ঐশ্বর্যময় ‘ঐশ্বর্ষপর্ব’-এর কাব্য: ‘মানসী’ থেকেই রবীন্দ্রনাথের কবিপ্রতিভার ঐশ্বর্যময় প্রকাশ ঘটে। মানসী কাব্যগ্রন্থের ভূমিকাতে রবীন্দ্রনাথ নিজেই জানাচ্ছেন, “মানসীতেই ছন্দের নানা খেয়াল দেখা দিতে আরম্ভ করেছে। কবির সঙ্গে যেন একজন শিল্পী এসে যােগ দিল।” ‘মানসী’-তে কবি ও শিল্পীর মিলন নানান ঐশ্বর্যে পূর্ণ হয়ে দেখা দিল ‘সােনার তরী’, ‘চিত্রা’ ও ‘চৈতালি’-তে। ‘সোনার তরী’ রবীন্দ্রনাথের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ। ‘সোনার তরী’ কাব্যগ্রন্থের ‘যেতে নাহি দিব’ কবিতায় কন্যা-বিচ্ছেদে আকুল পিতা কোনাে-এক জায়গায় বিচ্ছেদ ভারাক্রান্ত নিসর্গ প্রকৃতির সঙ্গে একাকার হয়ে যায়। এই কাব্যগ্রন্থের ‘বসুন্ধরা’ কবিতায় কবির বিশ্বানুভূতির প্রকাশ ঘটেছে। এই কাব্যের ‘মানসসুন্দরী’ ও ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’ কবিতার রহস্যময়ী নায়িকা ‘চিত্রা’ কাব্যে পরিণত হয়েছে জীবনদেবতায়। ‘চিত্রা’ কাব্যের জীবনদেবতা-বিষয়ক কবিতার পাশাপাশি ‘এবার ফিরাও মোরে’, ‘উর্বশী’, ‘স্বর্গ হইতে বিদায়’ প্রভৃতি কবিতা বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। ‘চৈতালি’ হল মূলত অনেকগুলি সনেট জাতীয় কবিতার সংকলনগ্রন্থ। এখানে কবির জীবনদর্শনের সঙ্গে প্রকাশ পেয়েছে তাঁর সুগভীর মর্ত্যপ্রেম। কবির রােমান্টিক কল্পনা ও বিশিষ্ট জীবন-দর্শন এবং কাব্যসৃষ্টির মৌলিকতার বিচারে এই পর্বের কাব্যগুলি সত্যিই ঐশ্বর্যময়।
গীতাঞ্জলিপর্ব: ‘গীতাঞ্জলি’ (১৯১০ খ্রি.), ‘গীতিমাল্য’ (১৯১৪ খ্রি.) এবং ‘গীতালি’ (১৯১৫ খ্রি.)- এই তিনটি কাব্য রবীন্দ্রকাব্যের গীতাঞ্জলিপর্বের (১৯১০-১৯১৫ খ্রি.) অন্তর্গত। রবীন্দ্রনাথের ‘গীতাঞ্জলি’, ‘গীতিমাল্য’, ‘গীতালি’ কাব্যগ্রন্থে আছে পরম শক্তিমানের কাছে আত্মনিবেদনের আকুতি। তবে নিছক প্রকৃতিপ্রীতি বা জীবনদেবতা তত্ত্বের প্রকাশও এই কাব্যগ্রন্থত্রয়ের অনেক কবিতায় লক্ষ করা যায়। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করতে হয়, মেঘের পরে মেঘ জমেছে, আজি ঝড়ের রাতে তােমার অভিসার প্রভৃতি কবিতার কথা। ‘গীতাঞ্জলি’তে কবির সঙ্গে দেবতার যেমন একটি সন্ত্রমপূর্ণ দূরত্ব আছে, ‘গীতিমাল্য’তে সেই দুরত্ব প্রায় বিলীন হয়ে গেছে। রচনাগুলির আবেদন এমনই যে, কেবল আস্তিক পাঠক নন, নাস্তিক পাঠকও এগুলি নিবিড়ভাবে আস্বাদন করে থাকেন। ‘গীতাঞ্জলি’র নির্বাচিত কবিতাগুলির সঙ্গে আরও কিছু নির্বাচিত কবিতা যােগ করে রবীন্দ্রনাথ সেগুলির ইংরেজি অনুবাদ করেন। অনূদিত কবিতাগুলি প্রকাশিত হয় ‘Song Offerings’ নামে। এই অনূদিত ‘গীতাঞ্জলি’র জন্য রবীন্দ্রনাথ ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত হন। অধ্যাত্মরসের কবিতা তথা গান হলেও এই পর্বের রচনায় পার্থিব আসক্তির উত্তাপও সঞ্চারিত হয়েছে।
বলাকা: ‘বলাকা’ (১৯১৬ খ্রি.), ‘পলাতকা’ (১৯১৮ খ্রি.), ‘পূরবী’ (১৯২৫ খ্রি.), ‘মহুয়া’ (১৯২৯ খ্রি.), ‘বনবাণী ও পরিশেষ’ (১৯২৯ খ্রি.) ‘বলাকাপর্ব’ (১৯১৫- ১৯২৯ খ্রি.)-এর উল্লেখযােগ্য রবীন্দ্রকাব্য। ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত বলাকা কাব্যে রবীন্দ্রকবিতা একটা নতুন বাঁক নেয় ; সেজন্য একে বলাকাপর্ব বলা হয়। বলাকা কাব্যে মুক্ত ছন্দে রবীন্দ্রনাথ গতিতত্ত্ব ও যৌবনতত্ত্বের অপরূপ প্রকাশ ঘটিয়েছেন। বার্গসঁর গতিতত্ত্ব এবং বেদের চরৈবেতি-ভাবনার সমন্বয় ঘটেছে রবীন্দ্রনাথের এই কাব্যে। পতাকা কাব্যে কবি যেমন ধরণীর রূপকে ফুটিয়ে তুলেছেন, ‘পূরবী’ কাব্যে তেমন আমরা লক্ষ করি কবির লীলাসঙ্গিনীর প্রসঙ্গ। ‘মহুয়া’ কাব্যে বৃদ্ধ কবি প্রেমকে প্রাত্যহিক তুচ্ছতা এবং বিলাসিতা থেকে উদ্ধার করে তাকে বৃহৎ ও মহৎ কর্তব্যকর্মের মুখােমুখি দাঁড় করিয়েছেন।
গদ্যকবিতাপর্ব: রবীন্দ্রকাব্যের একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে তাঁর গদ্যকবিতা। ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত ‘পুনশ্চ’ কাব্যটি তাঁর প্রথম গদ্যকাব্য। ‘পুনশ্চ’ ছাড়া তিনি আরও তিনটি গদ্যকাব্য লেখেন। সেগুলি হল ‘শেষ সপ্তক’ (১৯৩৫ খ্রি.), ‘পত্রপুট’ (১৯৩৬ খ্রি.) এবং ‘শ্যামলী’ (১৯৩৬ খ্রি.)। ‘পুনশ্চ’ থেকে ‘শ্যামলী’র মধ্যবর্তী সময়ে যদিও তিনি দুটি ছন্দবদ্ধ কাব্য রচনা করেছিলেন, তবুও এই পর্বটিকে মূলত পুনশ্চপর্ব বা গদ্যকবিতার পর্ব (১৯২৯-১৯৩৬ খ্রি.) বলে চিহ্নিত করা যেতে পারে।
রবীন্দ্রকাব্যের মােহিনীমায়ায় বাংলার কবিকুল যখন মুগ্ধ, তখন মুষ্টিমেয় যে কয়েকজন কবি নিজস্বতা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে একজন হলেন যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত (১৮৮৭-১৯৫৪ খ্রি.)। যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের উল্লেখযােগ্য কাব্যগ্রন্থগুলি হল—‘মরীচিকা’ (১৯২৩ খ্রি.), ‘মরুশিখা’ (১৯২৭ খ্রি.), ‘মরুমায়া’ (১৯৩০ খ্রি.), ‘সায়ম’ (১৯৪০ খ্রি.), ‘ত্রিযামা’ (১৯৪৮ খ্রি.) এবং ‘নিশান্তিকা’ (১৯৫৭ খ্রি.)। ‘অনুপূর্বা’ নামে কবির একটি নির্বাচিত কবিতার সংকলনগ্রন্থও প্রকাশিত হয় ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে।
যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের কাব্যরচনার বৈশিষ্ট্য:
-
যতীন্দ্রনাথের কবিতায় দুঃখের প্রসঙ্গ বিভিন্নভাবে ঘুরে ফিরে আসায় তাঁকে ‘দুঃখবাদী কবি’ আখ্যা দেওয়া হলেও আসলে জীবনকে যেভাবে দেখতে চেয়েছিলেন যতীন্দ্রনাথ, তা না পেয়েই এক ধরনের হতাশায় আক্রান্ত হয়েছে তাঁর কবিমন। ধর্ম, প্রেম এবং প্রচলিত কাব্যভাবনা ছিল তাঁর আক্রমণের লক্ষ্য।
-
প্রকৃতির সৌন্দর্য বা রােমান্টিকতা নয়, বাস্তবের অতি প্রত্যক্ষতাই যতীন্দ্রনাথের কবিতার মূল সুর—“প্রেম বলে কিছু নাই চেতনা আমার সঙ্গে মিশাইলে সব সমাধান পাই।”
-
কবি যতীন্দ্রনাথ তাঁর প্রথম-পর্বের কবিতায় ঈশ্বরের অস্তিত্ব এবং তাঁর ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। ধার্মিক ব্যক্তিদের আস্তিকতা এবং কপট ঈশ্বর-বিশ্বাস নিয়েও তিনি তাঁর কাব্যে সরব হয়েছেন।
-
যতীন্দ্রনাথের কবিতার মূল ভিত্তি ছিল মানবতাবাদ।
-
একেবারে আটপৌরে চলিত শব্দ এবং নতুন ধরনের চিত্রকল্প প্রয়ােগ করে তিনি কবিতায় নতুন ধারা নিয়ে আসেন।
Leave a comment