রবীন্দ্রনাথের এক নিতান্ত ‘সাধারণ মেয়ে’ ‘মালতী’ একদিন তার ‘কাঁচা বয়সের মায়া’য় একজনের মন ছুঁয়েছিল। কিন্তু কপাল ভালো তার। তার এই ভাঙা কপাল নিয়ে কোনো এক বেণীমাধবের স্মৃতি স্বপ্নে বিভোর হয়ে সে হাজির হল কবি জয়গোস্বামীর ‘আজ যদি আমাকে জিজ্ঞেস করো’ (১৯৯১) কাব্য গ্রন্থের ‘মালতীবালা বালিকা বিদ্যালয়ের প্রাঙ্গনে।
সে বলে চলেছে বেণীমাধব সম্পর্কিত নিজের ট্র্যাজিক জীবন কাহিনি। এ কাহিনি বৈষ্ণবীয় রাধার পুর্বরাগ, অনুরাগ, আক্ষেপানুরাগ, বিরহের মতোই মালতীর প্রেমের দুঃখের পর্বভিত্তিক পদাবলী।
মেয়েটি পরিণত বয়সের। First Sight-এই সে শহর থেকে বেড়াতে আসা লেখাপড়া জানা বেণীমাধবকে ভূষিত পরাণে ভালোবেসেছিল। তখন সে স্কুলে ডেস্কে বসে অঙ্ক করে। ছোট্ট ক্লাসঘর। সেখানেই তার অঙ্কের খেলাখেলি। ইতিমধ্যেই তার কর্ণকুহরে এক অজানা মরণ বাঁশির সুর মোহনবাঁশি হয়ে প্রবেশ করে—এ শ্রবণ জাত পূর্বরাগ ; স্বপ্নদর্শন নয়-প্রখর বাস্তব। রবীন্দ্রনাথের একটি গানে আছে—
“এখনো তারে চোখে দেখেনি
শুধু বাঁশি শুনেছি
মন প্রাণ যাহা ছিল
দিয়ে ফেলেছি।”
মন-প্রাণ দেওয়া হল ষোলো বছরের নায়িকারও। তার চোখে তখন রক্তিম স্বপ্ন। এ স্বপ্নে আবার রং চড়িয়েছে ‘দিদিমনির পাশে দিদিমনির বর’-এর মিষ্টি উপস্থিতি। আসলে তার তো শাড়ি পরবার বয়স। রোমাঞ্চকর অনুভূতির জগতে বসবাসের সময়, লজ্জা রাঙা আবেগে ভাসবার সময়। এ সময়েই তো মানায় ভালো লাগার মানুষটিকে এক পলক দেখে দৌড়ে পালিয়ে অন্য কোথাও লুকানো—
“তোমায় দেখে এক দৌড়ে পালিয়ে গেছি ঘরে
বেণীমাধব, আমার বাবা দোকানে কাজ করে।”
আর্থিক দিক থেকে সে হয়তো বেণীমাধবের তুলনায় অনেকটা পশ্চাদ্বর্তী। তবুও তো তাকে ভালো লেগেছে। তাই—
“কুঞ্জে অলি গুঞ্জে তবু ফুটেছে মঞ্জরি
সন্ধ্যা বেলা পড়তে বসে অঙ্কে ভুল করি।”
রতি সুখ অভিলাষে বয়সের ধর্মেই ব্রীজের ধারে লুকিয়ে বেণীমাধবের সঙ্গে তার দেখা। পূর্বরাগের পর্যায় উত্তীর্ণ হয়ে এবার গাঢ় অনুরাগের পর্যায়। তাই ষোড়সী কিশোরীর উচাটনমন আর ঘরে রয় না। শরীরে শিহরণ, হৃদয়ে উন্মাদনা। বেণীর মোহন বাঁশি শোনবার জন্য কান তার তীব্র সচেতন। বিপ্লব চক্রবর্তীর মতে—“মুক্ত ব্যঞ্জনের অনুপ্রাস অলির গুঞ্জনের মতো ধ্বনিময় হয়ে উঠেছে। এই ধ্বণিময়তা মোহনবাঁশির সুরে বিমোহিতা কিশোরীর মনের ভাব মগ্নতার দ্যোতক হয়ে উঠেছে।
সুলেখাদের বাড়ি যার সঙ্গে পরিচয়, যাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখার একদিন শুরু, যাকে নিয়ে ভালোবাসাবাসি কোন এক অলিখিত বজ্রপাতে তার সেই ভালোবাসার স্বপ্নরাজ্যের ভাঙন। ‘সুখর লাগিয়া” য়ে ঘর সে বেঁধেছিল অনলে ‘ই তা হঠাৎই পুড়ে গেল। জীবনের কোনও এক পৃষ্ঠার অঙ্ক মেলাতে গিয়ে তার সেও কথা মনে পড়ে এ মনে পড়া তার স্বাভাবিক কিন্তু বেণীমাধবের কি তা মনে পড়ে? সে কি সত্যিই তার বর্তমান প্রেমিকাকে এ কথা চলেছে?
“বেণীমাধব, বেণীমাধব, এতদিনের পরে
সত্যি বলো, সেসব কথা এখনো মনে পড়ে?
সেসব কথা বলেছ তুমি তোমার প্রেমিকাকে?”
—এ তার আক্ষেপজাত ক্ষেদোক্তির প্রাথমিক প্রকাশ। সে কালো, তার বাবা দোকানে কাজ করে। তবুও তো বেণীমাধব তাকে ভালোবেসেছিল। তবে কেন আজ তাকে ফেলে যাওয়া! এই অনুভবের যন্ত্রণাজাত অশ্রুজলের মনস্তাত্ত্বিক ভিত্তিই এ কবিতা।
Leave a comment