মহাকাব্যের ইংরাজি প্রতিশব্দ Epic গোসলে গ্রিক Epos শব্দের রূপান্তর। Epos শব্দের প্রাচীন অর্থ ছিল ‘শব্দ’ পরে এই শব্দের ওপর বিভিন্ন অর্থ আরোপিত হয়েছে কখনো বিবরণ বা কাহিনি কখনো বা বীরত্মব্যঞ্জক কবিতা বা কাব্য অবশেষে Epic-এর অর্থ দাড়িয়ে যায় কাহিনিমূলক বীরত্ব ব্যঞ্জক কবিতা। সংস্কৃত বা বাংলার মহাকাব্য শব্দটির মধ্যেই মহতের ব্যঞ্জনা থেকে গেছে।

মহাকাব্য তন্ময়কাব্য। মহাকাব্য ব্যক্তিনিষ্ট নয়, বস্তুনিষ্ট। গীতি কাব্যোচিত রাগিনী নয়, যুদ্ধশজ্জার তুর্য নিনাদ।

সংস্কৃত আলংকারিকদের বিচারে আশির্বচন নমোক্রিয় অথবা বস্তু নির্দেশ দ্বারা কাব্যারম্ভ হয়। সাহিত্য দর্পণে বিশ্বনাথ দেখিয়াছেন মহাকাব্যের আখ্যানবস্তু হবে পৌরাণিক বা ঐতিহাসিক এবং (১) মহাকাব্য কমপক্ষে নটি সর্গে বিভক্ত হবে। (২) বেশি হলে ৩০টি সর্গে (৩) বিভিন্ন সর্গে বিভিন্ন ছন্দ থাকবে না, একই ছন্দে লেখা হবে। (৪) মহাকাব্যের নায়ক হবে সৎবংশজাত, ধীরদাত্ত গুণান্বিত ক্ষত্রিয় বা কোনো দেবতা। (৫) এতে জল ক্রীড়া থেকে যুদ্ধের বর্ণনা, সূর্য চন্দ্র থেকে মৃগয়া বিবাহ সম্ভোগের বর্ণনা থাকবে। (৬) শৃঙ্গার, বীর শান্ত রসের যেকোনো একটি মহাকাব্যের অঙ্গীরস হবে। (৭) নামকরণ হবে বৃত্তান্ত বা নায়কের নামে, সর্গের নামকরণ হবে তাৎপর্য অনুসারে। ভামহ, দন্তী, বিশ্বনাথের মহাকাব্যের লক্ষণ নির্ধারণের প্রয়াসকে প্রশংসা করা যায়। এদের বিশ্লেষণ অনুযায়ী নায়কের জয় বা আত্মপ্রতিষ্ঠার মধ্যে মহাকাব্যের সমাপ্তি হবে।

পাশ্চাত্যের ‘Poetic রচয়িতা’ অ্যারিষ্টটল মহাকাব্য সমালোচনার প্রথম পথ প্রদর্শক। Poetics-এর প্রধান বিচার্য বিষয় ট্রাজেডি তবে প্রসঙ্গত তিনি মহাকাব্যের লক্ষণ নির্দেশ করেছেন। সংস্কৃত অলংকারিদের মতে যা মহাকাব্য তার সাথে পাশ্চাত্য Epic-এর কোনো কোনো বৈদাদৃশ্য থাকলেও এদের মধ্যে ভাবগত সাদৃশ্য বর্তমান। পাশ্চাত্য অলংকারিক অ্যারিস্টটলের মতে মহাকাব্য, আদি-মধ্য-অন্ত সমন্বিত বর্ণাত্মক কাব্য–এতে বিশিষ্ট কোনো নায়কের জীবন কাহিনি একই ছন্দের সাহায্যে বর্ণিত হবে। তিনি বলেন— An epic should be based on a single action, one that is a complete whole in itself, with a beginning, middle and end. So as be enable to work to produce its won proper pleasure with all the organic unity of a living cueature as for its metue, the heroic has been asigned from experience.

মহাকাব্য সুদীর্ঘ কাব্য। কিন্তু সুদীর্ঘ কাব্যই মহাকাব্য নয়। মহাকাব্যের ভাগও আছে। একজন সমালোচক মানব সভ্যতাকে ভাগ করেছেন এই ভাবে–(1) বর্বর যুগ (age of savagary), (২) বীর যুগ (age ofheroism), (৩) সভ্যযুগ (ageofcivilization)।

বীরযুগের গোষ্ঠী চেতনা ও ব্যক্তিস্বার্থ অপেক্ষা সমাজ ধর্মের অধিকতর গুরুত্ব পেয়েছে। রামায়ণ, মহাভারত, ইলিয়ড ও ওডিসি এসবই authentic epic বা epic of growth বস্তুত মহাকাব্য একলা কবির কথা নয়। তা বৃহৎ সম্প্রদায়ের কাব্য। যুগে যুগে যার বৃদ্ধি ও পুষ্টি। গোটাদেশেণ হৃদপদ্ম সম্ভব এই শ্রেণির কাব্য। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় “বৃহৎ বনস্পতির মতো দেশের ভূ-তল জঠর হইতে উদ্ভূত হইয়া লোককে আশ্রয় ছায়াদান করিয়াছে।”

বলা বাহুল্য বিভিন্ন লোকের রচিত এই শ্রেণির মহাকাব্যের মধ্যেও জাতীয় জীবনের সহস্র বৎসরের হৃদপিণ্ডের স্পন্দন অনুভূত হয়।

authenticepic-এর বৈশিষ্ট্য কি? Absrerombie বলেন “Portic ? which seems an immedate responas la-same general and instand need surounding community – Such Poetry is authentic epic. এক্ষেত্রে বিরাট বিশাল ল্যাণ্ডস্কেপে মহান ঘটনাবলীর স্থান, বিরাট বিরাট চরিত্র দৈহিক ও নৈতিক শক্তিতে বলিয়ান।

আরেক শ্রেণির মহাকাব্য হল অলংকার শাস্ত্রসম্মত মহাকাব্য বা literary epic বা emitative, একে সাহিত্যিক মহাকাব্য বলা হয়। Abercombie মতে সাহিত্যিক মহাকাব্যের মূলে থাকছে মহাকাব্য লেখার সংকল্প বা মানসিক প্রস্তুতি। অন্যদিকে Authentic epic পরিবেশের উদ্দীপনা কবি চিত্রের সহজ প্রতিক্রিয়া।

সাহিত্যিক মহাকাব্যের আখ্যান বস্তু, চরিত্র সৃষ্টি ভাষা মিলে একটি অখণ্ড মহিমময় রসমূর্তির সৃষ্ট হয়। এবং এর শিল্প চাতুর্য লেখকের দুরারোহি কল্পনা ও অনন্যসাধারণ মনন শক্তির গুণে আমাদের কাছে চিরন্তন হয়ে থাকে। এই জাতীয় কাব্য সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেন—“কালে কালে একটি সমগ্র জাতি যে কাব্যকে একজন কবির কবিত্বশক্তি আগ্রহ করিয়া রচনা করিয়া তুলিয়াছে তাহাকেই যথার্থ মহাকাব্য বলা যায়। এই জাতীয় মহাকাব্য পুরাতন বস্তুর অনুকরণ মূলক সৃষ্টি নয়। পুরাতনকে উপলক্ষ করে সম্পূর্ণ নতুন সৃষ্টি।

এই শ্রেণির মহাকাব্যের মধ্যে ভার্জিলের aenied (ঈনিচ), ট্যাসোর (Tasso) জেরুজালেম ডেলিভার, দান্তের Rivina commedia, মিলটনের প্যারাডাইস লষ্ট : ও মধুসূদনের মেঘনাদবধ কাব্য উল্লেখযোগ্য।

মধুসূদনের মেঘনাদ বধ কাব্যকে সংস্কৃত অলংকার শাস্ত্র অনুযায়ী মহাকাব্য রূপে চিহ্নিত করা গেলেও এই ধরনের সৃষ্টি মহাকাব্যের গৌরব সর্বাংশে দাবী করতে পারে না। অবশ্য তিনি তার কাব্যকে আট সর্গের বেশি সর্গে বিভক্ত করেছেন। নগর, বন, উপবন, শৈল, সমুদ্র, প্রভাত, সন্ধ্যা যুদ্ধ মন্ত্রণা প্রভৃতিরও সমাবেশ করেছেন। সর্গ শেষে নতুনছন্দ ব্যবহার করেননি। তার কাব্যে ঘোষণা ছিল—’গাইব মাবীর রসে ভাসি মহগীত’ । তবু কাব্যে করুণ রসের অভাব নেই। সংস্কৃত মহাকাব্য মিলনাত্মক, মধুসূদনের মহাকাব্য বিষাদত্মক। তার কাব্যের নায়ক নিয়েও বিতর্ক আছে। এমনি রাবণকেও নায়ক বলার বিতর্ক থাকছে। এই চরিত্র সবংশজাত ও ধীরোদাত্ত সুনজির এবং তিনি বিশ্বনাথের সাহিত্য দর্পণ মেনে চলার বাধ্যবাধকতায় আপত্তি জানিয়েছেন।

মধুসূদন পাশ্চাত্য সাহিত্য তথা গ্রিক নাটক ও শেকসপিয়র দ্বারা এত গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন যে মিলটন তাকে যে কাঠামো দান করেছিলেন ছন্দের যে কল্লোল শুনিয়েছিলেন তাকেই তিনি গ্রিক বা শেকসপিয়রীয় নাটকের নিয়তিবাদের সঙ্গে সংযুক্ত করে নাটকীয় রূপ দিতে চেষ্টা করেছেন। তিনি literary বা সাহিত্যিক মহাকাব্য রচনা করেছিলেন রামায়ণকে তিনি তার মানবতার আলোকে বিধৌত করে যে মহাকাব্য রচনা করলেন তা আসলে রোমান্টিক মহাকাব্য। মধুসূদন অত্যাশ্চর্য নির্মাণ কুশলতার গুণে যে কাব্য বিগ্রহ সৃষ্টি করেছেন তাতে মিলটনের অমিত্রাক্ষরের উদাত্ত সংগীত ও বর্ণনার মহিমময়তায় থাকা সত্ত্বেও তার রাবণ চরিত্রে মিলটনের শয়তানের পরম দাম্ভিকতা প্রকট হয়ে ওঠেনি। এটা ত্রুটি নয় মধুসূদন নবজাগরণের প্রথম কবি, যার কলমে শয়তানের অনুসরণ মূলক চরিত্র হয়েও রাবণ মহিমান্বিত হয়। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য প্রভাবের সমীকরণে ইন্দ্রজিৎ সীতা, সরমা, প্রমিলা অনন্যতা লাভ করেছে। ধ্রুপদী মহাকাব্য তিনি লেখেননি। তার epic-এর মধ্যে রোমান্টিকের সুর শোনা গেলেও মেঘনাধবধ কাব্য সাহিত্যিক মহাকাব্য গোত্রীয়।