মুসলমান অনুপ্রবেশের প্রাক্কালে ভারতের অবস্থা:

৬৪৭ খ্রিস্টাব্দে হর্ষবর্ধনের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে উত্তর ভারতের রাজনৈতিক ঐক্য শিথিল হয়ে পড়ে। হর্ষের সাম্রাজ্য খণ্ড খণ্ড হয়ে যায় এবং সন্নিহিত অঞ্চলসহ পুষ্যভৃতি বংশের শাসনাধীন অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত হয় একাধিক ছোটো ছোটো রাজ্য। ঘটনাচক্রে এই সকল রাজ্য রাজপুত জাতির বিভিন্ন গোষ্ঠী দ্বারা শাসিত হলেও, এদের মধ্যে কোনো রাজনৈতিক ঐক্য ছিল না। পরস্তু সংকীর্ণ গোষ্ঠীস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য এইসব ছোটো ছোটো রাজ্য প্রতিনিয়ত নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে লিপ্ত থেকে পরস্পরের শক্তি ও অর্থক্ষয় করত। বস্তুত, সপ্তম শতকের পরবর্তীকালে এবং দিল্লি-সুলতানির প্রতিষ্ঠার পূর্ব পর্যন্ত ভারতে এমন কোনো কেন্দ্রীয় শক্তির অস্তিত্ব ছিল না, যার নেতৃত্বে ভারতের রাজনৈতিক সংহতি ও শক্তি দানা বাঁধতে পারে। তুলনামূলকভাবে তখন কনৌজ ছিল সর্বাধিক শক্তিশালী ও সম্ভাবনাময় রাজ্য। তবে কেন্দ্রীয় শক্তি হিসেবে ভারতের রাজনৈতিক ঘটনাবলিকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা কনৌজেরও ছিল না, কিংবা অন্যান্য রাজপুত রাজ্যগুলিও জাতীয় স্বার্থে কনৌজের নেতৃত্ব মেনে নিতে আদৌ প্রস্তুত ছিল না।

ভারতে মুসলমান অভিবাসনের সূচনা :

‘আরব ও অন্যান্য সেমেটিক জাতির (ইহুদি, অসিরীয় ইত্যাদি) সাথে ভারতের বাণিজ্যিক যোগাযোগের ঐতিহ্য খুবই প্রাচীন। আরবদেশে ইসলাম ধর্ম প্রসারের পর এই বাণিজ্যিক যোগাযোগ আরও দ্রুত বৃদ্ধি পায়। ভারতীয়রা সমুদ্র অতিক্রম করে (কালাপানি পার হওয়া) বহির্দেশের সাথে বাণিজ্য চালাতে অপারক ছিল। ধর্মীয় সংস্কার থেকে সমুদ্রযাত্রা নিষিদ্ধ ছিল। এই সুযোগ ভারতের বাণিজ্যে বিদেশিদের হাত শক্ত করতে সাহায্য করে। ভারতে ভালজাতের ঘোড়া পাওয়া যেত না। ভারতে আরবী ঘোড়া এবং পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলের মুক্তোর বিশেষ চাহিদা ছিল। অন্যদিকে বিদেশিদের প্রয়োজন ছিল ভারতের রেশমবস্ত্র, তরবারি, চিনি ইত্যাদি। দক্ষিণভারতে রাষ্ট্রকূট শাসকদের আমলে আরব বণিকেরা ভারতে প্রবেশাধিকার ও বাণিজ্য করার সুযোগ পায়। অষ্টম-দশম শতকের মধ্যে দক্ষিণ ভারত ও দাক্ষিণাত্যে মুসলমানদের বহু উপনিবেশ গড়ে ওঠে। একই সময়ে উত্তরদিক থেকেও মুসলমানদের আগমন ঘটেছিল। তবে সুলতান মামুদের (গজনী) অভিযানের পর ব্যাপক হারে মুসলিম অনুপ্রবেশ ঘটতে থাকে। উল্লেখ্য যে, সুলতান মামুদের ক্রিয়াকলাপ (লুঠপাঠ, মন্দির ধ্বংস ইত্যাদি) ভারতে তাৎক্ষনিকভাবে মুসলমানদের গ্রহণযোগ্যতার পক্ষে অনুকূল হয় নি। অলবেরুনী দুঃখ করে লিখেছিলেন যে, ‘সুলতান মামুদের ভারত অভিযান হিন্দু মনে এতটাই ঘৃণার উদ্রেক করেছিল যে, দু’টি গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক মিলন অত্যন্ত সুকঠিন হয়ে পড়ে।

সুলতান মামুদের ভারত অভিযানের প্রায় দু’শতক পরে মুসলমান উদ্বাস্তুরা এদেশে যথেষ্ট সমাদরের সাথে গৃহীত হন। দশম-দ্বাদশ শতকে মধ্যএশীয় রাজনীতির অস্থিরতা এই প্রসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এই সময় উপজাতীয় সেলজুক তুর্কিদের পুনঃপুনঃ আক্রমণে পারস্য সহ মধ্য এশীয়ার মুসলিম জনগোষ্ঠীর জীবন সম্পূর্ণ নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়েছিল। সুলতান মামুদের রাজত্বের শেষ দিকে এবং তাঁর পুত্র মাসুদের আমলে সেলজুক তুর্কিদের আক্রমণে বিধ্বস্ত হয়ে ভারতে মুসলমানদের অনুপ্রবেশ ঘটতে থাকে। স্বয়ং সুলতান মাসুদ ভারতে পালিয়ে আত্মরক্ষা করতে বাধ্য হয়েছিলেন। এই সময় পাঞ্জাব অঞ্চলে ব্যাপক সংখ্যায় মুসলমানদের অভিবাসন ঘটে। একাদশ শতকের গোড়ায় সেলজুক সাম্রাজ্য অস্থিরতা মুক্ত হলে অভিবাসন প্রক্রিয়া শিথিল হয়। দ্বাদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে তুর্কিস্থানের পরিস্থিতি পুনরায় জটিল হয়ে ওঠে। সুলতান সনজর (Sanjar) নিজেই ঘুজ তুর্কের হাতে বন্দী হয়ে পড়েন। এই সময় আবার অধিক সংখ্যায় মুসলমানরা ভারতে প্রবেশ করতে থাকেন এবং উত্তর-পশ্চিম অংশে বসবাস শুরু করেন।

অভিবাসী মুসলমানরা হিন্দু রাজাদের অধীনে বসবাস করার সুযোগ পান। ঐতিহ্য অনুযায়ী ভারতীয় সমাজ মুসলমানদের উদ্যোগ ও উৎসাহে স্থানীয় হিন্দু অধিবাসীরাও ব্যবসা-বাণিজ্যে নিয়োজিত হতে থাকেন। মুসলমানদের চেষ্টায় পাথর ছোঁড়ার যন্ত্র ‘মুঞ্জানিক’ এদেশে জনপ্রিয়তা পায়। এছাড়া চিনদেশ থেকে শেখা কাগজ তৈরির প্রযুক্তিও মুসলমানদের মাধ্যমে ভারতে চলে আসে। বস্তুত মহম্মদ ঘুরীর আক্রমণের আগেই ভারতে মুসলমান অভিবাসীরা তাদের সংস্কৃতি সহ ভারতীয় সমাজের অংশ হয়ে গিয়েছিলেন।