অথবা, মানুষের শিক্ষণ ও পশুর শিক্ষণের মধ্যেকার সম্পর্ক ও বৈসাদৃশ্য তুলে ধর।
ভূমিকাঃ মানুষ ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ বা ‘সৃষ্টির সেরা জীব’। কিন্তু সৃষ্টির সেরা হয়েই সে জন্মায় না। মানব শিশু অসহায় অবস্থায় জন্মগ্রহণ করে। এ অসহায় অবস্থা থেকে নিজেকে সৃষ্টির সেরা হিসেবে গড়ে তোলার জন্য মানুষকে অনেক কিছুই শিখতে হয়। আর মানুষের শিক্ষণ ক্ষমতাও অসীম। তাই শিক্ষণ মানুষের জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অবশ্য মানুষ ছাড়াও নিম্নশ্রেণীর প্রাণীর মধ্যে শিক্ষণ ক্ষমতা আছে। তবে তা খুবই সীমাবদ্ধ।
মানুষ ও পশুর শিক্ষণের মধ্যে পার্থক্যঃ মানুষ বুদ্ধিবৃত্তি সম্পন্ন জীব। সে কারণে ইতর প্রাণীর তুলনায় মানুষের শিক্ষণ প্রক্রিয়া অত্যন্ত জটিল। বিভিন্ন মনোবিজ্ঞানী মানুষ ও ইতর প্রাণীর শিক্ষণ সম্পর্কে অসংখ্য গবেষণা করে উভয়ের শিক্ষণের মধ্যে পার্থক্য নির্ধারণ করেন। নিম্নে সেগুলো পর্যায়ক্রমে উল্লেখ করা হলোঃ
(১) স্নায়ুব্যবস্থাঃ উন্নত মস্তিষ্ক ও স্নায়ুব্যবস্থার জন্য মানুষের শিক্ষণ উন্নত হয়। পক্ষান্তরে ইতর প্রাণীর মস্তিষ্ক নিম্নতর বলে তাদের শিক্ষণও নিম্নতর হয়।
(২) প্রচেষ্টা ও ভুল শিক্ষণঃ মানুষ ও ইতর প্রাণী উভয়েই প্রচেষ্টা ও ভুল শিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষা লাভ করে। তবে মানুষের তুলনায় ইতর প্রাণীর শিক্ষণের জন্য এ পদ্ধতির ওপর অধিক নির্ভরশীল হতে হয়।
(৩) সময় ও প্রচেষ্টাঃ একই শিক্ষণের জন্য মানুষের তুলনায় ইতর প্রাণীকে অধিক প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে হয় এবং সময়ও অনেক বেশি লাগে।
(৪) বিচার বুদ্ধিঃ মানুষ বিচার-বুদ্ধিসম্পন্ন প্রাণী। সেজন্য মানুষ বিচার-বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে শিক্ষণ প্রক্রিয়াকে সহজ করে তুলতে পারে। কিন্তু ইতর প্রাণীর বিচার বুদ্ধি না থাকায় সেটা সম্ভব নয়।
(৫) বিমূর্ত ক্ষমতাঃ বিমূর্ত ক্ষমতার সাহায্যে মানুষ সাথে সাথে একজাতীয় সব সমস্যার সমাধান করতে পারে। কিন্তু ইতর প্রাণী তা পারে না।
(৬) ভাষার ব্যবহারঃ মানুষের ভাষা ব্যবহারের ক্ষমতা আছে। তাই শিক্ষণের ক্ষেত্রে ইতর প্রাণীর তুলনায় মানুষের সুবিধা আছে। ভাষার মাধ্যমে অন্যের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জেনে নিয়ে মানুষ তা নিজের শিক্ষণে ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু ইতর প্রাণীর পক্ষে তা সম্ভব না।
(৭) স্মৃতিশক্তিঃ মানুষের স্মৃতিশক্তি ইতর প্রাণীর তুলনায় বেশি। তাই মানুষ কোনো সমস্যা সমাধানে অতীত অভিজ্ঞতাকে ভালোভাবে কাজে লাগাতে পারে।
(৮) অন্তর্দৃষ্টিঃ যদিও মানুষের ন্যায় ইতর প্রাণীও অন্তর্দৃষ্টির সাহায্যে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে এর পরিমাণ বেশি।
(৯) চিন্তাশক্তিঃ মানুষের চিন্তাশক্তি উচ্চস্তরের। অমূর্ত বিষয়ের চিন্তন, সম্বন্ধ পৃথকীকরণ, সাধারণীকরণ ইত্যাদির ক্ষমতা থাকার কারণে মানুষের শিক্ষণ অপেক্ষাকৃত সহজ হয়।
(১০) পর্যবেক্ষণঃ মানুষ উত্তম পর্যবেক্ষক। সেজন্য মানুষ উদ্দীপককে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যবেক্ষণ করে সঠিক প্রতিক্রিয়া করতে পারে যা ইতর প্রাণীর পক্ষে সম্ভবপর না।
(১১) অনুকরণঃ মানুষ অনুকরণ প্রিয়। অনুকরণের সাহায্যে মানুষ ইতর প্রাণীর তুলনায় অধিকতর কার্যকরিভাবে শিক্ষা লাভ করতে পারে।
(১২) অতীত অভিজ্ঞতা ও ভবিষ্যৎ শিক্ষাঃ ইতর প্রাণীর তুলনায় মানুষ অতীত অভিজ্ঞতা বেশি করে কাজে লাগিয়ে ভবিষ্যতের অনেক ঘটনা সম্পর্কে পূর্বানুমান করতে পারে। কিন্তু ইতর প্রাণীর শিক্ষা বর্তমান বিষয়ভূত।
(১৩) জৈবিক প্রেষণাঃ শিক্ষণ সংক্রান্ত গবেষণার ক্ষেত্রে ইতর প্রাণীর প্রেষণাকে ইচ্ছামতো নিয়ন্ত্রণ করা যায়। কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে প্রেষণার এরূপ নিয়ন্ত্রণ সম্ভবপর হয় না।
পরিশেষঃ উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, মানুষ ও ইতর প্রাণীর শিক্ষণের মধ্যে নানা দিক দিয়ে পার্থক্য বিদ্যমান। কিন্তু মনোবিজ্ঞানীদের শিক্ষণ বিষয়ক নানা পরীক্ষায় জানা যায় যে, উভয়ের শিক্ষণ প্রক্রিয়ায় জটিলতার দিক ছাড়া মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই।
Leave a comment