মার্কসীয় তত্ত্বে ভিত্তি এবং উপরিসৌধের প্রসঙ্গ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ হিসেবে বিবেচিত হয়। মার্কসীয় রাজনীতিচর্চার অতি পরিচিত পদ্ধতি ঐতিহাসিক বস্তুবাদ প্রসঙ্গেই এই ভিত্তি-উপরিসৌধের আলোচনা করা হয়। বস্তুবাদী হিসেবে মার্কসের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় সমাজের ভিত্তি হচ্ছে অর্থনৈতিক কাঠামো বা উৎপাদন পদ্ধতির ওপর নির্ভর করেই রাজনৈতিক উপরিকাঠামো বা রাষ্ট্র, তার নানা প্রতিষ্ঠান এবং সর্বোপরি সামাজিক চৈতন্য গড়ে ওঠে। সমাজকে অনুধাবন করতে মার্কস এবং এঙ্গেলস এই ধরনের যে স্থাপত্য শৈলীর উপমা দিয়েছেন তার প্রথম প্রকাশ লক্ষ্য করা যায় জার্মান আইডিওলজির প্রথমভাগে। এখানে মার্কসের মন্তব্য এই যে সামাজিক সংগঠনগুলির উৎস হচ্ছে সরাসরি সংশ্লিষ্ট সমাজের উৎপাদন ব্যবস্থা। পৃথিবীর সমস্ত ধরনের সামাজিক ব্যবস্থাতেই রাষ্ট্র এবং তৎসংশ্লিষ্ট সবকিছুই যেমন রাজনৈতিক তত্ত্ব ইত্যাদির উৎস খুজতে হবে অর্থনীতির মধ্যে। অর্থনীতি তথা উৎপাদন সম্পর্কই সমাজের জীবনযাত্রা, ধ্যান-ধারণা, বিশ্বাস ইত্যাদি সবকিছুর নির্ধারক।
রাজনীতিকে অনুধাবন করার এই পদ্ধতি সমসাময়িক কালে প্রচলিত অন্য সমস্ত ইতিহাস/রাজনীতিক পদ্ধতিগুলি থেকে আলাদা বলে দাবী করা হয়। এর মূল বক্তব্য হচ্ছে সামাজিক উপরিকাঠামোগত উপাদানগুলি স্বশাসিত বা স্বয়ংক্রিয় নয়, সামাজিক পরিস্থিতি-নিরপেক্ষ অবস্থায় এগুলির আবির্ভাব ঘটেনি। উৎপাদন সম্পর্কের মধ্য দিয়েই এই উপাদানগুলির সৃষ্টি এবং অর্থনৈতিক ভিত্তিতে কোন পরিবর্তন এলে উপরিকাঠামোগত উপাদানগুলিতেও পরিবর্তন আসে। এই প্রসঙ্গে এটা উল্লেখ করা প্রয়োজন যে মার্কস এই দ্বি-স্তর ভিত্তিক ইতিহাস পদ্ধতির সবচেয়ে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দিয়েছেন কনট্রিবিউসন টু দি ক্রিটিক অফ পলিটিকাল ইকনমি তে। এখানে ভিত্তি-উপরিসৌধের উপমার সবচেয়ে বিস্তৃত ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে। এই ব্যাখ্যাকে বিশ্লেষণ করলে মূল কয়েকটি বক্তব্যকে চিহ্নিত করা যায়।
-
ইতিহাসের প্রত্যেক নির্দিষ্ট পর্যায় গড়ে ওঠে নির্দিষ্ট উৎপাদন পদ্ধতিকে উপজীব্য করে। যেমন দাস ব্যবস্থা, সামস্ততন্ত্র বা পুঁজিবাদ গড়ে উঠেছে ভিন্ন ভিন্ন উৎপাদন পদ্ধতি অনুযায়ী।
-
প্রত্যেক উৎপাদন ব্যবস্থায় জীবনযাপন বা বেঁচে থাকার রসদ আরোহণের পথ নির্দিষ্ট। প্রত্যেক সমাজে উৎপাদন পদ্ধতি, জীবন যাপনের রসদ জোগাড়ের পথ নির্ধারিত হয়েছে নির্দিষ্ট সামাজিক সম্পর্কের দ্বারা। অর্থাৎ প্রত্যেক সমাজ ব্যবস্থায় শ্রমদানকারী মানুষজনের সঙ্গে উৎপাদনের নিয়ন্ত্রণকারী মানুষজনের মধ্যে গড়ে উঠেছে নির্দিষ্ট সামাজিক সম্পর্ক।
-
এই সামাজিক সম্পর্কের নিরিখেই নির্দিষ্ট সামাজিক-রাজনৈতিক উপরিকাঠামোগত উপাদানগুলিকে গড়ে উঠতে দেখা যায়। সংক্ষেপে বলতে গেলে মার্কসীয় ভিত্তি উপরিকাঠামো-তত্ত্বের মূল দাবী হচ্ছে একটি সমাজের মানুষজনের বেঁচে থাকার তাগিদ, প্রচেষ্টা পদ্ধতিই শেষবিচারে সেই সমাজের রাজনীতি-সংস্কৃতির নির্ধারক।
এই বেঁচে থাকার যাবতীয় তাগিদ বা উৎপাদন পদ্ধতির মধ্যে রয়েছে উৎপাদন শক্তি এবং উৎপাদন সম্পর্ক একযোগে। উৎপাদন শক্তি বলতে বোঝায় উৎপাদনকার্যে নিয়োজিত যন্ত্রপাতি, প্রাকৃতিক সম্পদ, শ্রমজীবি গোষ্ঠী এবং তাদের দক্ষতা। উৎপাদন সম্পর্ক হচ্ছে উৎপাদন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এর সঙ্গে যুক্ত মানুষজনের মধ্যে গড়ে ওঠা সম্পর্ক বা শ্রেণী সম্পর্ক। অর্থাৎ নির্দিষ্ট সমাজব্যবস্থায় নির্দিষ্ট ধরনেরই উৎপাদন সম্পর্ক গড়ে উঠে, যেমন দাসব্যবস্থায় গড়ে উঠে দাস মালিক / দাস সম্পর্ক; সামন্ততন্ত্রে সামন্তপ্রভু / প্রজা সম্পর্ক এবং পুঁজিবাদে পুঁজিমালিক / শ্রমিক সম্পর্ক। এইভাবে প্রত্যেক সমাজে প্রত্যেকের শ্রেণী/ সামাজিক অবস্থান নির্ধারিত হয় উৎপাদন প্রক্রিয়ায় তার অবস্থানের দ্বারা। এই শ্রেণী সম্পর্কের নিরিখেই যাবতীয় উপরিকাঠামোগত বিন্যাস গড়ে ওঠে। মার্কস তাঁর ঐতিহাসিক বস্তুবাদ তথা ভিত্তি উপরিকাঠামোর তত্ত্বকে উপস্থাপিত করেছেন ইতিহাসের বিজ্ঞান হিসেবে। জার্মান আইডিয়লজি থেকে শুরু করে পরবর্তী সমস্ত প্রধান লেখায় মার্কস-এঙ্গেলস এই পদ্ধতি প্রয়োগ করছেন। তাঁদের মতে ভিত্তি এবং উপরিকাঠামোর সম্পর্ক কিন্তু পারস্পরিক, উপরিকাঠামোগত উপাদানগুলি একদিকে যেমন অর্থনৈতিক ভিত্তির প্রতিফলন ঘটায়, অন্য দিকে ভিত্তির সমর্থনে যাবতীয় মতাদর্শগত-প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি (legitimises)-ও আদায় করে। আবার অন্যদিকে আর্থনীতিক ভিত্তি উপরিকাঠামোকে নিয়ন্ত্রণ করে, নির্ধারণ করে। কার্য-কারণের এক অমোঘ সূত্রে বাঁধা এই দুটি স্তরের পারস্পরিক সম্পর্কের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অর্থনৈতিক নির্ধারণবাদ। মানব সমাজের, ইতিহাসের, রাজনীতি-সংস্কৃতির যাবতীয় অনুসন্ধানের চাবিকাঠি রয়েছে এই ভিত্তি-উপরিকাঠামোর পরম্পরার মধ্যে। এই কারণেই এই তত্ত্বকে অনেক সময় ‘প্রতিফলন তত্ত্ব’ বলা হয়। কারণ অর্থনীতির জগতে যাই ঘটনা ঘটুক তার অনুরণন ঘটে উপরিকাঠামোর মধ্যে। তাই রাজনীতির জগতের যাবতীয় ঘটনা, তত্ত্ব মতাদর্শের মূল হদিশ পাওয়া যাবে অর্থনীতির জগতে। ক্যাপিটালের তৃতীয় খণ্ডে মার্কস মন্তব্য করেছেন যে সামাজিক উৎপাদন ব্যবস্থার মধ্যেই সমাজ রাজনীতির যাবতীয় রহস্যের সমাধান মিলবে। পরবর্তী কালে অ্যান্টিদ্যুরিঙ-এও এঙ্গেলস সমাজ-রাজনীতির অনুধাবন করার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট উৎপাদন ব্যবস্থাকে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করার কথা বলেন।
তবে ভিত্তি উপরিকাঠামোর তত্ত্বের নিরিখে ইতিহাস রাজনীতির যাবতীয় ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে যে ‘অর্থনৈতিক নির্ধারণবাদের’ বিপদ রয়েছে সে সম্পর্কে মার্কস বা এঙ্গেলস সচেতন ছিলেন। মার্কস মন্তব্য করেছেন যে উপরিকাঠামোগত উপাদানগুলিকে অর্থনৈতিক ভিত্তির নির্বাক প্রতিফলন বলে দেখা উচিত নয়, বরং ভিত্তির ওপরও উপরিকাঠামোর খানিকটা প্রভাব পড়ে। এই দুইটি স্তরের মধ্যে যে দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক রয়েছে তার উল্লেখ আমরা পাই নানা লেখায় এবং ব্যক্তিগত চিঠিপত্রে। ফ্রান্সে তৃতীয় নেপোলিয়নের অভ্যুত্থান এবং কর্তৃত্ব নিয়ে লেখা এইটিনথ ব্রুমেয়ার অফ লুই বোনাপার্ট গ্রন্থে মার্কস মন্তব্য করেছেন যে ইতিহাস রাজনীতির বিশেষ সন্দিক্ষণে উপরিকাঠামো তথা রাষ্ট্রের আপেক্ষিক স্বাতন্ত্র্য লক্ষ্য করা যায়। এঙ্গেলসও যান্ত্রিক অর্থনীতিবাদী ঝোঁককে কাটিয়ে উঠতে ভিত্তি-উপরিকাঠামো তত্ত্বের সংশোধন ঘটানোর চেষ্টা করেছেন। জোসেফ ব্লচ, মেহেরিঙ বা স্মিডটকে লেখা বিখ্যাত কয়েকটি চিঠিতে তিনি বলেছেন যে শেষ বিচারে বা অভিম পর্যায়ে অর্থনীতি নির্ধারক হলেও উপরিকাঠামোর উপাদানগুলি নানাভাবে সংগ্রামের গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ করে। অর্থাৎ অর্থনীতিই একমাত্র নির্ধারক নয়, উপরিকাঠামো ও উপাদানগুলিও পরস্পরকে নির্ধারণ করে আবার আর্থনীীতিক ভিত্তিকেও প্রভাবিত করে।
মার্কস, বিশেষ করে এঙ্গেলস-এর ঐকান্তিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও ভিত্তি-উপরিকাঠামোর তত্ত্বভিত্তিক ইতিহাস রাজনীতি ব্যাখ্যার মধ্যে যান্ত্রিকতা এবং নির্ধারণবাদী প্রবণতা দীর্ঘদিন ধরেই ইউরোপীয় মার্কসবাদী মহলে জোরদার ভূমিকা পালন করে। দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের গোঁড়া মার্কসবাদী অবস্থানের মধ্যেও এই যান্ত্রিকতা চোখে পড়ে। এই অবস্থানের সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা হচ্ছে মানবিক ক্রিয়া, কর্মকাণ্ড বা অনুশীলনের কোন পরিসর এখানে থাকে না। মানবচৈতন্যের আলাদা কোন সক্রিয় ভূমিকা এখানে স্বীকার করা হয় না। প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের মতই সমাজও চলে কয়েকটি মূল সূত্রের নিয়মমাফিক। অর্থনীতি-উৎপাদনের মূলসূত্রগুলি অনুধাবন করলেই তৎ-সম্পর্কিত উপরিকাঠামোর ব্যাখ্যা সম্পূর্ণ হয়। জীবনধারণ-নিরপেক্ষ মানবচৈতন্যের কোন অস্তিত্ব থাকতে পারে না। লেনিনের প্রথম দিককার রচনায়, বিশেষ করে রুশ পপুলিস্টদের নিয়ে লেখা রচনায় বা বস্তুবাদী তত্ত্বের ব্যাখ্যা সংক্রান্ত রচনায় যেমন মেটেরিয়ালইসম এ্যান্ড এমপিরিও ক্রিটিসিসম-এ একই অবস্থান চোখে পড়ে। কিন্তু তিনি এই যান্ত্রিক অর্থনীতিবাদী অবস্থান থেকে সরে আসেন রুশ বিপ্লবের পরিপ্রেক্ষিতে বিপ্লবী সংগঠন এবং বিপ্লবী গোষ্ঠী গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে লেখা তাঁর নানা রচনায়। পিছিয়ে থাকা, আধা-সামন্তবাদী রুশ দেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব গড়ে তুলতে বিপ্লবী দল এবং অগ্রণী চৈতন্যের বিপ্লবাত্মক ভূমিকা নিয়ে লেনিন তাঁর বিভিন্ন রচনায় অর্থনীতিবাদী অবস্থানের সমালোচনা করেন। ভিত্তি উপরিসৌধের উপমা এবং অর্থনীতিকেই চূড়ান্ত নির্ধারক হিসেবে বিবেচনা করার সিদ্ধান্তকে লেনিন মার্কসবাদের বিকৃতি হিসেবে চিহ্নিত করেন। অর্থনীতি উৎপাদন প্রক্রিয়ায় সঙ্কট এবং তৎজনিত বিপ্লবী পরিস্থিতির অনিবার্যতায় অবিশ্বাসী লেনিন বিপ্লবী চৈতন্যের ওপর সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব দেন।
তবে মার্কসীয় তত্ত্বচর্চার ক্ষেত্রে ভিত্তি-উপরিসৌধের তত্ত্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমালোচনার ক্ষেত্র নির্মাণ করেন গ্রামশ্রী। এই স্থাপত্য শৈলী দিয়ে সমাজ-রাজনীতির যাবতীয় রহস্যের সমাধানের প্রচেষ্টা থেকে নির্ধারণবাদী ইতিহাস চিন্তা স্বীকৃতি লাভ করে বলে তিনি মনে করেছেন। ভিত্তি ও উপরিসৌধের তত্ত্ব এবং অর্থনীতিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়ার তাত্ত্বিক অবস্থানের সমালোচনা করে গ্রামশ্রী প্রিজন নোটবুকস্ এ মন্তব্য করেছেন যে এর থেকে মনে হতে পারে যে ইতিহাসের অগ্রগতির কয়েকটি অমোঘ, অবশ্যম্ভাবী নিয়ম সবসময় নিজের থেকে কাজ করে চলেছে। এবং এই অমোঘ নিয়মনীতিগুলি মানবচৈতন্য নিরপেক্ষ। অনেকটা প্রকৃতির নিয়মের মত নিজের থেকেই এই নিয়মগুলি কার্যকরী হয়। ভিত্তি-উপরিসৌধের এই কার্য কারণবাদী ব্যাখ্যায় বিশ্বাস, গ্রামশ্চীর মতে অনেকটা ধর্মবিশ্বাসের মত। সমস্ত ধরনের সমাজের মধ্যে এই অনিবার্য সূত্রগুলিকে খুঁজে পেয়ে তার নিখুঁত বিশ্লেষণ করা, তাঁর মতে, নিষ্ক্রিয় নিয়তিবাদের নামান্তর মাত্র। গ্রামশ্রী মার্কসবাদী পদ্ধতি হিসেবে ভিত্তি-উপরিসৌধের তত্ত্বকে অবক্ষয়ী চিন্তার প্রকাশ বলে মনে করেছেন। এই অবস্থানের বিপরীতে গ্রামশ্চী রাজনীতি-সংস্কৃতি চর্চার ওপর সবচেয়ে বেশী জোর দিয়েছেন। তাঁর মতে যান্ত্রিক বিবর্তনবাদী মার্কসবাদের বিপরীতে বিপ্লবী রাজনীতি চর্চার ক্ষেত্র হওয়া উচিত সাধারণ মানুষজনের প্রাত্যহিক জগৎ আর জীবনচর্চা, তাদের বিশ্বাস-অবিশ্বাস এবং মূল্যবোধ। শাসক গোষ্ঠীর মতাদর্শগত আধিপত্যের বিরোধী পাল্টা আধিপত্য নির্মাণের প্রচেষ্টা শুরু করা সক্রিয় রাজনীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হওয়া উচিত। অর্থনীতির সঙ্কট কখনই যান্ত্রিকভাবে শাসকগোষ্ঠির রাজনীতিক আধিপত্যের সংকটে রূপান্তরিত হয় না বলে তিনি মন্তব্য করেন। গ্রামশ্চীকে অনুসরণ করে পরবর্তী কালে ই. পি. টমসন এবং তাঁর অন্যান্য সহযোগী যেমন রেমন্ড উইলিয়ামস, স্টুয়ার্ট হল প্রমুখ অফিসিয়াল মার্কসীয় তত্ত্বের অন্তর্ভুক্ত ভিত্তি-উপরিসৌধের পদ্ধতির সমালোচনা করেন। গোঁড়া মার্কসবাদী অবস্থানে যেখানে বলা হয় মানুষের বাস্তব অস্তিত্ব, উৎপাদন প্রক্রিয়ায় তার অবস্থান, তার চৈতন্যের নির্ধারক, তার সমালোচনা করে এই গোষ্ঠীর মার্কসবাদীরা বলেন যে সামাজিক অস্তিত্ব অর্থনীতি উৎপাদন এবং উপরিকাঠামোগত উপাদানগুলির মধ্যে বজায় থাকে এক ধরনের পারস্পরিকতা এবং ঐক্য। এই দুটি ক্ষেত্রকে কোন মতেই আলাদা করা যাবে না। এই জটিলতাকে অর্থনীতির যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাবে না।
লুই অ্যালথুসেও ভিত্তি-উপরিসৌধের তত্ত্ব এবং অর্থনৈতিক নির্ধারণবাদী মার্কসীয় অবস্থানকে সমালোচনা করেছেন। ভিত্তি-উপরিসৌধের তত্ত্বের বিপরীতে তিনি সামাজিক সংগঠনের (Social Formation) ধারণা গড়ে তুলেছেন। ভিত্তি-উপরিকাঠামোসুলভ মার্কসীয় রাজনীতিক-অর্থনীতির পদ্ধতির পরিবর্তে তিনি যে পদ্ধতি নির্মাণ করেছেন তা অনেকটা এই রকম। প্রত্যেক সামাজিক সংগঠন অর্থনীতি, রাজনীতি এবং মতাদর্শ এই তিনটি ক্রিয়াকাঠামোকে উপজীব্য করে গড়ে ওঠে। অফিসিয়াল মার্কসবাদীদের অনুরূপ তিনিও মেনে নিচ্ছেন যে অর্থনীতিক ভিত্তি গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু উপরিকাঠামো ভিত্তির প্রয়োজনীয় শর্ত হিসেবে সক্রিয় থাকে। এই প্রসঙ্গে তিনি মন্তব্য করেছেন যে অর্থনীতি নিশ্চয়ই ‘নির্ধারক কাঠামো’ হিসেবে কাজ করে, শেষ পর্যন্ত এটিই সবকিছুর সীমানা নির্ধারণ করে দেয়। তবে বিশেষ ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে এটি নির্ধারক নাও হতে পারে। যেমন সামন্ততন্ত্রে রাজনীতিক কাঠামো প্রাধান্যকারী ভূমিকা পালন করে। কোন নির্দিষ্ট সমাজ পরিস্থিতিতে কোন্ কাঠামো প্রধান ভূমিকা পালন করবে তা নির্ভর করে নির্দিষ্ট ধরনের উৎপাদন ব্যবস্থার ওপর। যান্ত্রিক অর্থনীতিবাদী মার্কসবাদের সমালোচনা করে তিনি বলেছেন যে প্রধান দ্বন্দ্ব হিসেবে অর্থনৈতিক দ্বন্দ্ব কখনই বিশুদ্ধ ভাবে প্রকাশ পায় না। আবার উপরিকাঠামোগত স্তরে এই দ্বন্দ্বের ছবহু প্রতিফলন ঘটে না। অ্যালথুসে মন্তব্য করেছেন যে অর্থনৈতিক ভিত্তির নিরিখে নির্ণিত হয় কোন্ কাঠামো প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করবে। এইভাবে তিনি অর্থনীতি সর্বস্ব মার্কসীয় রাজনীতি চর্চা থেকে সরে এসে উপরিকাঠামোগত বিভিন্ন কাঠামো বা ক্রিয়াকে চিহ্নিত করছেন মতাদর্শগত রাষ্ট্রপরিকাঠামো হিসেবে এবং এর স্বাতন্ত্র্য্য অস্তিত্বের কথাও তিনি বলেছেন। মতাদর্শগত রাষ্ট্রকাঠামোর অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন সরকারী বন্দোবস্ত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ধর্মপ্রতিষ্ঠান ইত্যাদি ব্যক্তিকে তার সামাজিক অস্তিত্বের অনুরূপ গড়ে পিঠে নেয়। অর্থনৈতিক দ্বন্দ্বের সমাধান ঘটে এই মতাদর্শের জগতে। অর্থাৎ ব্যক্তির প্রকৃত সামাজিক অস্তিত্বের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় মতাদর্শগত বিন্যাস মিলেমিশে একাকার হয়ে প্রচলিত অর্থনীতি-সামাজিক-রাজনৈতিক কাঠামোর অঙ্গীভূত হবার প্রক্রিয়া চলে।
অ্যালঘুসে উপরিকাঠামোগত উপাদানগুলিকে অর্থনীতির যান্ত্রিক প্রতিফলন বলে দেখতে রাজী নন। বরং উপরিকাঠামোগত উপাদানগুলির জটিলতার দিকে নজর দিয়ে—মার্কসীয় তত্ত্ব চর্চার এক বিস্তৃত ক্ষেত্র তিনি গড়ে তুলেছেন। তাঁর মতে আর্থনীতিক ভিত্তি বলতে যেমন নির্দিষ্ট উৎপাদন ব্যবস্থায় কাঁচামালকে উৎপাদিত পণ্যে রূপান্তরিত করা হয়, তেমনি অনুরূপ প্রক্রিয়া লক্ষ্য করা যায় মতাদর্শের ক্ষেত্রেও। মতাদর্শগত ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ব্যক্তির রূপান্তর প্রক্রিয়া চলে, প্রচলিত উৎপাদন সম্পর্কের সঙ্গে সে একাত্মবোধ করে। রাষ্ট্রীয় মতাদর্শগত কাঠামোর মধ্য দিয়ে অর্থনৈতিক ভিত্তির নির্ণায়ক ভূমিকার উৎপাদন এবং পুনরুৎপাদন ঘটে।
Leave a comment