“মাইকেল মধুসূদন দত্তই বাংলা সাহিত্যের প্রথম আধুনিক শিল্পী।”
ভূমিকা : আধুনিক বাংলা সাহিত্যের বহুমাত্রিক ধারার সূচনা হয় মাইকেল মধুসূদন দত্তের (১৮২৪- ১৮৭৩) হাতে। পাশ্চাত্য সাহিত্যের মর্মমূলে প্রবেশ করে তার আবেগ-প্রাণচাঞ্চল্য এবং প্রকাশরীতি আত্মস্থ করার মধ্য দিয়ে বাংলা কাব্যে যে গতি সঞ্চার করেছিলেন তার মধ্য দিয়েই তিনি আধুনিক বাংলা সাহিত্যে বিশিষ্ট আসনে অধিষ্ঠিত হন। নতুন জীবনমন্ত্র, তেজ এবং বীর্যের পূর্ণ আবেগ নিয়ে মাইকেল মধুসূদন দত্তের আবির্ভাব ঘটেছিল উনিশ শতকে। তাঁর জীবন এবং কর্ম দুই-ই বর্ণময়। মাইকেল মধুসূদন দত্ত নিজে যেমন ছিলেন বিস্ময়কর মানুষ, তেমনি তাঁর সাহিত্যেও প্রকাশিত হয়েছে বিস্ময়কর প্রতিভার স্বাক্ষর। মাইকেল মধুসূদন দত্তের হাতেই বাংলা সাহিত্য নবরূপ লাভ করে। উনিশ শতকের নবজাগরণ এবং পাশ্চাত্য শিক্ষা-ইতিহাস-ঐতিহ্য মধুসূদনকে বাংলা কাব্যের অচলায়তন ভাঙতে সাহায্য করেছিল। তিনি এদেশীয় আচার ও ধর্মবিশ্বাসের মূলে আঘাত হেনেছিলেন তাঁর কাব্য-কবিতার মাধ্যমে।
মাইকেল মধুসূদন দত্ত নবজীবনের বার্তাবাহক হিসেবে বাংলা সাহিত্যে সবলে ও সরবে প্রবেশ করেন। উনিশ শতকের রেনেসাঁ বা পুনর্জাগরণের প্রতীক হিসেবে তাঁকে ধরা হয়। পাশ্চাত্যের সাথে প্রাচ্যের সংযোগ ঘটান তিনি তাঁর সাহিত্যে। তার পূর্ব পর্যন্ত যে জীবন প্রত্যয় ও কাব্যাদর্শের মধ্যে আমরা নিরুদ্বেগ জীবনযাপন করছিলাম মাইকেল মধুসূদন দত্ত সেই শান্তির নীড়ে বজ্রাঘাত করেন। আমরা চকিতে তাকিয়ে দেখলাম- মঙ্গল কাব্যে দেবদেবীগণ হতমান হয়ে পড়েছেন, রামায়ণ-মহাভারতের পাঁচালির মন্থর সুর শেষ হয়ে গেছে, বৈষ্ণব পদাবলীর কীর্তন রসও স্তিমিত হয়ে পড়েছে- আর তার স্থলে প্রচণ্ড কলরবে, তীব্র গতিবেগ চিরাচরিত সংস্কারের ধূলিশয্যা ত্যাগ করে নতুন কাব্যরূপ ও জীবন প্রত্যয় নেমে এসেছে।
মাইকেল মধুসূদন দত্ত প্রথম আঘাত হানেন আবহমান বাংলার প্রচলিত বিশ্বাসের উপর। ফলে পুরাণের বিশ্বাস ও ধর্মীয়বোধ ভেঙে পড়ে- আর এরই সূত্র ধরে তাঁর কাব্যে নায়ক হয়ে উঠে পাপিষ্ঠ ও ঘৃণিত রাবণ। রামায়ণে রাবণ চিত্রিত হয়েছে রাক্ষস, সীতা অপহরণকারী এবং লম্পট হিসেবে। কিন্তু মধুসূদন রাবণকে দেখিয়েছেন একজন প্রজাবৎসল রাজা, দেশপ্রেমিক শাসক, স্নেহশীল পিতা এবং প্রতিশোধপরায়ণ ভাই হিসেবে। রাবণের পিতৃবাৎসল্যরসে সমস্ত ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ এ সঞ্চিত। রাবণের হাহাকারে সমস্ত পাঠকের অন্তরাত্মা কেঁপে উঠে। রাম-লক্ষণ হয়ে উঠে ভীরু-কাপুরুষ। চিরন্তন পিতৃহৃদয়ের কাছে পরাজিত হয়েছে দেব-দেবতা রাম-লক্ষণ। লেখকের সমস্ত আবেগ আর ভালোবাসা রাবণকে ঘিরে;
“করি স্নান সিন্ধুনীরে, রক্ষোদল এবে
ফিরিলা লঙ্কার পানে আর্দ্র অশ্রুনীরে-
বিসর্জি প্রতিমা যেন দশমী দিবসে
সপ্ত দিবানিশী লঙ্কা কাঁদিলা বিষাদে।”
মধুসূদনের এ কাব্যেই বাঙালি পাঠক প্রথম বিদ্রোহীরূপ প্রত্যক্ষ করে মেঘনাদের স্ত্রী প্রমীলার মধ্যে। এ বিদ্রোহ যেন মধুসূদনের নিজের- সমাজ ভাঙার জন্য শুধু এনেছেন প্রমীলাকে। উনিশ শতকের কাব্যে এ জাতীয় সাহসী উচ্চারণ আমরা
আর কোনো কবির কাব্যে খুঁজে পাই না। প্রমীলার বিদ্রোহী সত্তার বিদ্রোহী উচ্চারণ-
“দানব নন্দিনী আমি রক্ষঃ কুলবধূ
রাবণ শ্বশুর মম মেঘনাদ স্বামী,
আমি কি ডরাই সখি, ভিখারী রাঘবে?
পশিব লঙ্কায় আজি নিজ ভুজ বলে।
দেখিব কেমনে মোরে নিবারে নৃমণি?”
ভাবের দিক থেকে মাইকেল বিদ্রোহী। তাঁর এই বিদ্রোহ ছিল বাংলা কাব্যে মধ্যযুগের যে ধর্ম নির্ভরতা তার বিরুদ্ধে। ধর্মের গণ্ডি থেকে বাংলা কাব্যের মুক্তির প্রয়াস তাঁর কাব্যেই প্রথম লক্ষণীয়। পুরনো আদি রসকে ত্যাগ করে বাংলা কাব্যে রসেরও পরিবর্তন আনেন তিনি। তাঁর প্রথম কাব্য ‘তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য’ এ (১৮৬০) মহাভারতের গতানুগতিক রীতি পরিহার করে ইন্দ্র, সুন্দ ও উপসুন্দকে ব্যতিক্রমধর্মী করে গড়ে তুলেছেন। কবি নানাভাবে নিজের আশা-নিরাশা ও আনন্দ-বেদনার কথা তুলে ধরেছেন এ কাব্যে। তাঁর ব্যক্তিক কামনাবাসনা, যুগসত্য এবং কাব্যাদর্শ একটি অচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে তাঁর সমগ্র কাব্যচেতনাকে নিয়ন্ত্রিত করেছে। তাই দেবতাদের স্বর্গচ্যুতিতে তিনি আপনার বেদনারও সন্ধান পান। এ কেবল রোমান্টিক চেতনার পক্ষবিধূন নয়, এর সাথে কবি জীবন, কবি আত্মার এবং যুগ পরিবেশের ঘনিষ্ঠ প্রত্যক্ষতা বিদ্যমান-
“কোথা সে অমরাপুরী কনক নগরী?
কোথা বৈজয়ন্ত-ধাম সুবর্ণ আলয়,
প্রভায় মলিন যার ইন্দু প্রভাকর?
কোথা সে কনকাসন, রাজছত্র কোথা,”
‘ব্রজাঙ্গনা’ (১৮৬১) কাব্যের বিষয়বস্তু রাধাকৃষ্ণ হলেও মধুসূদন কর্তৃক চিত্রিত রাধা গতানুগতিক নয়। যেন মনে হয় বিংশ শতাব্দীর এক অতি আধুনিক রমণী রাধা। এ কাব্যে বৈষ্ণব পদাবলীর রাধা হয়ে উঠেছে একান্ত মানবী রাধা। ‘ব্রজাঙ্গনা’ কাব্য কবির সমকালীন অপর তিনটি কাব্য থেকে বিষয় ও ভঙ্গিতে পৃথক। ‘তিলোত্তমাসম্ভব’, ‘মেঘনাদবধ’, এবং ‘বীরাঙ্গনা’য় কবি মূলত পুরাণ-কল্পনা বিশেষকরে রামায়ণ-মহাভারতের বিপুল রাজ্যে ভ্রমণ করেছেন। কিন্তু ‘ব্রজাঙ্গনা’ কাব্যের বিষয় পুরাণাশ্রিত নয়। মধ্যযুগের কাব্য-কল্পনার রাজ্য থেকে এর বিষয় সংকলিত এবং এর মাধুর্যও অবিমিশ্র।
‘বীরাঙ্গনা’ কাব্যে মাইকেল এক ব্যতিক্রমধর্মী প্রতিভার পরিচয় দেন। মাইকেলের পূর্বে রচিত বাংলা কাব্যে নারীরা নিজেকে বিকশিত করার তেমন কোনো সুযোগ পাননি। কিন্তু এ কাব্যে চিত্রিত নারীরা নিজের আশা-আকাঙ্ক্ষা, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য সুন্দরভাবে প্রকাশ করার অপূর্ব ক্ষমতা লাভ করে যা মূলত মাইকেলের নারী মুক্তি চেতনার বহিঃপ্রকাশ। সামগ্রিক বিচারে ‘বীরাঙ্গনা’ কাব্যের গঠন কৌশল প্রশংসিত। প্রবণতার উচ্ছ্বাস ও আবেগ একদিকে নিয়ন্ত্রিত, অন্যদিকে গড়ে তুলেছেন নাটকীয় চমক ও চমৎকারিত্ব। ‘দশরথের প্রতি কৈকেয়ী পত্রে’ এ নাটকীয়তা ও চমৎকারিত্ব অত্যন্ত সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে-
“কেন আজ পুরবাসী যত,
আনন্দ সলিলে মগ্ন। ছড়াইছে কেউ
ফুলরাশি রাজপথে; কেহ বা গাঁথিছে
মুকুল কুসুম পল পল্লবের মালা।”
মধুসূদনের সর্বাপেক্ষা পরিণত কাব্য সনেট। চৌদ্দ পক্তি ও চৌদ্দ অক্ষরের মধ্যে স্বভাবত তাঁর উচ্ছ্বাসপ্রবণ মন অনেকটা সংযত হতে বাধ্য হয়েছে। সনেটের কঠোর ও দৃঢ় গঠনগুণে স্বল্প পরিধির মধ্যে একটা ভাষাকে সম্পূর্ণতা দান করার জন্য কবিকে ভাষা সম্পর্কে হতে হয়েছে অত্যন্ত সচেতন। মিলের বন্ধনও তাঁর ভাষা গঠনে সহায়ক হয়েছে। বিষয় বৈচিত্র্যে মধুসূদনের ‘চতুর্দশপদী কবিতাবলীতে’ বিভিন্ন ভাবের সমন্বয় ঘটেছে। কিছু কবিতায় নিজ দেশের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও প্রকৃতি কবিকে গভীরভাবে আকৃষ্ট করেছে। ‘কপোতাক্ষ নদ’ কবিতায় দেশের প্রতি তাঁর গভীর ভালোবাসা ফুটে উঠেছে-
“বহু দেশ দেখিয়াছি বহু নদ-দলে
কিন্তু এ স্নেহের তৃষ্ণা মিটে কার জলে?
দুগ্ধ-স্রোতরূপী তুমি জন্মভূমি-স্তনে।”
পরিশেষে বলা যায়, বাংলা সাহিত্যে মাইকেল মধুসূদন দত্ত সত্যিকার আধুনিক কবি। অসাধারণ মেধা ও জীবন সচেতনতায় বাংলা কাব্যে তিনি এক নতুন প্রাণময়তা ও সজীবতা সঞ্চার করেন। রচনা ভঙ্গিতে, বক্তব্যে এবং জীবনবোধের সমন্বয়ে আশ্চর্য শিল্পকুশলতায় তিনি আমাদের সাহিত্যের গতিপথ পরিবর্তন করে তার পরিসর সম্প্রসারিত করেছেন। মধুসূদন একদিকে যেমন বাংলা ভাষার প্রাচীনত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছেন, তেমনি ভাব, ভাষা, ছন্দ, অলঙ্কার, রূপকের ক্ষেত্রেও অভিনবত্ব এনে বাংলা সাহিত্যে নবজাগরণের সৃষ্টি করেছেন। তিনিই প্রথম অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তন করে সাহিত্যে ট্রাজেডি ও কমেডির সার্থক রূপায়ণ করেন। ভাব, ভাষা, ছন্দ, আঙ্গিক প্রভৃতি বিস্ময়কর নতুনত্ব, প্রতিভার বিদ্যুৎদীপ্তি স্ফুরিত করে মধুসূদন হয়েছেন যথার্থই আধুনিক বাংলা কবি।
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ উপরের লেখায় কোন ভুল থাকে তাহলে দয়া করে আমাদেরকে কমেন্ট করে জানাবেন আমরা সেটা ঠিক করে দেওয়ার চেষ্টা করবো, ধন্যবাদ।
Leave a comment