উনিশ শতকে রাজা রামমোহন রায়, ডিরোজিও, অক্ষয়কুমার দত্ত, বিদ্যাসাগর প্রমুখ মনীষীর সহায়তায় বঙ্গদেশে যে নবজাগরণের সূচনা হয়েছিল তার সাথে বাঙালি মুসলমান সমাজের কোনো আত্মিক যোগাযোগ ছিল না। ফলে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষা ও শিল্প-সাহিত্যের ক্ষেত্রে মুসলমান সমাজ ছিল অনগ্রসর। অনগ্রসর ও শিক্ষাদীক্ষায় পশ্চাৎপদ বাঙালি মুসলমান সমাজকে মুক্ত ও স্বাধীন পথ দেখানোর প্রয়াসে ১৯২৬ সালের ১৯ জানুয়ারি ঢাকায় ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজে’র আত্মপ্রকাশ ঘটে। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সভাপতিত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলিম হল ইউনিয়ন কক্ষে এর প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম অধিবেশনে ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজে’র কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য পাঁচ জনের উপর দায়িত্ব দেওয়া হয়। এরা হলেন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল হোসেন, মুসলিম হলের ছাত্র এ. এফ.এম আব্দুল লতিফ, ঢাকা ইন্টামিডিয়েট কলেজের ছাত্র আবদুল কাদির ও আনোয়ার হোসেন এবং ঢাকা ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজের ছাত্র আবুযযোহা নূর। এছাড়া কাজী আবদুল ওদুদ, আনোয়ারুল কাদির, কাজী মোতাহার হোসেন, মোতাহের হোসেন চৌধুরী, আবুল ফজল প্রমুখ এ প্রতিষ্ঠানের সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন।

কতকগুলো বিশেষ লক্ষ্যকে সামনে রেখে ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ উনিশ ও বিশ শতকের বাঙালি মুসলমান সমাজে জাগরণ সৃষ্টির প্রয়াস চালায়। এ জন্য প্রথমেই তারা প্রচেষ্টা চালায় অনুন্নত ও অনগ্রসর বাঙালি মুসলমান সমাজের মধ্যে চিন্তার বিস্তার ঘটানোর। মাতৃভাষা নিয়ে যে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিল তা ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজে’র মধ্যেও তর্কবিতর্কের অবতারণা করেছিল। অবশেষে এ বিতর্কের অবসান ঘটে এর তৃতীয় অধিবেশনে; ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বাংলাকে বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষারূপে বলিষ্ঠ কণ্ঠে ঘোষণার মধ্য দিয়ে। অনগ্রসর বাঙালি মুসলমান সমাজকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ মুসলমান সমাজকে শিক্ষার আলোয় উজ্জীবিত করার প্রয়াস পায়। ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজে’র সদস্যবৃন্দ উপলব্ধি করেছিলেন যে, বাঙালি মুসলমান সমাজকে শিক্ষার আলোকে উজ্জীবিত করতে না পারলে শিল্প সাহিত্য তাদের কাছে কোনো অর্থ বহন করবে না। এ জন্য পুরুষের পাশাপাশি নারী শিক্ষার প্রসারেও তারা ব্যাপক প্রচেষ্টা চালায়। নারীদের যথেষ্ট আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও বিংশ শতাব্দীর সামাজিক সংস্কার ও নানাবিধ বিধিনিষেধের কারণে শিক্ষার ক্ষেত্রে নারীরা বেশিদূর অগ্রসর হতে পারেনি।

বাঙালি মুসলমানের অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানের জন্য ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজে’র অন্যতম লেখক মোতাহের হোসেন চৌধুরী কর্মক্ষেত্র সম্প্রসারণের উপর গুরুত্বারোপ করেন। তাঁর মতে, দেশে পর্যাপ্ত শিল্পকারখানা স্থাপন করলেই এ সমস্যার সমাধান সম্ভব। বড়ো বড়ো কলকারখানা স্থাপনের প্রসঙ্গে আলোচিত হয় সমবায় পদ্ধতির কথা। স্বাভাবিকভাবেই সমবায় পদ্ধতির আলোচনায় ব্যাংকিং ব্যবস্থা ও সুদ আদান-প্রদানের কথা উঠে। তবে ধর্মীয় কারণে এ পথে অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানের কথা মুসলমান সমাজ বিশেষভাবে চিন্তা করেনি।
পরিশেষে বলা যায় অনগ্রসর ও অবহেলিত মুসলমান সমাজকে জাগিয়ে তোলার মানসেই ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজে’র আত্মপ্রকাশ। এর সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ মুসলমান সমাজকে শিক্ষাদীক্ষায় আলোকিত করে প্রগতির পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাই বাঙালি মুসলমান সমাজের অগ্রগতি ও উন্নতির পিছনে ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজে’র অবদান অবিস্মরণীয়।

বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ উপরের লেখায় কোন ভুল থাকে তাহলে দয়া করে আমাদেরকে কমেন্ট করে জানাবেন আমরা সেটা ঠিক করে দেওয়ার চেষ্টা করবো, ধন্যবাদ।