ইংল্যান্ডের সাহিত্য গগনে উজ্জ্বলতম নক্ষত্র শেক্সপীয়রের পরেই যাঁর নাম উল্লেখযোগ্য, তিনি হচ্ছেন মিল্টন (১৬০৮-৭৪ খ্রিঃ)। জন্মস্থান লন্ডন। কাল ৯ ডিসেম্বর ১৬০৮ খ্রিস্টাব্দ। সাহিত্য ও শিল্পের প্রতি মিল্টনের পিতার ঐকান্তিক অনুরাগ ছিল। কাজেই বাল্যে বিদ্যাচর্চার ক্ষেত্রে বাড়ি থেকে তিনি উৎসাহ পেয়েছেন। বাল্যে স্কুলে পঠন-পাঠন কালেই রাত জেগে তিনি পড়াশুনো করতেন, পাঠ্যজীবনের পরেও তাঁর সে অভ্যাস অক্ষুণ্ণ ছিল। ১৬৩২ খ্রিস্টাব্দে কেমব্রিজ থেকে এম. এ. পাশ করার পর তাঁর ছাত্রজীবনের একটা পর্যায় শেষ হয়। তারপর নিরালা গৃহকোণে চলে তাঁর প্রস্তুতির তপস্যা, দ্বিতীয় ছাত্রজীবন। বাড়ির অবস্থা স্বচ্ছল ছিল বলে অসুবিধে হয়নি। গ্রীক, ল্যাটিন, ইউরোপের অনেকগুলি ভাষা এমনকি হিব্রুও গভীর নিষ্ঠা ও অনুরাগের সঙ্গে তিনি শিক্ষা করেন। একদিকে যেমন তিনি অসামান্য পাণ্ডিত্য অর্জন করেছিলেন, তেমনি অন্যদিকে নিষ্ঠার সঙ্গে কাব্যেরও অনুশীলন করেছিলেন। সঙ্গীতেও তার গভীর অনুরাগ ও দক্ষতা ছিল। গৃহকোণে এই নিভৃতবাস তার সাধনার অনুকূল হয়েছিল।
এরপর এই নির্জনবাস পরিত্যাগ করে তিনি ইউরোপ ভ্রমণে বহির্গত হলেন। ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড, ইটালি— সর্বত্রই তিনি পাণ্ডিত্যের জন্য স্বীকৃতি পান। এই সময়ে ফ্লোরেন্সে কারারুদ্ধ গ্যালিলিওর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছিল। গ্রিসে যাবার পথে তিনি দেশের রাজনৈতিক গোলযোগের সংবাদ পান। এই সময়ে ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম চার্লস-এর সঙ্গে পার্লামেন্ট-এর বিরোধ আরম্ভ হয়। তারপরেই শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। মিল্টন চিরদিন আদর্শবাদী জনগণের অধিকার রক্ষায় সচেষ্ট। তিনি দেশে ফিরলেন এবং সাধারণ মানুষের মুক্তির দাবী নিয়ে দাঁড়ালেন। রাজতন্ত্রের পক্ষপাতীরা এতকাল বলতেন, ভগবানের দেওয়া অধিকার বলে রাজা রাজ্য শাসন করেন, কাজেই রাজদ্রোহ পাপ। মিল্টন দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করলেন রাজারাও সকল মানুষের মতো চিরন্তন বিশ্ববিধানের অধীন, প্রজাদের আত্মরক্ষার অধিকারও ভগবদদত্ত। অন্যায়কে স্বীকার করা কাপুরুষতা মাত্র। সেদিন ক্রমওয়েলের নেতৃত্বে ইংল্যান্ডের জনসাধারণ বিদ্রোহ করেছিল এবং তাদের হাতে প্রথম চার্লস নিহত হয়েছিলেন (১৬৪৯ খ্রিঃ)। রাজনৈতিক সংগ্রামে জড়িয়ে পড়ে দীর্ঘকাল রাজনৈতিক বাদ-প্রতিবাদে এবং জাতিকে জাগাবার সাধনায় ব্যাপৃত থাকায় তিনি কাব্যরচনায় মন দিতে পারেন নি। এই সময়ের রচনা সবই গদ্য এবং সাময়িক ব্যাপার নিয়ে লেখা রাজনৈতিক রচনা হলেও ভাবের ও আদর্শের দিক থেকে মূল্যবান।
সাংসারিক জীবন মিল্টনের খুব সুখের ছিল না। তাকে অনেক দুঃখ-কষ্ট সইতে হয়েছে। তবে অসাধারণ ধৈর্যের সঙ্গে তিনি সমস্ত মেনে নিয়েছেন। তিনি পর পর তিনবার বিবাহ করেন। তাঁর প্রথমা স্ত্রীর সঙ্গে বিবাহের অল্পদিন পরেই বিচ্ছেদ ঘটেছিল। দ্বিতীয়া স্ত্রী অল্পদিন পরেই মারা যান। তৃতীয়বার যখন তিনি বিবাহ করেন তখন তিনি অন্ধ। দৃষ্টিহীন অন্ধকার জীবনে তৃতীয়া স্ত্রীর সেবা তিনি কিছুকাল ভোগ করতে পেরেছিলেন। তাঁর জীবিত সন্তানদের মধ্যে সবকটিই মেয়ে, জীবনের শেষ কয়েক বছর তাঁর কাটে গ্রামের বাড়িতে। ১৬৪৪ খ্রিস্টাব্দ থেকেই মিল্টনের চোখের অসুখ শুরু হয়েছিল। ১৬৫২ খ্রিস্টাব্দে তিনি পুরোপুরি দৃষ্টিশক্তিহীন হয়ে পড়লেন। বাইরের দিক থেকে তাঁর উপরে যতই আঘাত এসেছে ততই তিনি অন্তর্মুখী হয়ে পড়েছেন। এই অন্ধত্বের ফলে তার বাইরের জগতের রূপ রস হারিয়ে গেলেও তাঁর মনের আলো যেন আরও প্রজ্বলিত হল। কবি ও সাধক সুরদাসের মতোই অন্তর আলোর অনির্বাণ জ্যোতিতে তাঁর মনোজগৎ হয়ে উঠল ভাস্বর। এই সময়ের অসহায় জীবনচিত্র কতকটা প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর নাট্যকাব্য ‘স্যামসনস্ অ্যাগোনিস্টিস’ (Samson’s Agonistes) গ্রন্থে। এই অন্ধ অবস্থাতেও তাঁর কাব্যরচনা অব্যাহত ছিল। তিনি বলে যেতেন, অন্য কেউ লিখে দিত। কবির জীবনের তিনটি অবিনশ্বর কীর্তি ‘প্যারাডাইস লস্ট’ (Paradise Lost. 1667) ‘প্যারাডাইস রিগেইণ্ড’ (Paradise Regained, 1671) এবং ‘স্যামসনস্ অ্যাগোনিস্টিস’ (১৬৭১) এই সময়েরই লেখা।
এই নিয়মনিষ্ঠ, কর্তব্যপরায়ণ, নৈতিক বুদ্ধিতে দৃপ্ত, ধর্মে অবিচল মানুষটি সম্পর্কে ওয়ার্ডসওয়ার্থ লিখেছিলেন—
“With his rosy cheeks.
Angelical, keen eye, courageous look,
And conscious step of purity and pride.”
জীবনের প্রথম প্রভাত থেকে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত ভগবানের প্রতি বিশ্বাস তিনি কোনোদিনই হারান নি।
Leave a comment