয়ে যাবো 

একাকী যাবো না অসময়ে

আগেই বলেছি ; কবি জানেন এ পৃথিবীতে কেউ অমর নয়, যতই বলি যেতে‌ নাহি দিব’ তবুও যেতে দিতেই হয়; তাই কবিও একদিন চলে যাবেন কিন্তু এখনই‌ নয়; একাকীও নয়—পরিচিত জনাদের সাথে নিয়েই তিনি এই পৃথিবী ছেড়ে যাবেন।‌ ব্যর্থতা নয়, নৈরাশ্য নয়, ভবিষ্যতই কবিকে হাতছানি দেয়; সন্তান স্নেহ, তথা বাৎসল্য রসই কবিকে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রেরণা দিয়েছে। সন্তানের মুখের দিকে চেয়ে কবি ভুলতে চেয়েছেন জীবনের সব ক্লেদ ও গ্লানিমাকে। জীবনমুখীতার এই অখণ্ড গতি প্রবাহই এই কবিতাটিকে কালোজীর্ণ করে শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে করেছে কালজয়ী কবি।