‘মানসী’

‘মানসী’ কাব্যে (১২৯৭ বঙ্গাব্দ) রবীন্দ্রনাথের মোহমুক্তি ঘটেছে। বহু ঘাত-সংঘাতের মানসিক ঝড় পেরিয়ে। বাইরে যে প্রেমের শক্তি ছিল রূপান্বিত, এ কাব্যের পরিণতি পর্যায়ে তাই মনের মাধুরীময় হয়ে ‘মানসী’ মূর্তি ধরেছে। এ কাব্যের ‘উপহার’ অংশে স্বয়ংকবি তার বিশেষিত মানস ঋতুর পরিচয় দিয়ে বলেছেন-

“নিভৃত ও চিত্ত মাঝে নিমেষে নিমেষে বাজে
জগতের তরঙ্গ আঘাত,

ধ্বনিত হৃদয়ে তাই মুহূর্তে বিরাম নাই
নিদ্রাহীন সারাদিন রাত।”

জগতের রূপ-রস-গন্ধময় বহিঃসৌন্দর্যকে কবি তার সীমায়িত মনের মধ্যে তখনো সম্পূর্ণ করে পেতে চেয়েছেন, অন্তত বিচিত্রকে উপলব্ধি করেছেন নিজের একান্ত একক মনোময়রূপে। কিন্তু বিশ্বজগৎকে হৃদয়ের গভীরে অনুভব করায় দেহের আকুতিকে সম্পূর্ণ অতিক্রম করে মানসলোকে উত্তরণের চেষ্টায় কবিকে আত্মীয় করতে হয়েছে ধাপে ধাপে। ফলে মানসীর ক্রমপরিণত ভাবনার ধারাও চলেছে দীর্ঘদিন ধরে ১২৯৪ বাংলা সনের বৈশাখ থেকে ১২৯৭ সনের কার্তিক পর্যন্ত। এ সাড়ে তিন বছরে কবিতা রচনার প্রবাহ অবিরত থাকেনি। বারে বারে ছেদ পড়েছে- প্রত্যেক নতুন পর্যায়েই পরিণততর ভাবনার আন্দোলনে নতুন ঝাঁকের কবিতা রচনা চলেছে কিছুদিন। মানসীর কবিতা প্রবাহকে কবি মনোভাবের বিস্তারের প্রেক্ষিতে চার ভাগে ভাগ করেছেন। প্রথম পর্যায়ে আছে আক্ষেপ ও অভিমান। দেহের আকাঙ্ক্ষায় কেন আর প্রাণে সাড়া জাগে না, অতৃপ্ত যৌবনের সেই ব্যাকুল জিজ্ঞাসা। ভুলে ভুলভাঙা ইত্যাদি কবিতা এ পর্যায়ের রচনা।

দ্বিতীয় পর্যায়ে আছে, সুতীক্ষ্ণ যন্ত্রণাবোধ। কবি নিশ্চয় বুঝেছেন, দেহের বাসনার তৃপ্তি নেই, নেই কোন চরিতার্থতা। তবু অন্ধ আকাঙ্ক্ষার অভ্যস্থতা কাটিয়ে উঠা দুঃসহ মনে হয়-

“বিশ্বজগতের তরে ঈশ্বরের তরে

শতদল উঠিতেছে ফুটি,

সুতীক্ষ্ণ বাসনা চুরি দিয়ে

তুমি তাহা চাও ছিঁড়ে নিতে?

ভালোবাস, প্রেমে হও বলী?

চেয়ো না তাহারে।”

ক্রমে এ প্রত্যয় দৃঢ় হয়ে উঠেছে মনে মনে তৃতীয় পর্যায়ব্যাপী সুদীর্ঘ আত্মসংগ্রামের পরে। সে অনুভবের আনন্দে লিখলেন ‘রাজা ও রানী’ নাটক। সে কথা পরে বলছি, এখানে কেবল স্বীকার করে রাখি। সুরদাসের প্রার্থনা প্রভৃতি কবিতার উন্মত্ত সীমিত প্রেমকে অতিক্রম করে অসীম প্রেমে উত্তরণের সফল সংঘাতচিত্র রয়েছে ‘রাজা ও রানী’ নাটকে। এদিক থেকে নাটকটি মানসী কাব্য ভাবনারই অনুভূতি।

বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ উপরের লেখায় কোন ভুল থাকে তাহলে দয়া করে আমাদেরকে কমেন্ট করে জানাবেন আমরা সেটা ঠিক করে দেওয়ার চেষ্টা করবো, ধন্যবাদ।