সূচনা: ভারতের প্রাচীনতম গ্রামীণ সভ্যতা হল নব্য প্রস্তর যুগের মেহেরগড় সভ্যতা। আধুনিক ধারণায় হরপ্পা সভ্যতা ছিল মেহেরগড় সভ্যতারই বিকশিত রূপ। এ প্রসঙ্গে শিরিন রত্নাগর বলেছেন, “মেহেরগড়ই হরপ্পা সংস্কৃতির ক্রমবিকাশের স্তরগুলি তুলে ধরে।
[1] আবিস্কার: ফরাসি প্রত্নতত্ত্ববিদ যা ফ্রঁসোয়া জারিজ (Jean Francois Jarrige) পাকিস্তানের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের প্রধান রিচার্ড মিডাে (Richard Medow)-কে সঙ্গে নিয়ে বালুচিস্তান ও তার নিকটবর্তী অঞ্চলে খননকার্য চালান। তাদের এই প্রচেষ্টার ফলে কাচ্চি সমভূমি (বালুচিস্তানের পশ্চিমে সিন্ধু উপত্যকায়)- তে ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে মেহেরগড় সভ্যতার প্রাচীন নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়।
[2] অবস্থান: পাকিস্তানের বালুচিস্তানের কাচ্চি জেলারবােলান গিরিপথের ধারে মেহেরগড় প্রত্নক্ষেত্রের (প্রায় ৫০০ একর জুড়ে) অবস্থান। মেহেরগড় সভ্যতার উত্তরে বােলান গিরিপথ, কাকর পর্বতশ্রেণি, লােরলাই-ঝােব নদী, দক্ষিণে কাচ্চি সমভূমি, সিন্ধুনদ, কিরথর পর্বতশ্রেণি, পূর্বে সুলেমান পর্বতশ্রেণি, সিন্ধু উপত্যকা এবং পশ্চিমে রয়েছে হেলমান্দ, মারগাে ও তাহলাব মরুভূমি।
[3] প্রত্নকন্দ্র: মেহেরগড় ছিল একটি গ্রামীণ সভ্যতা। মেহেরগড় সভ্যতার উল্লেখযােগ্য কয়েকটি প্রত্নক্ষেত্র বা প্রত্নকেন্দ্র ছিল—নৌসেরা, রানা ঘুনডাই, পেরিয়ানো ঘুনডাই, কিলিগুল মহম্মদ, কাচ্চিবেগ, কুল্লি, দারারকোট, মুন্ডিগাক, কোটদিজি প্রভৃতি।
[4] কালসীমা: জাঁ ফ্রাসােয়া জারিজ মেহেরগড় সভ্যতার সময়ের ব্যাপ্তিকে তিন পর্বে ভাগ করলেও আসকো পারপােলা আটপর্বের যে কালসীমা নির্ণয় করেছেন তা হল—
-
প্রথম পর্ব: আনুমানিক ৭০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৬০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ।
-
দ্বিতীয় পর্ব: আনুমানিক ৬০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৫০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ।
-
তৃতীয় পর্ব: আনুমানিক ৫০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৩৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ।
-
চতুর্থ-পঞ্চম পর্ব: আনুমানিক ৩৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৩২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ।
-
ষষ্ঠ-সপ্তম পর্ব: আনুমানিক ৩২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ২৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ।
-
অষ্টম পর্ব: আনুমানিক ২৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ১৮০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ।
[5] বৈশিষ্ট্য: মেহেরগড় সভ্যতার অন্যতম দুটি বৈশিষ্ট্য হল—
-
নব্য প্রস্তর যুগের সভ্যতা: ভারতে নব্য প্রস্তর যুগের সূচনা ঘটে আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৪০০০ অব্দ থেকে। ৭টি পর্যায়বিশিষ্ট মেহেরগড় সভ্যতার সময়কাল আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৭০০০ অব্দ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ১৮০০ অব্দ পর্যন্ত। তাই পণ্ডিতগণ সাধারণভাবে মেহেরগড় সভ্যতাকে নব্য প্রস্তর যুগের সভ্যতা বলে থাকেন।
-
প্রাগৈতিহাসিক সভ্যতা: যে প্রাচীন সভ্যতার কোনাে লিখিত বিবরণ নেই, শুধুমাত্র প্রত্নতাত্ত্বিক বিবর্তনের ওপর ভিত্তি করে যে সভ্যতার পরিচয় জানা যায়, সেই সভ্যতাকে বলে প্রাগৈতিহাসিক সভ্যতা। মেহেরগড়ে বিভিন্ন প্রত্নক্ষেত্রে প্রাপ্ত বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলির ভিত্তিতেই কেবল সভ্যতাটির বিবরণ লিপিবদ্ধ করা হয়। তাই মেহেরগড় সভ্যতাকে প্রাগৈতিহাসিক সভ্যতা বলা হয়।
[6] ঘরবাড়ি: মেহেরগড়ে কৃষিভিত্তিক জীবনধারার বিকাশ ঘটলে স্থায়ী বসতি গড়ে ওঠে। রােদে শুকানাে কাদামাটির ইট দিয়ে বাড়ি তৈরি শুরু হয়। বাড়িগুলি ছােটোবড়াে কয়েকটি কামরায় বিভক্ত ছিল। বাড়িগুলিতে আগুন জ্বালিয়ে ঘর গরমের ব্যবস্থা ছিল।
[7] শিল্প: মেহেরগড়বাসী মৃৎশিল্প, অলংকারশিল্প, বয়নশিল্পে পারদর্শী ছিল। পােড়ামাটির নারীমূর্তি তৈরির পাশাপাশি তারা তামার পুঁতি, আংটি, ছুরি প্রভৃতি তৈরি করতে শিখেছিল| তারা বৈদূর্যমণি, নীলকান্তমণি, মাদার অফ পার্ল দিয়ে হার তৈরির কৌশল শিখেছিল। এ ছাড়াও তারা পশুর লোম ও উল দিয়ে কাপড় বুনতে শিখেছিল।
[8] জীবিকা: মেহেরগড়বাসীর জীবিকা ছিল পশুপালন, শিকার, কৃষিকাজ ও ব্যাবসাবাণিজ্য। তারা মূলত কৃষিকাজের সুবিধার জন্যই প্রথমদিকে পশুপালন শুরু করেছিল। তাদের উৎপাদিত কৃষিজ ফসল ছিল—যব, গম, তুলো, খেজুর প্রভৃতি।
[9] সমাধিপ্রথা: মেহেরগড়ে মৃতদেহকে সমাধিস্থ করার প্রথা প্রচলিত ছিল। সমাধির আগে মৃতদেহে গেরুয়া মাটি মাখানো হত। সমাধিস্থলে মৃতদেহের পাশে মূল্যবান অলংকার-সহ তার ব্যবহার্য জিনিসপত্র রাখা হত, যেমন—পাথর বা ঝিনুকের মালা, হাড়ের আংটি, বৈদূর্যমণি (বা লাপিস লাজুলি), নীলকান্তমণি (বা টার্কোয়াজ) প্রভৃতি।
Leave a comment