একটি তাত্ত্বিক ঘোষণা:

কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো (Manifesto of the Communist Party)-র প্রথম পরিচ্ছেদের শুরুতেই একটি তাত্ত্বিক ঘোষণা করা হয়েছে। একটি বাক্যের এই ঘোষণাটির মাধ্যমে ম্যানিফেস্টোর মুখ্য বক্তব্যটি ব্যক্ত হয়েছে। ঘোষণাটি হল: ‘আজ পর্যন্ত যত সমাজ দেখা গেছে তাদের সকলের ইতিহাস হল শ্রেণী-সংগ্রামের ইতিহাস’ (“The history of all hitherto existing society is the history of class-struggles.”)। ম্যানিফেস্টোর এই মৌলিক বক্তব্যটি মার্কসের নিজস্ব। মার্কসের মৃত্যুর পর এঙ্গেলসের মন্তব্য থেকেই তা জানা যায়। ১৮৮৮ সালে ম্যানিফেস্টোর ইংরেজী সংস্করণের ভূমিকায় এ বিষয়ে এঙ্গেলস তাঁর অভিমত দ্বিধাহীনভাবে জানিয়েছেন। আবার ১৮৮৩ সালে ম্যানিফেস্টোর জার্মান সংস্করণের ভূমিকায় এঙ্গেলস বলেছেন : ‘ম্যানিফেস্টোর ভিতর যে মূল চিন্তা প্রবহমান তা হল… মানবজাতির সমগ্র ইতিহাস (জমির উপর যৌথ মালিকানা সম্বলিত আদিম উপজাতীয় সমাজের অবসানের পর থেকে) হল শ্রেণী-সংগ্রামের ইতিহাস, সমাজবিকাশের নানা স্তরে শোষক ও শোষিত, নিপীড়ক ও নিপীড়িত শ্রেণীগুলির সংগ্রামের ইতিহাস’ [“The basic thought running through the Manifesto… that consequently (ever since the dissolution of the primeval communal ownership of land) all history has been a history of class-struggles, of struggles between exploited and exploiting, between dominated and dominating classes at various stages of social development….”]।

লিখিত ইতিহাসের কথা:

প্রকৃত প্রস্তাবে উপরিউক্ত বক্তব্যই হল ঐতিহাসিক বস্তুবাদের মূল কথা। এবং এই বুনিয়াদী চিন্তাটিই ম্যানিফেস্টোর মধ্যে প্রবহবান আছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা দরকার যে এখানে ইতিহাস বলতে সমগ্র লিখিত ইতিহাসের কথাই বলা হয়েছে। এই ইতিহাস হল আদিম সাম্যবাদী সমাজের পরবর্তীকালের ইতিহাস। আদিম সাম্যবাদী সমাজে শ্রেণী বলে কিছু ছিল না, তাই শ্রেণী-সংগ্রাম ছিল না। মর্গানের চূড়ান্ত আবিষ্কার থেকে বিষয়টি স্পষ্টত প্রতিপন্ন হয়। আদিম সাম্যবাদী সমাজে ব্যক্তিগত সম্পত্তি ছিল না। উৎপাদনের উপাদানগুলি ছিল সাধারণের সম্পত্তি। তখন উৎপাদন হত সকলের মিলিত মেহনতে। মিলিতভাবে সকলে তা ভোগ করত। কেবল ভোগের জন্যই উৎপাদন হত, বিনিময়ের জন্য নয়। উদ্বৃত্ত উৎপাদন ছিল না। মালিক-শ্রমিক ভেদাভেদ ছিল না। এই শ্রেণীহীন সমাজই হল আদিম সাম্যবাদী সমাজ।

মার্কসবাদে শ্রেণী-সংগ্রামের উপর গুরুত্ব:

মার্কসীয় দর্শনে মানবসমাজের ক্রমবিকাশের ধারা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এই বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে শ্রেণী ও শ্রেণী-সংগ্রামের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। মার্কস মূলত আর্থনীতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই শ্রেণীর সংজ্ঞা নির্দেশ করেছেন। অর্থাৎ শ্রেণী সম্পর্কিত মার্কসীয় ধারণা হল মূলত আর্থনীতিক। এ প্রসঙ্গে ‘মার্কসবাদ’ শীর্ষক গ্রন্থে এমিল বার্নস-এর অভিমত প্রণিধানযোগ্য। তাঁর মতানুসারে, ‘মার্কসের ইতিহাস-দৃষ্টি অনুসারে বিবদমান শ্রেণীসমূহের দ্বন্দ্বই হল সমাজবিকাশের মূল চালিকা শক্তি। জীবনযাত্রার পক্ষে প্রয়োজনীয় উৎপাদন শক্তিসমূহের বিকাশের স্তর অনুযায়ী সমাজে শ্রেণীভেদ ও নতুন শ্রেণীর সৃষ্টি হয়। এ ক্ষেত্রে মিলিবাও (Ralph Miliband)-এর অভিমতও উল্লেখ করা দরকার। তিনি তাঁর Marxism and Politics শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: “…it is certainly they (Marx and Engels) who, more than anyone also before them represented politics as the specific articulation of class-struggles.”

মার্কসীয় দর্শন অনুসারে শ্রেণী-বিভক্ত যে-কোন সমাজে অনেকগুলি শ্রেণীর অস্তিত্ব সম্ভব। কিন্তু সমাজের সকল শ্রেণীকেই মূল বা বুনিয়াদি শ্ৰেণী বলা যায় না। সমাজে কিছু অ-প্রধান বা অ-বুনিয়াদি শ্রেণীও থাকে। তবে সমাজবিকাশের ধারায় শ্রেণী-সংগ্রাম বলতে দু’টি প্রধান শ্রেণীর মধ্যে বা বুনিয়াদি শ্রেণীর মধ্যে বিরোধকেই বোঝায়। দু’টি প্রধান শ্রেণীর মধ্যে বিরোধই হল মূল বিরোধ বা শ্রেণী-সংগ্রাম। এই সংগ্রামের ফলাফল ও প্রকৃতির পরিপ্রেক্ষিতে সমাজের অ-প্রধান শ্রেণীসমূহ আবির্ভূত হয়ে থাকে।

শ্রেণীবিভক্ত সমাজের সৃষ্টি:

আদিম সাম্যবাদী সমাজের পর মানুষ কালক্রমে পশুপালন শিখল। কিছু উপজাতি মুখ্য জীবনবৃত্তি হিসাবে পশুপালনকে গ্রহণ করল। অন্যান্য উপজাতিদের থেকে পশুপালক উপজাতিগুলি নিজেদের স্বাতন্ত্র্য সম্পর্কে সচেতন হল। এঙ্গেলসের অভিমত অনুসারে এই হল শ্রমের প্রথম বিশাল প্রকৃতির সামাজিক বিভাজন। কালক্রমে এর থেকেই সমাজে এসেছে প্রথম শ্রেণীবিভাজন। পশুপালনের পর কৃষি ও হস্তশিল্পের অগ্রগতি ঘটল। উদ্বৃত্ত উৎপাদন শুরু হল। নতুন শ্রমশক্তির প্রয়োজন দেখা দিল। দাস-প্রথার সৃষ্টি হল। আদিম সাম্যবাদী সমাজ অবলুপ্ত হল। সমাজে প্রথম শ্রেণীবিভাগ দেখা দিল। দু’টি শ্রেণীর সৃষ্টি হল। এই দু’টি শ্রেণী হল প্রভু ও দাস— শোষক ও শোষিত। দাস প্রথার মাধ্যমে শ্রেণীবিভক্ত সমাজের সূত্রপাত ঘটেছে। তারপর সমাজবিকাশের ধারায় এসেছে আরও দু’টি শ্রেণীবিভক্ত সমাজ। অন্য দু’টি শ্রেণীবিভক্ত সমাজ হল সামন্তসমাজ ও পুঁজিবাদী সমাজ।

শ্রেণীবিভাজন থেকেই শ্রেণী-সংঘাতের সৃষ্টি:

মানবসমাজের ইতিহাস নিয়ন্ত্রিত হয় মূলত দু’টি বিষয়ের দ্বারা। এই দু’টি বিষয় হল উৎপাদন ও বিনিময় ব্যবস্থার প্রকৃতি। সমাজে শ্রেণীবিভাজন থেকেই শুরু হয় শ্রেণী-সংঘাত। শ্রেণীভেদের সূত্রপাত থেকেই সমাজে একটি বিশেষ ব্যাপার পরিলক্ষিত হয়। শ্রেণীবিভক্ত সমাজে উৎপাদন ব্যবস্থা এবং বিনিময় ব্যবস্থা এমনই হয় যে একটি শ্রেণীর স্বার্থের মূল্যেই বিকশিত হয় অন্য একটি শ্রেণীর স্বার্থ। শ্রেণীবিভক্ত সমাজের উৎপাদন ব্যবস্থায় শ্রেণীগুলির অবস্থান এমনভাবে বিন্যস্ত হয় যে একটি শ্রেণীর মূল্যে অপর শ্রেণীর শ্রীবৃদ্ধি ঘটে; একটি শ্রেণীর দারিদ্র্যের ভিত্তিতে গড়ে উঠে অপর শ্রেণীর প্রাচুর্যের ইমারত। সুতরাং এমন সমাজে প্রতিনিয়ত শ্রেণী-সংঘাতই হল স্বাভাবিক। শোষক এবং শোষিতের সম্পর্কে পারস্পরিক সম্পর্ক বৈরীভাবাপন্ন হবেই। দাসমালিক ও দাস, সামন্তপ্রভু ও কৃষক এবং পুঁজিপতি মালিক ও শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক বৈরীভাবাপন্ন ও সংঘাতমূলক হতে বাধ্য। মানবসমাজের ক্রমবিবর্তনের ইতিহাসে এই সংঘাতেরই প্রতিফলন ঘটে।

শ্রেণীবিভক্ত সমাজে শ্রেণী-সংগ্রামের সমাপ্তি ঘটে না:

লেনিনের অভিমত অনুসারে ‘শ্রেণীগুলিকে যে প্রধান লক্ষণ বিশেষিত করে তা হল সামাজিক উৎপাদনে তাদের অবস্থার এবং পরিণতিক্রমে উৎপাদন উপাদানের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক।’ উৎপাদন ব্যবস্থায় কোন একটি শ্রেণীর অবস্থান উৎপাদন উপকরণের সঙ্গে তার সম্পর্কের উপর নির্ভরশীল। উৎপাদনের উপকরণের সঙ্গে বিভিন্ন শ্রেণীর সম্পর্কের ক্ষেত্রে পার্থক্য থাকে। এই পার্থক্য থেকেই সৃষ্টি হয় শ্রেণীগত পার্থক্যের। সমাজে শ্রেণীবিভাগের আর্থনীতিক ভিত্তি হল ব্যক্তিগত মালিকানা। ব্যক্তিগত মালিকানাই হল সমাজে বিভিন্ন শ্রেণীর এবং শ্রেণী-সংঘাতের মৌলিক কারণ। যাঁরা উৎপাদনের উপকরণসমূহের মালিক তারাই হল শাসক শ্রেণী। অপরদিকে এই মালিকানা থেকে যারা বঞ্চিত তারাই হল শোষিত শ্রেণী। বিপরীতমুখী শ্রেণীস্বার্থের জন্য শোষক ও মেহনতী শ্রেণীগুলির মধ্যে শ্রেণীসংগ্রাম লেগেই থাকে। এইভাবে দাস-সমাজের ইতিহাস হল দাস-মালিক ও ক্রীতদাসদের বিরাম বিহীন শ্রেণী-সংগ্রামের ইতিহাস। তারপর সামন্তবাদী সমাজে শ্রেণী-দ্বন্দ্বের রূপ হল সামন্তপ্রভু ও ভূমিদাসের মধ্যে শ্রেণীদ্বন্দ্ব। পরবর্তীকালে পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার শ্রেণী সংগ্রামের রূপ হল পুঁজিপতি মালিক এবং সর্বহারা মজুরি শ্রমিকের মধ্যে শ্রেণী-সংগ্রাম। এই শ্রেণী-সংগ্রামের ভিতর দিয়েই দাস-সমাজের অবসান ও পুঁজিবাদী সমাজের আবির্ভাব ঘটেছে। ভিন্ন ভিন্ন প্রতিটি সমাজে শ্রেণীসমূহের রূপ ও প্রকৃতি-প্রকরণের পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু শ্রেণীবিভক্ত সকল সমাজেই শ্রেণী সংগ্রাম অব্যাহত থাকে। শ্রেণীসংগ্রামের সমাপ্তি ঘটে না। শ্রেণীবিভক্ত প্রতিটি সমাজে মালিকশ্রেণী তাদের শ্রেণী-স্বার্থকে অটুট ও শ্রেণী-শোষণকে অব্যাহত রাখার জন্য ‘রাষ্ট্র’ নামক একটি শ্রেণী-শোষণের যন্ত্রের সাহায্য গ্রহণ করে। শ্রেণী-শোষণের হাতিয়ার এই রাষ্ট্র হল আসলে একটি বলপ্রয়োগের যন্ত্র। কিন্তু এই যন্ত্রটিও শ্রেণী-সংগ্রামের ধারাকে স্তব্ধ করে দিতে পারে না। এই কারণে সকল শ্রেণীবিভক্ত সমাজের ইতিহাসই হল শ্রেণী-সংগ্রামের ইতিহাস। মানবসমাজে ব্যক্তিগত, গোষ্ঠীগত, জাতিগত প্রভৃতি বিভিন্ন ধরনের বিরোধের অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু এই সমস্ত বিরোধের অস্তিত্ব সত্ত্বেও শ্রেণীবিরোধই হল প্রধান। সমাজের অন্যান্য বিরোধের মূল শ্রেণীবিরোধের মধ্যেই বর্তমান থাকে।

আদিম শ্রেণীহীন প্রাক্-সভ্য সাম্যতন্ত্র থেকে মানবসমাজের গতিমুখ হল শ্রেণীসমাজের দিকে। এবং তারপর ইতিহাসের এই গতি শ্রেণী-সমাজ থেকে শ্রেণীহীন সুসভ্য সাম্যতন্ত্রের দিকে। এই কারণে আদিম সাম্যবাদী সমাজ এবং সাম্প্রতিককালের সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহের সমাজব্যবস্থার কথা বাদ দিলে, আজ পর্যন্ত ইতিহাসের সকল সভ্য সমাজই হল শ্ৰেণী-সমাজ। শ্ৰেণী-সমাজে সংখ্যালঘু মালিক শ্রেণী সংখ্যাগুরু শ্রমজীবী শ্রেণীগুলিকে শোষণ করে। মানুষের মেহনতই হল সম্পদ সৃষ্টির মূল। মেহনতী মানুষ সৃষ্টি করে সম্পদ। অপর পক্ষে মালিক শ্রেণী সেই সম্পদের সিংহভাগ আত্মসাৎ করে। দাস, কৃষক ও শ্রমিক— এরাই হল শ্রমজীবী শ্রেণী। উৎপাদন ব্যবস্থায় এরাই মেহনত করে ও সম্পদ সৃষ্টি করে। অপরদিকে দাসপ্রভু, সামন্তপ্রভু ও পুঁজিপতি— এরাই হল মালিক শ্রেণী। এরা উৎপাদন ব্যবস্থায় মেহনত দিয়ে অংশ গ্রহণ করে। না। কিন্তু এরাই উৎপন্নের বেশীর ভাগ কুক্ষিগত করে। যে উৎপাদন ব্যবস্থা সমাজকে বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত করে, সেই উৎপাদন ব্যবস্থাই সমাজে শ্রেণী-সংগ্রামের সৃষ্টি করে এবং তা অব্যাহত রাখে।

বিভিন্ন সমাজব্যবস্থায় শ্রেণী-সংগ্রাম:

মানবসভ্যতার ইতিহাসে প্রথম শ্রেণীবিভক্ত সমাজ হল দাস সমাজ। দাস-সমাজে উৎপাদন-উপকরণের সঙ্গে দাস-মালিক ও দাসদের সম্পর্ক ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। তাছাড়া এই সম্পর্ক ছিল বৈরিতাযুক্ত। তাই এই সমাজব্যবস্থায় দাস-মালিকদের সঙ্গে দাস-শ্রেণীর সংগ্রাম ছিল অব্যাহত। দাস-মালিকদের অমানবিক শোষণের হাত থেকে মুক্তির জন্য মরণপণ সংগ্রামের সামিল হয়েছে দাস শ্রেণী ও অন্যান্য নিঃস্ব স্বাধীন নাগরিকগণ। এ রকম শ্রেণী-সংগ্রামের নজির ইতিহাসে আছে। এ ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হল রোমে স্পার্টাকাসের নেতৃত্বে দাসদের ঐতিহাসিক সংগ্রাম। সমাজ বিকাশের ধারায় এরপর আসে সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা। সামন্ত-সমাজও হল শ্রেণীবিভক্ত সমাজ। এখানেও উৎপাদন-উপকরণের উপর ব্যক্তিগত মালিকানা প্রতিষ্ঠিত। এই সমাজব্যবস্থায় মুখোমুখী প্রধান দু’টি শ্রেণী হল ভূ-স্বামী ও ভূমিদাস। তা ছাড়া কিছু মধ্যবর্তী অপ্রধান শ্রেণীর অস্তিত্বও পরিলক্ষিত হয়। ভূস্বামীদের নিষ্পেষণ থেকে নিষ্কৃতি লাভের জন্য নিপীড়িত ভূমিদাস শ্রেণী ভূস্বামী শ্রেণীর বিরুদ্ধে সংগ্রামের সামিল হয়। এ রকম শ্রেণী সংগ্রামের নজিরও ইতিহাসে অসংখ্য আছে। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে চতুর্দশ শতাব্দীতে ইংল্যাণ্ড ও ফ্রান্সে কৃষক বিদ্রোহের কথা এবং ষোড়শ শতাব্দীতে জার্মানীতে কৃষক বিদ্রোহের কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মানব-সমাজের ক্রমবিকাশের ধারায় শেষ শ্রেণীবিভক্ত সমাজ হল পুঁজিবাদী সমাজ। শ্রেণী-বিভক্ত বলে পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায়ও শ্রেণী-সংগ্রাম অব্যাহত থাকে এবং তীব্রতর হয়। যাইহোক পুঁজিবাদী শ্রেণী-সংগ্রাম স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যযুক্ত। এ প্রসঙ্গে ম্যানিফেস্টোতে মার্কস-এঙ্গেলস বলেছেন: “…শ্রেণীবিরোধ এখানে সরল হয়ে এসেছে। সমগ্র সমাজ ক্রমশ দু’টি বিশাল শত্রু শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়েছে, বিভক্ত হচ্ছে পরস্পরের মুখোমুখি দু’টি বিরাট শ্রেণীতে—বুর্জোয়া ও প্রলেতারিয়েত।” পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় এই দু’টি শ্রেণীই হল প্রধান এবং এদের মধ্যে বিরোধই হল মূল বিরোধ। তবে অন্যান্য অপ্রধান শ্রেণীগুলি এই বিরোধের পরিপ্রেক্ষিতে যে কোন একটি শিবিরে যোগ দেয়।

উপসংহার: উৎপাদন-সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে সমাজে পরস্পর-বিরোধী দু’টি শ্রেণীর অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়। এই দু’টি শ্রেণীর অবস্থান শ্রেণী দু’টির স্বার্থের মধ্যে সংঘাতকে অনিবার্য করে তুলে। যে উৎপাদন ব্যবস্থা সমাজে শ্রেণী-বিভাজনের সৃষ্টি করে, তাই আবার শ্রেণী সংঘাতেরও সৃষ্টি করে। বিপরীতমুখী শ্রেণী স্বার্থের অস্তিত্বের জন্যই বিত্তবান মালিকশ্রেণী ও বিত্তহীন মেহনতী শ্রেণীগুলির মধ্যে শ্রেণী-সংগ্রাম অবিরাম লেগে থাকে। এই সংগ্রাম চলে কখনও ঢিমেতালে, আবার কখনও দ্রুত তালে। সামাজিক উৎপন্নের বণ্টন ব্যবস্থার পরিবর্তন করে মালিক-শ্রমিকের বৈষম্য দূর করা যায় না বা শ্রেণী-সংগ্রামকে আড়াল করা যায় না। এ প্রসঙ্গে মিলিবাণ্ডের বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন: “Domination and conflict are inherent in class-societies, and are based on specific concrete features of their mode of production. They are rooted in the process of extraction and appropriation of what is produced by human labour.”