বাংলা কবিতার সাম্প্রতিক কবিগণের মধ্যে সম্ভবত সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী ও মানস বৈশিষ্ট্য সর্বাপেক্ষা গতিময় কবি জয় গোস্বামী। জয় গোস্বামীর কবিতা আধুনিক বাংলা কবিতাকে দিল নতুনতর মাত্রা। এই নবীনতার মূল বীজমন্ত্র, প্রকৃতপক্ষে প্রেম। যুদ্ধোত্তর পর্বের আধুনিক কবিতার নৈরাশ্যবাদ এবং উত্তর-আধুনিক পর্বের নৈরাজ্যবাদ অতিক্রম করে জয় গোস্বামী বাংলা কবিতায় সঞ্চারিত করলেন প্রেমের নতুন সঞ্জীবন মন্ত্র।

জয় গোস্বামীর কবিতার প্রধানতম বিষয় প্রেম। কোনো সংকীর্ণ জৈবিক অর্থে নয়, তাঁর কবিতায় প্রেম এসেছে বৃহত্তর অর্থেই। মোট কথা, নরনারীর যৌবনচঞ্চল প্রেমবাসনার মধ্যে জয় যেমন শুনতে পান সমস্ত প্রতিকূলতা ও শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থার মধ্যেও প্রাণের নবীন উল্লাস, তেমনি স্বপ্নভাঙা লক্ষ লক্ষ হতদরিদ্র, পীড়িত, লাঞ্ছিত মানুষের বেঁচে থাকার নিরন্তর সংগ্রামের মধ্যেও তিনি দেখেন জীবনপ্রেমের অপরাজেয় উৎসার। এই আলোহীন ভবিষ্যৎহীন পৃথিবীতে প্রেমের এই আলোই কবিকে চিনিয়ে দেয় বেঁচে থাকার মানে। প্রেমানুভবের এই তাৎপর্য ব্যাখ্যা করে এক স্থানে জয় গোস্বামী বলেছেন—“প্রেমেই তো মনে হয় আবার নতুন করে জন্মালাম। মানুষ তখন তার পার্থিব অসংগতি, তার সাংসারিক তুচ্ছতা, তার অর্থাভাব, সব কিছুর ঊর্ধ্বে উঠে যায়। অহংকার আলো করে রেখে দেয় তাকে, যতই তার জামা মলিন হোক না কেন। সন্ধ্যা হতে দেয় না সেখানে। কে দেয় না? প্রেম।”

জয় গোস্বামীর ‘মালতীবালা বালিকা বিদ্যালয়’ কবিতাটিও আসলে প্রেমেরই কবিতা। সে কারণে মূলত ‘আজ যদি আমাকে জিজ্ঞাসা করো’ কাব্যগ্রন্থের কবিতা হলেও ‘প্রেমের কবিতা’ নামক সংকলনেও কবিতাটি স্থান পায়। তবে আধুনিক আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় প্রেমের বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হয়। একান্ত মানবিক এই বোধ, এই জৈবিক স্বপ্নাকাঙ্ক্ষা হয়তো এই প্রতিকূলতার মধ্যে নিহত হয় অকালেই। আলোচ্য কবিতাটিকেও বলা চলে সেইরকমই এক নিহত-প্রেমের কবিতা। এক প্রেমবঞ্চিতা নারীর স্বপ্নহীন প্রাত্যহিক দিনযাপনের স্থূলতার মাঝখানে এখানে শুধু প্রকাশিত হয়েছে অনিঃশেষ প্রেমেরই আর্তি।

প্রকৃতপক্ষে ‘মালতীবালা বালিকা বিদ্যালয়’ কবিতাটির মধ্যে যেন লুকিয়ে আছে এক সার্থক ছোটোগল্পের আভাস। জয় গোস্বামীর অনেক কবিতাকেই এই শ্রেণিভুক্ত করা যেতে পারে। রবীন্দ্রনাথের পুনশ্চ কাব্যগ্রন্থের অনেকগুলি কবিতায় এই রকম আখ্যানের আভাস আছে।

‘মালতীবালা বালিকা বিদ্যালয়’-এর আখ্যানটি আসলে নিহত-প্রেম এক কালো মেয়ের আত্মকথন। কিশোরী বয়সে নবম শ্রেণিতে পড়াকালেই বয়ঃসন্ধির স্বাভাবিক নিয়মেই তার মনে জেগেছিল প্রেমের স্বপ্ন। মালতীবালা বালিকা বিদ্যালয়ের ক্লাসরুমে ডেস্কে বসে অঙ্ক করতে করতেই সে দেখতে পেত ‘বাইরে দিদিমণির পাশে দিদিমণির বর।’ শিক্ষিকার দাম্পত্য জীবনের এইটুকুমাত্র ঘনিষ্ঠ জীবনের চিত্রই তার মনে এক মধুর প্রেমাকাঙ্ক্ষার স্বপ্ন বুনে দিত। সেই স্বপ্ন পূরণের সম্ভাবনা দেখা দিল শহর থেকে গ্রাম বা গঞ্জটিতে বেড়াতে আসা বেণীমাধবকে ঘিরে। কিন্তু বেণীমাধবকে ভালোবাসার তীব্র এক আকাঙ্ক্ষা জাগলেও একটা মানসিক বাধাও মেয়েটিকে ঘিরে থাকে। তার মধ্যে প্রথমত কিশোরী বয়সের বা বয়ঃসন্ধিকালের লজ্জা তো ছিলই। দ্বিতীয়ত, সাধারণ মেয়েটি সেই কিশোরী বয়সেই বুঝে গিয়েছিল মানগত নিরিখে বেণীমাধব তার থেকে অনেক উঁচুতে—“বেণীমাধব, বেণীমাধব, লেখাপড়ায় ভালো।” তৃতীয়ত, আর্থিক সঙ্গতির পার্থক্যটাও তখনই অনুভব করেছে ষোলো বছরের নবম শ্রেণির কিশোরীটি—“আমার বাবা দোকানে কাজ করে।”

কিন্তু যৌবনের স্বপ্ন কোনো প্রতিবন্ধকতাকেই স্বীকার করতে চায় না। কিশোরী মেয়েটির বাবা দোকানে কাজ করলেও যৌবনের উদ্‌গমকে সেই দারিদ্র্য ঠেকিয়ে রাখতে পারে না; পারে না প্রেমের স্বপ্নকেও অবদমিত করে রাখতে। তাই—“কুঞ্জে অলি গুঞ্জে তবু, ফুটেছে মঞ্জুরী।” মনের মধ্যে যৌবনের তমাল তরুমূল থেকে ভেসে আসে যে প্রেমের বাঁশির আহ্বান, সেই নাছোড় ডাকের তাড়নাতেই পড়াশোনায় মন বসে না তার, অঙ্ক কষতে ভুল হয়ে যায় বারবার। সুলেখাদের বাড়ি আলাপ হয় বেণীমাধবের সঙ্গে, ব্রিজের ধারে লুকিয়ে দেখা হয়।

অনেকদিন পর সেই কিশোরকালের প্রেম রোমাঞ্চের কথা কেবল স্মৃতি হয়ে ভাসে মেয়েটির মনে। বাস্তব জীবন সেই মধুর স্মৃতিটুকু ছাড়া সেই রোমাঞ্চকর প্রেমের কোনো অবশেষ রাখেনি। বেণীমাধব পেয়ে গেছে রূপে গুণে উপযুক্ত অন্য সঙ্গিনী। মেয়েটির জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছা হয়, নতুন এই বান্ধবীটিকে বেণীমাধব তার কথা বলেছে কিনা। এ ইচ্ছা নিশ্চয়ই অবাঞ্ছিত, অসঙ্গত, অবাস্তব। বেণীমাধবের এই নতুন প্রেমজীবন সম্পর্কে আসলে কোনো অভিযোগ নেই মেয়েটির। কিন্তু দুজনকে ‘মানিয়েছিল ভালো” এই স্বীকারোক্তি এবং ওদের ভালো হোক’ বলে কল্যাণ কামনার অন্তরালে প্রেমবঞ্চিতা মেয়েটির রক্তাক্ত হৃদয়ের যন্ত্রণা ও কুলপ্লাবী অশ্রু অগোচর থাকে না পাঠকের।

দারিদ্র্য ও প্রাত্যহিক জীবন সংগ্রামের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে আজ দিন কাটে মেয়েটির। দারিদ্র্যের চাপেই ছোটো বোনটি হারিয়ে গেছে চোরাপথের বাঁকে। পাড়ার সেলাই দিদিমণি হিসাবে কোনোক্রমে গ্রাসাচ্ছাদনের সংস্থান করে দিন চলে তার। কিন্তু ভবিষ্যৎ কি, তার জানা নেই— 

“আজ জুটেছে, কাল কি হবে? কালের ঘরে শনি,

আমি এখন এই পাড়ার সেলাই দিদিমণি।”

মনের তীব্র ক্ষোভ, বঞ্চনার তীব্র যন্ত্রণা আগুন হয়ে ঝরে পড়তে চায়। কিন্তু সেই প্রতিবাদ বা ক্ষোভ অদ্ভুত এক অবসাদের তলায় চাপা পড়ে থাকে, জ্বলে না—

“তবু আগুন, বেণীমাধব, আগুন জ্বলে কই?”

এই প্রেমবঞ্চনার যন্ত্রণা ও দারিদ্র্যের সঙ্গে প্রতিনিয়ত লড়াই করতে করতে ‘নষ্ট মেয়ে’ হয়ে যাবার আশঙ্কাও হয়তো উকি দেয় তার মনের গভীরে।

হয়তো এই নিজেকে নষ্ট ভ্রষ্ট করে দেবার মধ্য দিয়েই—এই আত্মহননের মাধ্যমেই সে প্রতিশোধ নিতে চায় বেণীমাধরের উপর। মনে হয় যেন, প্রেমবঞ্চিতা রাধা যেমন করে কৃষ্ণের উপর প্রতিশোধ নিতে চেয়ে বলেছিলেন—

“বঁধু যদি তুমি মোরে নিদারুণ হও,

মরিব তোমার আগে দাঁড়াইয়া রও।”

ঠিক তেমনিভাবে নষ্ট হয়ে যাবার সব দায় যদি গিয়ে পড়ে বেণীমাধবের উপর, তাহলেই বঞ্চনার যোগ্য প্রতিশোধ নেওয়া হবে বলে মনে হয় মেয়েটির—

কেমন হবে, আমিও যদি নষ্ট মেয়ে হই?”

স্বভাবতই ‘মালতীবালা বালিকা বিদ্যালয়’ কবিতাটিতে একটি প্রেমবঞ্চিতা নারীর তীব্র প্রেমের আকুতিটিই আত্মকথনের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত। আশ্চর্যভাবে লক্ষ করতে হয়, রবীন্দ্রনাথের ‘সাধারণ মেয়ে’ কবিতার সেই মালতী নামের প্রেমবঞ্চিতা মেয়েটির সঙ্গে আলোচ্য কবিতার নামহীনা মেয়েটির যেন আশ্চর্য মিল। তবে মালতীর প্রতিশোধ স্বপ্ন যতটা উগ্ররূপে ‘সাধারণ মেয়ে’ কবিতায় প্রকাশিত, জয়ের কবিতায় সেই উগ্র প্রতিশোধস্পৃহা অনুপস্থিত। কেননা, বেণীমাধবের বাড়ি যাবার আক্ষরিক অর্থ তার কাছে আজ অবাত্তর হয়ে গেছে, ব্যক্তি বেণীমাধবেরও কোনো মূল্য আর নেই তার কাছে। শুধু নৈর্ব্যক্তিক এক প্রেমতৃষ্ণার প্রতীক হিসাবে তার মনের গভীরে আজ বেণীমাধবের উপস্থিতি, তোমার বাড়ি যাবো’ বলে ব্যাকুল উচ্চারণে সেই প্রেমতৃষ্ণার অভিব্যক্তি ঘটে মাত্র।