উৎস: ইংরেজিতে মহাকাব্যকে বলা হয় Epic. Epic শব্দটির মূল উৎস গ্রিক শব্দ ‘Epikos’ বা ‘epos’, গ্রিক শব্দ Epic-এর অর্থ হল শব্দ বা গান। এ শব্দের অর্থের ক্রম উৎকর্ষ সাধিত হয় গান থেকে বীরত্ব ব্যঞ্জক গান, তা থেকে বীরত্ব ব্যঞ্জক কাব্যের সৃষ্টি হয়। মূলত পাশ্চাত্য সাহিত্যে বিশেষত প্রাচীন পর্বে Epic বলতে বীরত্ব ব্যঞ্জক কাব্যকেই বোঝানো হতো, অবশ্য সংস্কৃত বা বাংলায় ‘মহাকাব্য’ শব্দটির মধ্যেই মহতের ব্যঞ্জনা থেকে গেছে।

মহাকাব্যের সংজ্ঞা: পাশ্চাত্য মত–

(i) মহামতি অ্যারিষ্টটলের (aristotile) মতে, মহাকাব্য আদি; মধ্য ও অন্ত সমন্বিত বর্ণনাত্মক কাব্য—এতে বিশিষ্ট কোনও নায়কের জীবন কাহিনি অখণ্ড রূপে একই বীরোচিত ছন্দের সাহায্যে কীর্তিত হয়। তিনি অকপটেই বলেছেন—“An epic should he based on a single antion, one that is a complete whole in itself. With a begining, middle and end, so as to enable the work to produce its own proper pleasure with all the organic Unity of a living creature…As for its metre, the heroie has been assigned it form experience.”

(ii) সমালোচক Dryden মহাকাব্যের সংজ্ঞা নির্ণয়ে বলেছেন একটি বিশেষ দেশের বস্তুগত আলোচনা হয়ে ওঠে সর্ব দেশের ও সর্বকালের দর্পণ। তাঁর ভাষায়—A heroie poem which epitomises the feeling of many ages and voices the aspiration and imagination of all people.

(iii) সমালোচক cuddon তার ‘A Dictionary of Literary terms and Theory গ্রন্থে মহাকাব্যের যে সংজ্ঞা দিয়েছেন, তা হল— “An epic is a long narrative poem, on a grand scale, about the deeds of warriors and heroes. It is a polygonal, heroic story is corporatong myth-legend, folk tele and history. Epics are oftern of national significance in the sense that they embody the history and aspirations of a nation in a lofty or grandiose manner.

(iv) The new prinception Encyclopedia’-তে epic-এর সংজ্ঞা নির্ণয়ে বলা হয়েছে— “An epic is a long narrative poem that treats a single heroie figure or a group of such figures and concerns an historical event, such as a was or conquest, or an heroie quest or someother significant mythic or legendary achievement that is central to the traditions and belief or its culure.”

(v) তবে অধিকাংশ সমালোচক epic-এর সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য নির্ধারণে যে অভিমত পোষণ করেছেন তার মূলীভূত বিষয় ছিল—’এ এক দীর্ঘ মহত্ব ব্যঞ্জক আখ্যান কাব্য যা ওজস্বী ভাষাও ছন্দে পরিপূর্ণ সুসংহত এবং যার নায়ক জাতীয় বীর বা দোষ গুণ সম্পন্ন, যার কার্য্যের ওপরে নির্ভর করে কোনও জাতি বা সমগ্র জাতীয় ভাগ্য। তাদের ভাষায়—“lt is a long narrative poem on a great Serious Subject, related in an elevated style, and centered on a heroie or quasidivine figure on whose actions depands the fote of a fribe, a nation, or the human race.”

প্রাচ্যমত–

(i) আলংকারিক বিশ্বনাথ কবিরাজ তার ‘সাহিত্য দর্পণ’ এ মহাকাব্য সম্পর্কে অভিমত পোষণ করেছেন—

“সর্গ বন্ধো মহাকাব্যং তত্রৈকো নায়কঃ সুরঃ

সদ্বংশঃ ক্ষত্রিয়োবাইপি ধীরোদাওগুণান্বিতঃ।। 

এক চংশ ভবা ভূপা কুলজা বহবোইপি বা।

শৃঙ্গার-বীর-শান্তানামেকোইঙ্গী রস ইষ্যতে।।

ইতিহাসোদ্ভবং বৃত্তমন্যদ্বা সজ্জনাশ্রয়ম্।

চত্বারস্তস্য বর্গা স্যুস্তেম্বেকঞ ফলং লভেৎ।।”

অর্থাৎ, মহাকাব্য হবে সর্গবন্ধে বিভাজিত, নায়ক হবে দেবতা বা সংকুলজাত, ধীরোদাত্ত গুণসম্পন্ন। রস হবে শৃঙ্গার বীর বা শাস্ত এবং ঘটনা কোনও ইতিহাস বা পুরাণ থেকে সংকলিত হবে।

(ii) রবীন্দ্রনাথ বলেছেন—“কালে কালে একটি সমগ্র জাতি যে কাব্যকে একজন কবির কবিত্ব শক্তি আশ্রয় করিয়া রচনা করিয়া তুলিয়াছে, তাহাকেই যথার্থ মহাকাব্য বলা যায়।”

(iii) সমালোচক শ্রীশ চন্দ্র দাস বলেছেন—‘ঐশী প্রেরণায় অনুপ্রাণিত নানা সর্গে বা পরিচ্ছেদে বিভক্ত যে কাব্যে কোনও সুমহান বিষয়বস্তুকে অবলম্বন করিয়া এক বা বহু বীরোচিত চরিত্র অথবা অতিলৌকিক শক্তি সম্পাদিত কোনও নিয়তি নির্ধারিত ঘটনা ওজস্বী ছন্দে বর্ণিত হয়, তাহাকে মহাকাব্য বলে।”

(iv) সমালোচক হীরেন চট্টোপাধ্যায় বলেছেন—“মিত ছন্দে ও বর্ণনাত্মক ভঙ্গিতে রচিত গুরু বিষয় বস্তু আশ্রিত ও সুনির্দিষ্ট আদি মধ্য অন্ত সমন্বিত এমন এক স্বয়ং সম্পূর্ণ আখ্যান, যার ঐক্য সম্বন্ধ হয় জৈবিক প্রকৃতির এবং প্রচুর বৈচিত্র্য সত্ত্বেও যা উদ্দিষ্ট রসানুভূতি জাগাতে পারে।”

(v) সমালোচক কুন্তল চট্টোপাধ্যায় বলেছেন—“যে দীর্ঘ ও মহত্বব্যঞ্জক আখ্যায়িকা কাব্য জাতীয় জীবনের ঐতিহাসিক বা পৌরাণিক বৃত্তান্ত এক বা একাধিক সমুন্নত ও বীরোচিত চরিত্রের কীর্তিকলাপকে অবলম্বন করে ওজস্বী ভাষা ও ছন্দে নানা সর্গে এক অখণ্ড, গরিমমণ্ডিত রূপে বর্ণিত হয় তাকেই বলা হয় মহাকাব্য। গীতি কবিতার একক, ‘আত্মনিষ্ট, হৃদয়ানুভূতির প্রকাশ নয়, দেশ ও জাতীর সংকট এ পরিবর্তনের বিপন্নতার অন্তর্লোক থেকে এক বস্তুনিষ্ট সমাজবীক্ষণ রূপে মহাকাব্যে জন্ম।”

সব মিলিয়ে বলতে হয়, বিভিন্ন ভাবে মহাকাব্যের সংজ্ঞা নির্ণয় করা হলেও মূলগত বৈশিষ্ট্যগুলিকে কেউই অস্বীকার করেননি। মহাকাব্য হল বস্তুনিষ্ঠ সমাজ বীক্ষণ সেই যুগ বা দেশের যখন জাতীয় সংকট বা বিপন্নতা হতে উদ্ধারকারী কোনও ব্যক্তি বিশেষের কীর্তি কাহিনি ও মহত্ব গৌরবের সঙ্গে বর্ণিত হয়।

বৈশিষ্ট: পাশ্চাত্যমত (অ্যারিষ্টটল কৃত) 

(i) মহাকাব্য হয় আদি মধ্য অন্ত্যযুক্ত নাট্যধর্মী বিকৃতমূলক পূর্ণাঙ্গ কাহিনি।

(ii) একজন নায়কের ঘটনা নিয়ে মহাকাব্য রচিত।

(iii) এক প্রকার ছন্দ, বীরত্ব ব্যঞ্জক Dactylic hexameter ব্যবহার করা দরকার। এ সম্পর্কে ফিলিপ সিড়নি জানিয়েছেন—মহাকাব্যের প্রত্যেকটি ঘটনা আমাদের মনকে যেমন মহৎভাবে উদ্বোধিত করে জ্ঞান সঞ্চার করে, তেমনি মহৎ চরিত্রের সুউচ্চ বর্ণনা আমাদের মনে মহৎ হবার বাসনা জাগ্রত করে। (An Apology for the poetrie) আর, সমালোচক W.M.Dixon ও মহাকাব্যের লক্ষণ নির্দেশ করতে গিয়ে বিষয়বস্তু, আখ্যান, চরিত্র ও রচনা রীতির ওপর জোর দিয়েছেন, বীর রসাত্মক হবে মহাকাব্য।

অন্যদিকে সমালোচক ড্রাইডেন জানিয়েছেন—বীরত্ব ব্যঞ্জক নাটক ও মহাকাব্যের বিষয় বস্তুও হবে প্রেম এবং বীরত্ব।

অর্থাৎ প্রত্যেক সমালোচক মহাকাব্য সম্পর্কে নিজ নিজ অভিমত পোষণ করলেও মহাকাব্যের গাম্ভীর্য ও বীরত্ব ব্যঞ্জক রীতিকে কিন্তু কেউ অস্বীকার করেননি।

প্রাচ্য মত্য (বিশ্বনাথ কবিরাজ কৃত)— 

(i) মহাকাব্যের আখ্যান বস্তু হবে পৌরাণিক বা ঐতিহাসিক।

(ii) মহাকাব্যের নায়ক ধীরোদাত্ত গুণ সমন্বিত কোনও দেবতা বা উচ্চ বংশ জাত নৃপতি। 

(iii) কম পক্ষে ন’টি ও সর্বাধিক তিরিশটি সর্গে মহাকাব্য বিভক্ত হবে; প্রতি সর্গের শেষে পরবর্তী সর্গের সূচনা থাকবে; বিভিন্ন সর্গ একই ছন্দে রচিত হবে, যদিও সর্গের শেষে অন্য বৃন্দ ব্যবহৃত হবে।

(iv) আশীর্বচন, নমস্ক্রিয়া বা বস্তু নির্দেশ দিয়ে মহাকাব্যের আরম্ভ।

(v) মহাকাব্যের পটভূমি হবে স্বর্গ মর্ত্য পাতাল প্রসারী। 

(vi) শৃঙ্গার, বীর ও শান্ত রসের একটি হবে প্রধান ও অন্যগুলি প্রধান রসের অঙ্গীরস। 

(vii) মহাকাব্যে প্রাকৃতিক জগৎ, মিলন বিরহ যুদ্ধ বিগ্রহ ইত্যাদি বর্ণনা থাকবে। 

(viii) রচনা হবে অলঙ্কার সজ্জিত ও রসভার সম্বলিত। 

(ix) মহাকাব্যের ভাষা হবে ওজস্বী ও গাম্ভীর্যপূর্ণ।

(x) প্রতি স্বর্গের নামাঙ্কন প্রয়োজন৷