প্রাচীন ভারতে করব্যবস্থা:

প্রাচীন ভারতে করব্যবস্থার উদ্ভব ও তার ক্রমবিবর্তন রাষ্ট্রব্যবস্থার বিবর্তনের ধারার সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। ঋগ্বেদের যুগের পশুপালনভিত্তিক অর্থনীতি ক্রমশ পরবর্তী বৈদিক যুগে কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিতে পরিবর্তিত হওয়ার ফলে, উদ্বৃত্ত শস্যের মালিকানা নিয়ে যে সামাজিক বৈষম্য সৃষ্টি হয়, তাকে টিকিয়ে রাখার অন্যতম ব্যবস্থারূপে রাষ্ট্রযন্ত্রের উদ্ভব হয়। আবার এই রাষ্ট্রব্যবস্থাকে স্থায়ী করতে এবং তার সামরিক শক্তি ও প্রশাসনের ব্যয়ভার বহন করতে স্থায়ী ও বাধ্যতামূলক করব্যবস্থার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। তবে প্রাথমিকভাবে বৈষম্যমূলক সমাজে রাজনৈতিক শক্তির কর্তৃত্বকে সুদৃঢ় করার উদ্দেশ্যে করব্যবস্থার প্রচলন হলেও পরবর্তী যুগে ভারতের বহুবিচিত্র আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিতে তা রাষ্ট্রের অর্থনীতির মূল ভিত্তিতে পরিণত হয়।

ভারতের ইতিহাসে প্রথম যথাযথ রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার প্রবর্তন করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ও বিভিন্ন বৃত্তির মানুষের কাছ থেকে কর নিয়ে সম্পদ সংগ্রহের প্রচেষ্টা শুরু হয় মৌর্য আমল থেকে। এই সময়কার বিভিন্ন রাজনৈতিক গ্রন্থসমূহের বারবার গুরুত্বের সাথে বলা হয়েছে, রাজকোষ হল রাষ্ট্রের ভিত্তিস্বরূপ এবং রাজার অবশ্য কর্তব্য হল রাজস্ব-সংক্রান্ত নানা বিষয়ের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা। এ কারণে এ যুগের আকর উপাদানগুলিতে রাজকর সংগ্রহ ব্যবস্থার সংগঠন ও তার অন্তর্নিহিত নীতিসমূহের বিশদ বিবরণ লিপিবদ্ধ রয়েছে। মনুর মতে, সকল প্রকার বিচার-বিবেচনা করেই কর ও শুল্ক নির্ধারণ করা উচিত যাতে রাষ্ট্র যথেষ্ট পরিমাণে রাজস্ব আদায়ে সমর্থ হয় এবং রাজকর্মচারীরাও উপযুক্ত বেতন পেতে পারে। করগ্রহণকারী শাসকের অবশ্য কর্তব্য হল করের বিনিময়ে করদাতাদের সুরক্ষাকে সুনিশ্চিত করা। মনু ভূমি-রাজস্বের পরিমাণ নির্ধারণ করেছেন ফসলের এক-ষষ্ঠাংশ, এক-অষ্টমাংশ অথবা এক-দশমাংশ রূপে। এছাড়া তিনি বৃক্ষ, মাংস, মধু, গবাদিপশু, চর্মজাত দ্রব্য, মৃৎপাত্র প্রভৃতি সকল বিষয়ের উপরেই এক-ষষ্ঠাংশ রাজকর ধার্য করার সপক্ষে মত ব্যক্ত করেছেন। ব্যবসায়ীদের উপরে শুল্ক ধার্য করার সময় ক্রয়-বিক্রয়ের হার, যোগাযোগের সুবিধা, বিনিয়োগকৃত অর্থ প্রভৃতির উপর দৃষ্টি দেওয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা মনু উল্লেখ করেছেন। তিনি খনি থেকে উত্তোলিত স্বর্ণ ও অন্যান্য ধাতুসমূহের উপরেও কর ধার্য করার কথা বলেছেন। পরবর্তীকালে রচিত পরাশরস্মৃতিতে অধার্মিক, কুসীদজীবী এবং গণিকাদের উপর রাষ্ট্রের কর আরোপের নীতির বিবরণ পাওয়া যায়। এছাড়া বিষ্ণুস্মৃতিতেও বিভিন্ন ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের করগ্রহণের নীতিকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। তবে তিনি ব্রাহ্মণদের রাজকর দেওয়া থেকে অব্যাহতি দেওয়া উচিত বলে মনে করতেন। যাই হোক্, মৌর্য আমলে উৎপাদনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই রাজকর আরোপের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের যে নীতি পূর্ববর্তী রচনাকাররা তৈরি করেছিলেন, মৌর্যরাজারা তা প্রায় সর্বতোভাবেই মেনে চলেছিলেন। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে উল্লিখিত করব্যবস্থার বিশদ বিবরণ-এর সপক্ষে যুক্তি ও তথ্য উভয়ই সরবরাহ করা হয়েছে। তবে এ প্রসঙ্গে পতঞ্জলির একটি উক্তি বিশেষ প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছিলেন যে, মৌর্যরাজরা স্বর্ণ সংগ্রহের প্রয়াসে মূর্তি প্রতিষ্ঠা করতেন। এখানে মূর্তি বলতে দেবতার প্রতিমূর্তিই বোঝানো হয়েছে। বিশেষ বিশেষ মন্দিরে এইসব মূর্তি স্থাপন করার পর এগুলির উদ্দেশ্যে যে মূল্যবান উপহার-উপাচার নিবেদিত হত তা যথাসময়ে রাজকোষে জমা হত।

কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র থেকে মৌর্যযুগের করপ্রথা সম্পর্কে বিশদ বিবরণ পাওয়া যায়। অর্থশাস্ত্রে রাজস্বের নানাপ্রকার উৎস সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করা হয়েছে। ভারতীয় অর্থনীতিতে ভূমি-রাজস্বই ছিল তখন প্রধানতম কর। অর্থাৎ রাজস্বের সিংহভাগটাই বহন করত দেশের কৃষিজীবী সম্প্রদায়। ভূমির শ্রেণিভেদে ভূমি-রাজস্বের পরিমাণও বিভিন্ন হত। অর্থশাস্ত্রে ‘সীতা’, ‘ভাগ’, ‘বলি’ ও ‘কর’— এই চার প্রকার ভূমিকরের উল্লেখ করা হয়েছে। রাষ্ট্রের খাস জমি বা ‘সীতা’ রাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে ভাড়াটে কৃষক দ্বারা কর্ষিত হত, এবং এই কৃষকদের কাছ থেকে উৎপন্ন ফসলের অর্ধাংশ রাজস্ব হিসেবে গ্রহণ করা হত। একই সঙ্গে রাষ্ট্রের খাস জমির কৃষক যদি রাজকীয় জলসেচব্যবস্থার সুযোগ গ্রহণ করেন তবে তিনি অতিরিক্ত এক-চতুর্থাংশ জলকর হিসেবে রাষ্ট্রকে দিতে বাধ্য থাকতেন। সরকার যদি কৃষককে বীজ, বলদ, কৃষিজ সরঞ্জাম প্রভৃতি সরবরাহ করে তবে উৎপন্ন ফসলের সবটাই সরকারের প্রাপ্য হতো। রাষ্ট্রের খাস জমি থেকে এইভাবে প্রাপ্ত সমস্ত করগুলিকে একত্রে ‘সীতা’ বলা হয়। কৃষিকর্মের প্রধান পরিদর্শক বা সীতাধ্যক্ষের মাধ্যমে এই কর রাজকোষে জমা পড়ত। ব্যক্তিগত মালিকানাধীন জমি থেকে রাষ্ট্রের যে প্রথাগত কর আদায় হত তাকে ‘ভাগ’ বলা হত। এই করের হার, অর্থশাস্ত্র অনুযায়ী, ছিল উৎপন্ন ফসলের এক-ষষ্ঠাংশ। ‘বলি’ এবং ‘কর’ ছিল অতিরিক্ত রাজস্বের অন্তর্ভুক্ত। ‘বলি’ নামক উপকরটি বিশেষ বিশেষ ভূখণ্ডের উপর ধার্য হত। কর ধার্য করা হত রাজস্ব সম্পত্তির উপর বিশেষ বিশেষ মাসে—তাই একে সাময়িক করও বলা হত। উপরিউক্ত চারপ্রকার ভূমিরাজস্ব ছাড়াও ব্যক্তিগত ভূসম্পত্তি থেকে আরও কয়েকটি কর আদায়ের কথা অর্থশাস্ত্রে বিবরণ অনুযায়ী জানা যায়। এদের মধ্যে ‘বিবীত’ ছিল পশুচারণভূমির উপর ধার্য কর। ‘রজ্জু’ ছিল জমি জরিপ ও পরিমাণের জন্য রাষ্ট্রের প্রাপ্য কর, ‘পিণ্ডকর’ ধার্য করা হত একগুচ্ছ গ্রামের উপর। গ্রামের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রীয় সেনাবাহিনী গেলে তাদের দিতে হত ‘সৈন্যভক্ত’ এবং ‘হিরণ্য’ ছিল নগদে দেয় রাজস্ব। এছাড়াও ছিল জলসেচের সুযোগ নেওয়া হলে তার জন্য দেয় ‘জলকর’ যার কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। লক্ষণীয় বিষয় হল, এতগুলি করের বোঝার বেশিরভাগটাই গ্রামের কৃষিজীবী সম্প্রদায়কে বহন করতে হত।

মৌর্যযুগে বিভিন্ন প্রকার ভূমিরাজস্ব থেকে করব্যবস্থার সিংহভাগ আদায় হলেও তা রাষ্ট্রের আয়ের একমাত্র উৎস ছিল না। এই যুগে বাণিজ্য ও শিল্পের প্রসার এবং তাকে কেন্দ্র করে নগরায়ণের পটভূমিতে পণ্যদ্রব্যের উপরেও ব্যাপক হারে কর আরোপ করা হয় ও এর মাধ্যমে বিভিন্ন বাণিজ্য ও শিল্পক্ষেত্রের উপর রাষ্ট্রায়ত্ত নিয়ন্ত্রণ কায়েম করা হয়। অর্থশাস্ত্রে বিভিন্ন প্রকার শুল্কের শ্রেণিবিভাগ করা হয়েছে এবং কোন প্রকার পণ্যের কি পরিমাণ শুষ্ক হবে তা-ও নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। শুষ্ক ছিল তিন প্রকার—(১) বাহ্য শুল্ক বা জনপদে উৎপন্ন পণ্যের উপর ধার্য কর, (২) আভ্যন্তর শুল্ক অর্থাৎ—দুর্গ, নগর প্রভৃতি স্থানে উৎপন্ন দ্রব্যের উপর ধার্য কর, (৩) আতিথ্য শুল্ক, অর্থাৎ বিদেশ থেকে আমদানিকৃত বা বিদেশে রপ্তানিকৃত পণ্যের উপর ধার্য শুল্ক। বিদেশ থেকে আমদানি করা পণ্যের উপর সাধারণভাবে পণ্যমূল্যের অর্ধাংশ কর হিসেবে ধার্য করা হত। তবে শঙ্খ, হীরক, প্রবাল, মুক্তা প্রভৃতি দ্রব্যের উপর শুল্ক আরোপ করার সময় বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি দ্বারা পণ্যের গুণাগুণ বিচার করে তদনুযায়ী শুল্ক নির্ধারণ করা হত। পণ্যের মূল্যের উপর কর আদায় করা ছাড়াও বণিকদের কাছ থেকে পথকর, জলকর, খেয়াঘাট-কর ইত্যাদি অতিরিক্ত কর আদায় করা হত। তবে বিদেশ থেকে পণ্যদ্রব্যের আমদানিকে উৎসাহদান করার উদ্দেশ্যে সার্থবাহ ও নাবিকদের শুল্কের উপর কিছু ছাড় দেওয়া হয়। শুল্কাধ্যক্ষ নামে রাজকর্মচারী অন্তর্দেশীয় ও বৈদেশিক বাণিজ্যের শুল্ক আদায় করতেন। রাজ্যের সীমানায় ও বিভিন্ন স্থানে শুল্কশালা নির্মাণ করে শুল্কাধ্যক্ষ কেবল শুল্ক আদায় করতেন তাই নয়, পণ্যদ্রব্যের মূল্যস্তর নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং পণ্যদ্রব্যের সরবরাহ নিয়মিত রাখাও তাদের প্রধান কর্তব্য ছিল। কারিগরি শিল্পের উপর রাষ্ট্রের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছিল। মদ্য ব্যবসায়ীদের উপর অত্যন্ত চড়া হারে কর আরোপ করা হত। শিল্পনিগমগুলিও রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল। মৌর্যযুগে খনি ও ধাতুবিদ্যা বিশেষ প্রসারলাভ করেছিল। সোনা, রূপা, তামা, সীসা প্রভৃতি ধাতু ও লবণের খনিগুলি থেকে এবং ধাতুকর্ম থেকে রাজস্ব বাবদ রাষ্ট্রের বিপুল আয় হত। এছাড়া আপৎকালীন সময়ে রাজকোষে কোন কারণে অর্থাভাব দেখা দিলে, রাজা রাজকোষ বৃদ্ধির জন্য বিশেষ বিশেষ প্রজাদের কাছ থেকে অসৎ উপায়ে বা বলপ্রয়োগের দ্বারা অতিরিক্ত কর আদায় করতে পারতেন। এই করটিকে বলা হত ‘প্রণয় কর’।

ভূমি ও বাণিজ্যপণ্যের উপর এত ব্যাপক ক্ষেত্র জুড়ে কর আরোপের ফলে রাষ্ট্রের আয়ের বহুবিধ উৎস তৈরি হয়। আয়ের সূত্রগুলিকে একত্রে ‘আয়শরীর’ এবং রাষ্ট্র কর্তৃক ব্যয়ের বিভিন্ন দিকগুলিকে ‘ব্যয়শরীর’ নামে অভিহিত করা হয়েছে। লক্ষণীয় বিষয় হল মৌর্য-অর্থনীতির ধরনটি ছিল কেন্দ্রীয়, অর্থাৎ রাষ্ট্রের আয়ের সমস্তটাই রাজকোষে জমা পড়ত এবং বিভিন্ন ব্যয়বরাদ্দও নির্ধারিত হত রাজকোষে সঞ্চিত অর্থের মাধ্যমে। এ কারণে রাজকোষের সঠিক ও উপযুক্ত পরিচালনার উপরে রাজ্যশাসনের সাফল্য বা ব্যর্থতা অনেকাংশে নির্ভর করত। ‘সমাহর্তা’ ও ‘সন্নিধাতা’ নামক দুই রাজকর্মচারীর উপর রাজকোষের তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব ন্যস্ত থাকত। সমাহর্তা ছিলেন উৎপন্ন আয়ের সমাহরণকারী ব্যক্তি। তিনি দুর্গ, রাষ্ট্র, খনি, সেতু, বন, ব্রজ ও বণিকপথ—এই সাতটি সূত্র থেকে কি কি উপায়ে ধন উৎপাদন করা যায় সে বিষয়ে নীতি-নির্ধারণ করতেন। এদের মধ্যে দুর্গ থেকে বাইশ প্রকারে, রাষ্ট্র থেকে তেরো প্রকারে, খনি থেকে বারো, সেতু থেকে পাঁচ প্রকারে এবং বন, ব্রজ ও বণিকপথ থেকে যথাক্রমে চার, আট ও দুই প্রকারে ধনাগমের কথা শাস্ত্রে বলা আছে। উপরের বর্ণিত ধনাগমসূত্রকে একত্রে ‘আয়শরীর’ বলা হয়। তবে রাজার মূল ধনাগম স্থানগুলিকে আলাদা করে চিহ্নিত করা হত। এই মূল আয়ের সূত্রগুলিকে ‘আয়মুখ’ বলা হত। আয়মুখ সাতটি, যথা- (১) মূল (শস্যাদির বিক্রয়লব্ধ ধন), (২) ভাগ (শস্যের এক-ষষ্ঠাংশ), (৩) ব্যাজী (বার বার মাপার জন্য দ্রব্যাদি কম পড়ার আশঙ্কায় বেশি নেওয়া), (৪) পরিখ (খেয়া পারাপর জনিত শুল্ক), (৫) ক্লপ্ত (নির্দিষ্ট কর), (৬) রূপিক (লবণ কর), (৭) অত্যয় (বিচারবিভাগ থেকে প্রাপ্ত জরিমানা), বিভিন্ন সূত্র থেকে রাজকোষে যেমন সম্পদ জমা হত তেমনি, রাজ্যের অভ্যন্তরীণ শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখতে, স্থায়ী সামরিক বাহিনী প্রতিপালন করতে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় আপৎকালীন ভিত্তিতে আর্ত মানুষদের ত্রাণের ব্যবস্থা করতে, ইত্যাদি বিভিন্ন খাতে রাজকোষে সঞ্চিত অর্থ ব্যয় করা হত। অর্থশাস্ত্রে রাষ্ট্রের ব্যয়ের মোট চব্বিশটি সূত্র বর্ণিত হয়েছে। এই সূত্রগুলিকে একত্রে ‘ব্যয়শরীর’ বলা হয়। লক্ষণীয় বিষয়, মৌর্যযুগ ছিল মুদ্রাব্যবস্থা প্রচলনের উন্মেষ লগ্ন। এর ফলে রাজকোষে যে সম্পদ রাষ্ট্রের আয় বাবদ জমা পড়ত তার অধিকাংশই ছিল শস্য ও পণ্যের রূপে। এই শস্য, পণ্য, রত্নাদির সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের জন্য এক ব্যাপক ব্যবস্থার প্রয়োজন হত। এই ব্যবস্থাকে পরিচালনা করতেন সন্নিধাতা নামক রাজকর্মচারী।

মৌর্যযুগের বিভিন্ন মৌল উপাদানগুলি থেকে জানা যায়, জনগণের মধ্যে কিছু নির্দিষ্ট শ্রেণির মানুষ রাজকর দেওয়া থেকে অব্যাহতি পেতেন। সংহিতা গ্রন্থগুলি থেকে জানা যায় যে, ধর্মগ্রন্থে সুপণ্ডিত ব্যক্তি এবং ব্রাহ্মণরা রাজকর দেওয়া থেকে অব্যাহতি পেতেন। ব্রাহ্মণ্য সূত্রে বিষয়টিকে এইভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে যে, ব্রাহ্মণরা তাদের ধর্মীয় কার্যকলাপ দ্বারা রাজকোষে তাঁদের নিজস্ব উপায়ে অবদান রাখেন, তাই তাদের কর না দিলেও চলে। কিছু গ্রন্থে ‘রাজার অনুচরবৃন্দ’ বা রাজকর্মচারীদেরও করমুক্ত ব্যক্তির তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ রাজকরের বোঝাটা মূলত বহন করতে হত কৃষিজীবী সম্প্রদায় ও কারুশিল্পীদের। এর ফলে নিশ্চিতভাবেই সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী, ভূসম্পত্তির ছোটবড় মালিক ও গোষ্ঠীর মধ্যে পারস্পরিক বিভেদ ও অসঙ্গতি প্রবলতর হয়ে উঠেছিল।

প্রাচীন ভারতের করব্যবস্থার উপরিলিখিত সামগ্রিক আলোচনা থেকে আমরা অর্থনীতির যে রূপরেখাটি খুঁজে পাই তা মূলত রাষ্ট্রায়ত্ত অর্থনীতির, যে অর্থনীতির সূচনা হয় মূলত মৌর্য আমলে এবং পরবর্তী বেশ কয়েক শতাব্দী ধরে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যাপকতর অর্থে প্রসারিত হয়। অর্থনৈতিক জীবনে রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্য ছিল মূলত সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষের সুখস্বাচ্ছন্দ্যকে সুনিশ্চিত করা এবং একই সাথে রাষ্ট্রের রাজস্বের পরিমাণ বৃদ্ধি করে শক্তিশালী সামরিক বাহিনী গড়ে তোলা ও রাজ্যের অভ্যন্তরীণ শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখা। যদিও এই কথা মনে করার কোন কারণ নেই যে, সমাজতান্ত্রিক আর্থ-সামাজিক কোন আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছিল। কারণ এই রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে কোথাও শ্রেণীবৈষম্যকে দূর করার কোন প্রচেষ্টা দেখা যায় না। রাজার কর্তৃত্ব ও মহিমাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতেই রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করা হয়েছিল বলে অনেকে মনে করেন। যাই হোক্, রাষ্ট্রায়ত্ত অর্থনীতি মৌর্যযুগে যথেষ্ট সাফল্য পেলেও এর কিছু বিপরীত প্রভাব ছিল যার চিহ্ন গুপ্ত ও গুপ্তোত্তর অঞ্চলে ফুটে উঠতে দেখা যায়।

প্রাচীন ভারতে শিল্পের বিকাশ :

ভারতবর্ষ প্রাচীনকাল থেকেই কৃষিনির্ভর দেশ। ভারতে কৃষি-অর্থনীতির বিকাশ বিভিন্ন নগরীর পত্তনে সাহায্য করেছিল, আর এই সঙ্গে বিভিন্ন পেশায় উদ্ভব ঘটিয়েছিল। এ প্রসঙ্গে কারুশিল্পের বিকাশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বেদগ্রন্থগুলিতে নানাপ্রকার কারুশিল্পীর উল্লেখ পাওয়া যায়, যেমন—কামার, কুমোর, চর্মশিল্পী, স্বর্ণকার, ছুতোর, অস্ত্রব্যবসায়ী ইত্যাদি। এদের মধ্যে সব থেকে সম্মানজনক পেশা ছিল ছুতোর এবং কামারের। কারণ তাঁরা চাষের যন্ত্রপাতি ও অস্ত্রশস্ত্র বানাতেন এবং বাড়ি তৈরি করতেন। এছাড়াও সে সময় রথ-নির্মাণ শিল্প, সূচী-বয়ন শিল্প ও স্বর্ণালঙ্কার শিল্পও সমাজে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করেছিল বলে ঋগবেদের সূত্রগুলি থেকে জানা যায়।

খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে ভারতে বাণিজ্যের বিশেষ উন্নতি হয়, এর সঙ্গে সঙ্গে শহরগুলির উন্নতিসাধনও ঘটে। এর ফলে পূর্ববর্তী সময়কার কারুশিল্পের একটি ক্রমবিকাশ লক্ষ্য করা যায়। প্রাক্-মৌর্যযুগের গ্রন্থ দীর্ঘনিকায়তে যেখানে কারিগরি বৃত্তির সংখ্যা ছিল চব্বিশ, সেখানে খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতকের রচনা মহাবস্তু অবদানে ও খ্রিষ্টীয় প্রথম শতকের গ্রন্থ মিলিন্দপेহোতে এই সংখ্যা যথাক্রমে ছত্রিশ ও পঁচাত্তর। এ থেকে অনুমিত হয় যে, খ্রিঃপূঃ দ্বিতীয় শতক থেকে খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতকের অন্তর্বর্তী সময়ে ভারতে হস্তশিল্পের প্রভূত উন্নতি হয়েছিল। গ্রীকদূত মেগাস্থিনিস পাটলীপুত্র নগরীতে শিল্পজাত বস্তু তত্ত্বাবধানের জন্য একটি পৃথক বোর্ডের উল্লেখ করেছেন। স্ট্র্যাবো সোনা এবং মূল্যবান পাথরে সজ্জিত পোশাকের কথা বলেছেন। তখন ভারতের নিম্নগাঙ্গেয় উপত্যকায় সর্বোৎকৃষ্ট মসলিন তৈরি হত। ভারতীয়দের পোশাক সম্পর্কে এ্যারিয়ানের বিবরণী থেকে জানা যায় যে, ভারতের কার্পাস-শিল্প তখন যথেষ্ট উন্নত ছিল। এ্যারিয়ানের বিবরণী থেকেভারতীয়দের রঞ্জন-শিল্পের এবং চর্মশিল্পের উন্নতির কথাও জানা যায়। বিলাসদ্রব্যের কারিগরদের মধ্যে অন্যতম ছিল ‘দত্তকার’। এরা হাতির দাঁত কেটে বিলাসী অলংকার তৈরি করত। অলংকার-শিল্পে সেকালের কারিগররা দারুণ দক্ষ ছিলেন। সোনার অলংকার তৈরি করতেন ‘সুবর্ণকার’। দামী পাথর থেকে অলংকার প্রস্তুতকারকদের বলা হত ‘মণিকার’। উৎখননের ফলে খ্রিস্টপূর্ব ২০০ ও খ্রিষ্টীয় ২০০ অব্দে প্রস্তুত কিছু দামি পাথরের পুঁতি পাওয়া গেছে। এগুলি মণিকারদের দ্বারা তৈরি বলে অনুমিত হয়।

মেগাস্থিনিস ভারতে পাঁচটি ধাতুর ব্যবহারের কথা লিখেছেন। অবশ্য মনে করা হয় যে, ব্যবহৃত ধাতুর সংখ্যা এত বেশি ছিল যে তিনি সবগুলির নামোল্লেখ করতে পারেননি। এইসব ধাতুগুলি অস্ত্রবিদ্যা এবং অলংকার নির্মাণের কাজে লাগত। খনিজ ধাতুকে অস্ত্র ও অলংকার বা নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি নির্মাণের উপযোগী করে তুলতে রাসায়নিক ও কারিগরি জ্ঞানের সম্যক প্রয়োজন। মেগাস্থিনিস ও এ্যারিয়ানের বিবরণী থেকে মনে হয় ভারতীয়দের এই জ্ঞান ছিল। অর্থশাস্ত্রে রাজার নিজস্ব অস্ত্র নির্মাণশালার যে বিবরণ আছে তাও এই সত্যকেই প্রমাণিত করে। প্রথম দিকের ইউরোপীয় ঐতিহাসিকগণ প্রাচীন ভারতীয়দের ধাতুবিদ্যায় দক্ষতা সম্পর্কে কটাক্ষ করলেও একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় ধাতুশিল্প ঐ যুগে অভাবনীয় উন্নতিলাভ করে। মৌর্য-পরবর্তী যুগে খ্রিষ্টীয় প্রথম শতাব্দীতে ধাতুশিল্পী এবং ঢালাই কারখানার কারিগরেরা বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিল। নানান রকম লৌহাস্ত্রের উপর গ্রীস-রোমান বা মধ্য এশিয়ার প্রভাব দেখা যায়। তবে সাধারণভাবে শিল্পীরা স্থানীয় ঐতিহ্যই অনুসরণ করত।

বস্ত্রবয়ন শিল্পে এযুগে উত্তরোত্তর উন্নতি লক্ষ্য করা যায়। বিশেষ প্রয়োগ পদ্ধতির মাধ্যমে এ যুগের মানুষ অতি সূক্ষ্ম, অর্ধস্বচ্ছ রেশম এবং মসলিন প্রস্তুত করতে জানত। এই রেশম তখন পাশ্চাত্যেও রপ্তানি করা হত। গ্রীক লেখকরা ভারতে উৎপন্ন তুলার রঙ এবং বুননের উৎকর্ষের কথা তাদের বিবরণীতে বলেছেন। পেরিপ্লাসের উল্লেখ থেকে জানা যায়, দাক্ষিণাত্যের টগর ও পৈঠান বস্ত্রশিল্পের প্রধান দুটি কেন্দ্র ছিল। এছাড়া বারাণসী, মথুরা ও উজ্জয়িনী বস্ত্রশিল্পের জন্য উত্তর-ভারতে খ্যাতিলাভ করেছিল।

মৌর্যযুগে শিল্পের স্থানীয়করণ ঘটেছিল। দেশের এক একটি অঞ্চলে বিশেষ একটি শিল্প ব্যাপকভাবে গড়ে ওঠে। এই আঞ্চলিকীকরণের পিছনে ওই বিশেষ অঞ্চলে বিশেষ শিল্পের প্রয়োজনীয় কাঁচামালের যোগান এবং শিল্প সম্পর্কে স্থানীয় ঐতিহ্য কাজ করত। এই স্থানীয়করণ শহর থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছিল। লোহার প্রধান উৎপাদন কেন্দ্র ছিল মগধ। রাজপুতানা, হিমালয়ের পাদবর্তী অঞ্চলে পাওয়া যেত তামা। দক্ষিণ-ভারত বিখ্যাত ছিল সোনা ও মূল্যবান পাথরের জন্য। বারাণসী, উজ্জয়িনী বস্ত্রশিল্পের জন্য গান্ধার পশম শিল্পের জন্য এবং তক্ষশীলা মণিমুক্তার কাজের জন্য বিখ্যাত ছিল।

কারুশিল্পীদের নিজস্ব সমবায় সংঘ ছিল। সেগুলিকে বলা হত ‘শ্রেণি’। শ্রেণিগুলি কিছু পরিমাণ স্বাধীন ছিল। তাদের নিজস্ব বিধিবিধানও ছিল। সংঘের সদস্য কোন কারুশিল্পীকে এই সব বিধিবিধান মেনে চলতে হত। ক্ষেত্রবিশেষে সংঘও তার সদস্যদের পক্ষে দাঁড়াত। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে চেষ্টা চালানো হত সমবায় সংঘগুলির উপর কর্তৃত্ব স্থাপন করার। সংঘগুলিকে রাষ্ট্রের কাছে নাম নথিভুক্ত করতে হত এবং সংঘের কর্মস্থল রাষ্ট্রের অনুমতি ছাড়া স্থানান্তরিত করা যেত না।

মৌর্যযুগে ধাতু ও বয়ন শিল্প ছাড়াও অন্যান্য যে সমস্ত শিল্পকলা উৎকর্ষ লাভ করেছিল তাদের মধ্যে ছিল গন্ধদ্রব্য প্রস্তুতি, কালো ও কড়া পালিশযুক্ত মৃৎশিল্প, হাতির দাঁতের বিলাসদ্রব্য প্রস্তুতি ইত্যাদি।

শিল্প সংগঠনের মূলে ছিল রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ। রাষ্ট্রই ছিল শিল্প ও ধাতুর খনিগুলির একক উদ্যোক্তা ও নিয়ন্তা। রাষ্ট্রের নিজস্ব তেলের ও চিনির কারখানা ছিল। কারুশিল্পী সংঘের উপরেও তাদের নিয়ন্ত্রণ ছিল। তবে ব্যাসামের মতে, অর্থনৈতিক কাঠামো প্রায় রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রণাধীন হলেও উৎপাদন ও বণ্টনের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত উদ্যোগের সুযোগ ছিল।