মহম্মদ-বিন-তুঘলকের উদ্ভাবনী শক্তি ছিল অসীম। নানা শাস্ত্রে পণ্ডিত এই মধ্যযুগীয় শাসক প্রচলিত ব্যবস্থার গণ্ডির মধ্যে থেকে দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পাদনের পরিবর্তে নিত্যনতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করে তাঁর শাসন-প্রতিভাকে বিকশিত করতে অধিক আগ্রহী ছিলেন। জিয়াউদ্দিন বারাণী সুলতানের সংস্কারকামী পরিকল্পনা হিসেবে যেসব কর্মসূচির উল্লেখ করেছেন, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল দোয়াবে রাজস্ববৃদ্ধি, দিল্লি থেকে দেবগিরিতে রাজধানী পরিবর্তন, তামার মুদ্রার প্রচলন, খোরাসান অভিযান এবং কারাচল (বা কুর্মাচল) অভিযান। বারাণীর গ্রন্থ মহম্মদের রাজত্বকালের বিবরণের অন্যতম প্রধান উপাদান ; কিন্তু তিনি ঘটনার সন, তারিখ বা ধারাবাহিকতা সম্পর্কে উদাসীনতা দেখিয়েছেন। অন্যান্য বিবরণের ভিত্তিতে অনুমান করা যায় যে, সুলতান ১৩২৫-১৩৩৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তীকালে এই পরিকল্পনাগুলি রূপায়িত করতে সচেষ্ট ছিলেন।
মহম্মদ-বিন্-তুঘলকের ভূমিসংস্কার ও দোয়াবে করবৃদ্ধি :
সিংহাসনে আরোহণ করার অল্পকালের মধ্যেই মহম্মদ-বিন্-তুঘলক ভূমিসংস্কার বিষয়ে গভীর আগ্রহ প্রকাশ করেন। এক নির্দেশ জারি করে বিভিন্ন প্রদেশের আয়-ব্যয়ের হিসেব লিপিবদ্ধ করার ব্যবস্থা করেন। দাক্ষিণাত্য, বাংলাদেশ, গুজরাট-সহ অন্যান্য প্রদেশ থেকে নিয়মিত বার্ষিক আয়ব্যয়ের হিসেব দিল্লিতে পাঠানোর নিয়ম চালু করা হয়। সুলতান সম্ভবত বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে প্রচলিত ভূমিব্যবস্থার মধ্যে একটা সামঞ্জস্য রক্ষার উদ্দেশ্যে এই সকল ব্যবস্থা নিয়েছিলেন।
ভূমিব্যবস্থার ক্ষেত্রে যে কাজটি মহম্মদের হটকারিতা ও উদাসীনতার দৃষ্টান্তরূপে সমালোচিত হয়েছে, তা হল গঙ্গা-যমুনার মধ্যবর্তী দোয়াব অঞ্চলে ভূমিরাজস্বের হার বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত। ঠিক কোন্ সময়ে সুলতান এই ব্যবস্থা আরোপ করেছিলেন, তা বলা কঠিন। বারাণী এ বিষয়ে কিছু লেখেননি। ফেরিস্তা, বদাউনি প্রমুখের মতে, নতুন কর আরোপিত হয়েছিল ৭২৫-৭৩০ আল হিজরতে। ড. ঈশ্বরীপ্রসাদ, ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার প্রমুখ এই ঘটনাকে ১৩২৫-‘২৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে সম্পাদিত হয়েছিল বলে মনে করেন। ড. আগা মেহদী হোসেন মনে করেন, সুলতানের খোরাসান অভিযানের পরিকল্পনা ভেস্তে যাবার পর করবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। তাঁর ব্যাখ্যা হল খোরাসান পরিকল্পনা ব্যর্থ হবার পর সুলতান সেনাবাহিনী ভেঙে দিলে তাদের অনেকেই কৃষিকার্যে লিপ্ত হয়। এই গোষ্ঠী নতুন কর আরোপ হলে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। অর্থাৎ দোয়াবে করবৃদ্ধির ঘটনা ঘটেছিল ১৩৩০ খ্রিস্টাব্দের পর। অবশ্য অধিকাংশ আধুনিক ঐতিহাসিক এই মতের সাথে এক হতে পারেননি।
জিয়াউদ্দিন বারাণী এই ঘটনার বিস্তৃত বিবরণ দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন: “দোয়াবে রাজস্বের হার ১০ থেকে ২০ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়েছিল। সেই সঙ্গে রাজকর্মচারীরা অন্যান্য কর বা আবওয়াব আদায় করার জন্য কঠোরতা অবলম্বন করলে রায়তগণ দারিদ্র্য ও ধ্বংসের সম্মুখীন হয়। কৃষকদের মধ্যে বিদ্রোহ সংগঠিত হয়। অধিকাংশ জমি পতিত পড়ে থাকে। ফলে দিল্লির সন্নিকটস্থ অঞ্চল ও দোয়াবে ব্যাপক খাদ্যাভাব ও দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। একই সময়ে দীর্ঘ অনাবৃষ্টিজনিত প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে পরিস্থিতি শোচনীয় ও অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। কৃষকেরা জমি ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে সুলতান তাদের বন্য পশুর মতো আক্রমণের নির্দেশ দেন।” বারাণী ছিলেন ঘটনার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী লিপিকার। তাঁর বিবরণ থেকে প্রমাণিত হয় যে, সুলতানের রাজস্বনীতি এবং বর্ধিত রাজস্ব আদায় করার নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত দেশের কৃষক সমাজের ওপর চরম আঘাত হেনেছিল। তাদের দুঃখদুর্দশার অন্ত ছিল না। ভূমিরাজস্বের পাশাপাশি গৃহ-কর, পশুচারণভূমি কর ইত্যাদি বৃদ্ধি করে মহম্মদ তুঘলক কৃষক সমাজকে নিশ্চিত সর্বনাশের দিকে ঠেলে দিয়েছিলেন।
বারাণীর বিবরণের সত্যতা সম্পর্কে আধুনিক ইতিহাসবিদরা সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। গার্ডনার ব্রাউন (Gardner Brown) -এর মতে, দোয়াবে আরোপিত করভার খুব বেশি ছিল না এবং বারাণীর বিবরণে অতিরঞ্জনের ছাপ স্পষ্ট। ড. ঈশ্বরীপ্রসাদ মনে করেন, বারাণীর নিজস্ব জেলা বরণ এই ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত ছিল বলেই তিনি ঘটনার বিবরণে মনগড়া দুর্দশার ছবি এঁকেছেন। ফেরিস্তার মতে, দোয়াবে কর-বৃদ্ধির হার ছিল ৩ গুণ থেকে ৪ গুণ। ড. আর. পি. ত্রিপাঠী মনে করেন, মহম্মদ তুঘলক রাজস্ব যেভাবেই বৃদ্ধি করুন, তিনি আলাউদ্দিনের আমলের মোট উৎপাদনের ৫০ শতাংশের নিয়মকে নিশ্চয়ই অতিক্রম করেননি। আলাউদ্দিনের আমলের ৫০ শতাংশ রাজস্বের নিয়ম মুবারক খলজি ও গিয়াসউদ্দিন তুঘলক তুলে দিয়েছিলেন। মহম্মদ তুঘলক তাঁর পূর্বসূরিদের নমনীয় রাজস্বনীতির পরিবর্তন ঘটাতে চেয়েছিলেন বলেই জনমনে বিক্ষোভ সঞ্চারিত হয়েছিল। ব্রাউন মনে করেন, মহম্মদের রাজস্বের বর্ধিত হার জনগণের দুর্দশা বা দুর্ভিক্ষের মূল কারণ ছিল না। সুলতানের দুর্ভাগ্য যে, প্রায় একই সময়ে দীর্ঘস্থায়ী অনাবৃষ্টি তাঁর পরিকল্পনাকে বিপর্যয় ও সমালোচনার সম্মুখীন করেছিল। ড. ঈশ্বরীপ্রসাদও এই মত পোষণ করেন। হাজি-উদ্-দবির লিখেছেন : “রাজকর্মচারীরা রাজস্ব আদায়ের জন্য বাড়াবাড়ি করলে এবং নিপীড়ন করলে কৃষকেরা হতাশায় বিদ্রোহী হয়েছিল এবং জমি ছেড়ে চলে গিয়েছিল।” ঘটনা যাই হোক্, অধিকাংশ গবেষক মনে করেন, মহম্মদ তুঘলকের এই সিদ্ধান্ত জনসাধারণের দুর্দশার কারণ হয়েছিল। ড. মজুমদার লিখেছেন : “On the whole the step taken by the Sultan was highly reprehensible and the method of its execution, extremely cruel.” সুলতানের পরিকল্পনার ত্রুটি তাঁর করব্যবস্থার ব্যর্থতার জন্য যতটা দায়ী ছিল, তাঁর দুর্ভাগ্যও তার থেকে কম দায়ী ছিল না। তাই ড. ঈশ্বরীপ্রসাদ লিখেছেন: “Never were benevolent schemes of reform more cruelly frustrated by an evil fate than in the case of Muhammad-bin-Tughluq.”
মহম্মদ-বিন্-তুঘলক একই সাথে রাজকোষকে সমৃদ্ধ করতে এবং কৃষকশ্রেণিকে জব্দ করার উদ্দেশ্যে দোয়াবের কর বৃদ্ধি করেছিলেন বলে বদাউনি অভিমত প্রকাশ করেছেন। স্যার উলসী হেগ এই মত সমর্থন করেন। কিন্তু আধুনিক লেখকেরা এই মন্তব্যের বিরোধিতা করেছেন। কারণ জনসাধারণের দুর্দশার সংবাদ পাওয়ার পরে সুলতান তাদের অর্থ, খাদ্য এবং বলদ সাহায্য দিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলা করার চেষ্টা করেছিলেন। জলাভাব মেটানোর জন্য সরকারি খরচে বহু কুপও খনন করেছিলেন। অবশ্য তাঁর এইসব কল্যাণমূলক ব্যবস্থা সময়োচিত না-হওয়ার কারণে এবং কর্মচারীদের অসাধুতা ও দায়িত্বজ্ঞানহীনতার জন্য কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যপূরণে ব্যর্থ হয়েছিল। প্রজাদের দুর্দশা আদৌ লাঘব হয়নি। ব্যর্থ হলেও সুলতানের উদ্যোগ ছিল প্রশংসনীয়। কৃষি-উন্নয়নের ব্যাপারে মহম্মদের যে আন্তরিকতা ছিল, তার আর একটি দৃষ্টান্ত হল ‘দেওয়ান-ই-কোহ’ নামক স্বতন্ত্র কৃষি দপ্তর প্রতিষ্ঠা করা। এই দপ্তরের কাজ ছিল নির্দিষ্ট এলাকায় কৃষি উৎপাদনের জন্য সরকারি অনুদান ও ঋণ প্রদান করা। প্রথমে এজন্য ৬০ বর্গ মাইল জমি নির্দিষ্ট করা হয়। গরিব চাষিদের মধ্যে এই জমি বিলিবণ্টন করে সেখানে বিভিন্ন শস্য উৎপাদনের জন্য উৎসাহ দেওয়া হয়। এজন্য প্রথম দু বছরে সরকারি কোষাগার থেকে ব্যয় হয় ৭০ লক্ষেরও বেশি অর্থ। অবশ্য এক্ষেত্রেও মহম্মদ-বিন্ তুঘলক সাফল্য থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন। এই ব্যর্থতার কারণ সমগ্র পরিকল্পনা ও পরিস্থিতির মধ্যে লুকিয়েছিল।
প্রথমত, সুলতান পরীক্ষামূলকভাবে আবাদের জন্য যে অঞ্চলটিকে বেছে নিয়েছিলেন, তা আদৌ কৃষিকাজের উপযোগী ছিল না। একটা সম্পূর্ণভাবে অনাবাদী ভূখণ্ড এবং কৃষি উৎপাদনের দিক থেকে ভীষণভাবে অনিশ্চিত একটা অঞ্চলের ওপর এই পরীক্ষা করতে গিয়ে সুলতান ভুল করেছিলেন।
দ্বিতীয়ত, মহম্মদের এই পরিকল্পনাটি ছিল অভিনব এবং অভূতপূর্ব। এই ধরনের একটা প্রকল্প সফল রূপায়ণের জন্য দক্ষ নজরদারি ছিল আবশ্যিক। কিন্তু মহম্মদের কৃষি-দপ্তর আগাগোড়া এই কাজে উদাসীন ছিল। ফলে প্রাথমিক পর্যায়ে যখন প্রকল্পটির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আভাস পাওয়া যাচ্ছিল, তখনই প্রতিকারমূলক ব্যবস্থাদি নেওয়া সম্ভব হয়নি। যদি নেওয়া হত তাহলে জনগণের দুর্দশা এতটা অসহনীয় হয়ে উঠত না।
তৃতীয়ত, কৃষিক্ষেত্রে যে-কোনো পরীক্ষামূলক কর্মসূচির রূপায়ণের জন্য দীর্ঘ প্রাক্-সমীক্ষা, প্রস্তুতি এবং সময় প্রয়োজন। কিন্তু সুলতানের তাৎক্ষণিক ফললাভের সহজাত ত্রুটি তাঁকে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে প্ররোচিত করেছিল। মাত্র তিন বছর সময়কালে এই ধরনের কোনো পরিকল্পনার সফল রূপায়ণ ছিল একটি অবাস্তব চিন্তানির্ভর সিদ্ধান্ত। তাই ব্যর্থতা এসেছিল অনিবার্যভাবে।
চতুর্থত, চরম দারিদ্র্যগ্রস্ত কৃষকদের কাছে সুদুরপ্রসারী উন্নয়ন কর্মসূচির তুলনায় তাৎক্ষণিক সুখভোগের আবেদন ছিল বেশি। তাই তাদের অনেকেই প্রাপ্ত সরকারি অনুদানের পূর্ণ সদব্যবহার করতে চায়নি। অনেকেই কৃষি উন্নয়নের পরিবর্তে প্রাপ্ত অর্থকে অনুৎপাদক খাতে ব্যয় করেছিল।
পঞ্চমত, যে-কোনো উদ্ভাবনমূলক সংস্কার কর্মসূচির সফল রূপায়ণের জন্য একটি সংগঠিত ও দক্ষ কর্মীমণ্ডলীর প্রয়োজন। কিন্তু মহম্মদ তুঘলকের আমলে কৃষি পরিকল্পনার সাথে যুক্ত কর্মচারীদের সততা, দক্ষতা ও উদ্যমের যথেষ্ট অভাব ছিল। ফলে কৃষকদের কাছে সুলতানের প্রকৃত ইচ্ছা বা লক্ষ্য সম্পর্কে ভুল সংকেত পৌঁছেছিল। এমতাবস্থায় প্রজাসাধারণ প্রথম থেকেই মহম্মদ -তুঘলকের পরিকল্পনার প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করেছিল। এইভাবে সুলতান মহম্মদ তুঘলকের একটি সম্ভাবনাময় পরিকল্পনা কেবল ব্যর্থ হয়নি, সাম্রাজ্যের সংহতিকেও বিপন্ন করেছিল। অধ্যাপক এ. এল. শ্রীবাস্তব লিখেছেন, “এইভাবে ভূমিরাজস্বের ইতিহাসে একটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ পরিকল্পনা শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ ও পরিত্যক্ত হয়েছিল।”
মহম্মদ-বিন্-তুঘলকের রাজধানী স্থানান্তর :
সুলতান মহম্মদ-বিন-তুঘলকের শাসনতান্ত্রিক পরীক্ষানিরীক্ষার দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল দিল্লি থেকে দৌলতাবাদে রাজধানী স্থানান্তর (১৩২৮-২৯ খ্রিঃ)। পর্বতময় ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এই স্থানটির আদি নাম ছিল ‘দেবগিরি’। সুলতান কুতুবউদ্দিন মুবারক খলজি এর নাম পরিবর্তন করে ‘কুতুবাবাদ’ রাখেন। আবার মহম্মদ-বিন্-তুঘলক দক্ষিণের এই রাজ্যে রাজধানী প্রতিষ্ঠার পূর্বে এই এর নতুন নাম দেন ‘দৌলতাবাদ’। এই তথাকথিত রাজধানী পরিবর্তন ব্যবস্থা ছিল মহম্মদ তুঘলকের সবথেকে বিতর্কমূলক পদক্ষেপ। বারাণী, ইসামী, ইবন বতুতা, নিজামউদ্দিন আহমদ, ফেরিস্তা প্রমুখ মধ্যযুগীয় ঐতিহাসিক এবং ড. আগা মেহদী হোসেন, মহম্মদ হবিবউল্লাহ, মহম্মদ হাবিব, সৈয়দ মইনউল হক্, ঈশ্বরীপ্রসাদ প্রমুখ আধুনিক ঐতিহাসিক ও গবেষক সুলতানের এই পরিকল্পনা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। বারাণী, ইবন বতুতা, ইসামী প্রমুখের বিবরণ থেকে যে সকল বিতর্কের সূত্রপাত হয়েছে, তাদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হল—এই ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণে সুলতানের উদ্দেশ্য, পরিকল্পনাটি রূপায়ণের পদ্ধতি এবং এর প্রতিক্রিয়া ও পরিণতি।
দৌলতাবাদে রাজধানী স্থানান্তরের উদ্দেশ্য বর্ণনা প্রসঙ্গে বারাণী লিখেছেন যে, সুলতান মহম্মদ বিন্-তুঘলক ভারতের ভৌগোলিক পরিস্থিতির বিচারে দিল্লির তুলনায় অধিকতর একটি কেন্দ্রীয় অঞ্চলে রাজধানী স্থাপনের কথা চিন্তা করেন। সুলতানের বিচারে দৌলতাবাদ (দেবগিরি বা কুতুববাদ) ছিল সাম্রাজ্যের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত। এখান থেকে দিল্লি, গুজরাট, বাংলাদেশ, তেলেঙ্গানা, দ্বারসমুদ্র, কাম্পিল প্রভৃতি অঞ্চল ছিল প্রায় সমদূরত্বে অবস্থিত। অর্থাৎ একটি কেন্দ্রবর্তী অঞ্চল থেকে সমগ্র সাম্রাজ্যের ওপর প্রশাসনিক নজরদারি জোরদার করার উদ্দেশ্যে সুলতান রাজধানী স্থাপনের জন্য দেবগিরিকে বেছে নিয়েছিলেন। ইবন বতুতার বিবরণে সুলতানের কোনো প্রশাসনিক লক্ষ্যের কথা নেই। তিনি লিখেছেন : দিল্লির অধিবাসীরা সুলতানের প্রতি বিরূপ ছিলেন এবং তাঁরা সুলতানের নামে কুৎসাপূর্ণ চিঠি প্রেরণ করে তাঁকে উত্যক্ত করতেন। তাই তাদের জব্দ করার জন্য সুলতান দিল্লি ত্যাগ করে প্রজাদের দৌলতাবাদে যাবার নির্দেশ দেন। সুলতানের কঠোর নির্দেশের ফলে প্রায় সবাই দিল্লি ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়। মহম্মদ-বিন্-তুঘলকের চরিত্রের নৃশংসতা বোঝানোর জন্য ইবন বতুতা দুটি ঘটনার অবতারণা করেছেন—–(১) সুলতানের কর্মচারীরা অনুসন্ধান করে যখন দেখে যে, একজন অন্ধ ও একজন পঙ্গু ব্যক্তি দিল্লি ত্যাগ করেনি, তখন সুলতান পঙ্গু ব্যক্তিটিকে দূরে ছুঁড়ে হত্যার এবং অন্ধ ব্যক্তিটিকে টেনে-হিঁচড়ে দৌলতাবাদ নিয়ে যাবার নির্দেশ দেন। দীর্ঘ চল্লিশ দিন পরে দৌলতাবাদে পৌঁছে দেখা যায় যে, লোকটির একটি পা ছাড়া শরীরের সমস্ত অংশই টুকরো টুকরো হয়ে রাস্তায় থেকে গেছে। এবং (২) সুলতান গভীর রাত্রে প্রাসাদের ওপর থেকে দিল্লি শহরের দিকে তাকিয়ে যখন দেখতেন কোথাও আলোর রেশমাত্র নেই, ধোঁয়া বা প্রদীপের সামান্যতম শিখাও দেখা যাচ্ছে না, তখন সুলতানের হৃদয় ও আত্মা শান্তি অনুভব করত। ইসামীও প্রায় অনুরূপ ধারণা পোষণ করেন। তাঁর মতে, দিল্লির অধিবাসীদের সুলতান ‘শত্রু’ বলেই মনে করতেন। এবং দক্ষিণ ভারতে স্থানান্তরিত করে তাদের শক্তি খর্ব করাই ছিল সুলতানের লক্ষ্য। জনগণের প্রতি মহম্মদের আচরণকে ইসামী প্রাচীন ইরানের নৃশংস রাজা জাহাকের থেকেও কঠোর ও অমানবিক বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি লিখেছেনঃ “জাহাক ছিলেন ধর্মহীন, শয়তানের অনুচর। তিনি প্রতিদিন দুটি মানুষের মৃত্যু ঘটাতেন; কিন্তু আমাদের সুলতান যে-কোনো মুহূর্তে কয়েক হাজারের প্রাণনাশ করেন। জাহাক বেঁচে থাকলে, তার আচরণ মহম্মদ তুঘলকের তুলনায় উদার বলেই মনে হত।”
ড. নিজামী এই তিনটি বিবরণের যথার্থতা সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। দিল্লি থেকে দেবগিরি শাসন করা যদি অসম্ভব হয়, তবে দেবগিরি থেকে দিল্লিসহ উত্তর ভারত শাসন করাও একই রকম কষ্টকর হবে, — এ সত্য উপলব্ধি করার মতো বিচক্ষণতা মহম্মদ-বিন্-তুঘলকের মতো শাসকের নিশ্চয়ই ছিল। তাই কেন্দ্রস্থল হিসেবে নয়, বিশেষত দক্ষিণ ভারতে কার্যকর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করার জন্য হয়তো সুলতান এই পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। ইবন বতুতার বিশ্লেষণকে রাজধানী পরিবর্তনের উদ্দেশ্য না বলে প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখাই সংগত। তা ছাড়া, তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন যে, সুলতান ন্যায্যমূল্যে দিল্লিবাসীর ঘরবাড়ি ও অন্যান্য সম্পত্তি ক্রয় করে তাদের ক্ষতিপূরণ দিয়েছিলেন। সুতরাং, দিল্লিবাসীর প্রতি সুলতানের ক্ষোভের তত্ত্ব টেকে না। ড. নিজামী মনে করেন, সুলতান গুরুসাম্প এর বিদ্রোহ দমন করার পর দাক্ষিণাত্যের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার জন্য সেখানে একটি শক্তিশালী শাসনব্যবস্থা গড়ে তোলার আশু প্রয়োজন উপলব্ধি করেছিলেন। তাঁর সভসরা এজন্য উজ্জয়িনীকে কেন্দ্র করার পরামর্শ দেন। কিন্তু সম্রাট দেবগিরিকেই বেছে নেন এবং সেখানে একটি প্রশাসনিক কেন্দ্র স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেন। এটি ছিল সুলতানের সুপরিকল্পিত সিদ্ধান্ত, কোনো হটকারী পরিকল্পনা নয়।
অধ্যাপক মহম্মদ হাবিব এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর মতে, আলাউদ্দিন দক্ষিণ ভারতের সাথে দিল্লির দূরত্বের বিবেচনায় সেখানে সরাসরি নিয়ন্ত্রণ কায়েম করা থেকে বিরত ছিলেন। কিন্তু মুবারক শাহ সিংহাসনে বসে দেবগিরি থেকে যাদবদের হটিয়ে দেন এবং সেখানে দিল্লির শাসন কায়েম করেন। সদাহ আমির (আমিরান-ই-সদাহ্)-দের ওপর প্রশাসন ও কর সংগ্রহের দায়িত্ব দেন। মহম্মদ তুঘলক উপলব্ধি করেন যে, বরঙ্গলে দিল্লির কর্তৃত্ব স্থাপিত না হলে দেবগিরিতেও দিল্লির আধিপত্য স্থায়ী হবে না। তাই তিনি বরঙ্গলকে দিল্লির অন্তর্ভুক্ত করে সেখানেও সদাহ-আমিরদের হাতে শাসনভার ন্যস্ত করেন। কিন্তু তাতেও দাক্ষিণাত্যে মুসলমান শাসনের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত থেকে যায়। কারণ সমগ্র দাক্ষিণাত্যে মুসলমানের সংখ্যা ছিল নগণ্য। গুজরাট, রাজপুতানা ও মালবে সামান্যসংখ্যক মুসলমান বাস করত। আর দেবগিরিতে সরকারি কর্মী ছাড়া প্রায় সবাই ছিল হিন্দু। দাক্ষিণাত্যের হিন্দু সামন্তরা সংঘবদ্ধভাবে ক্ষমতা পুনর্দখলের ইচ্ছা পোষণ করতেন। এমনকি সদাহ আমিরগণ মুসলমান হলেও দিল্লির অধীনতাকে অমর্যাদাকর বলেই মনে করতেন। এমতাবস্থায় মহম্মদ-বিন্-তুঘলক দেবগিরিকে শাসনের কেন্দ্রে পরিণত করে দাক্ষিণাত্যে মুসলমান শাসন সুনিশ্চিত করার উদ্যোগ নেন। অধ্যাপক হাবিব লিখেছেন : “এই কাজের জন্য সুলতান দপ্তর স্থানান্তরের সঙ্গে সঙ্গে অতিন্দ্রীয়বাদী (Mystic) সুফিসাধকদের দেবগিরিতে আনার সিদ্ধান্ত নেন। কারণ তিনি দেখেছেন যে, উত্তর ভারতে এই সকল সুফিসাধক নিম্নবর্ণের বহু হিন্দুকে ইসলামে ধর্মান্তরিত করতে সক্ষম হয়েছেন। এঁরা ইসলামের শাসনকে দৃঢ় ভিত্তি দিয়েছেন। তাই দাক্ষিণাত্যেও এই সকল ধর্মগুরুদের এনে মুসলমানের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি করার সিদ্ধান্ত সুলতান গ্রহণ করেন।” ড. মেহদি হোসেনও এই মত সমর্থন করেন। তাঁর মতে, সুফিসাধকদের ধর্মভাবনা হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে সমন্বয়সাধন করতে সক্ষম হবে এবং ধর্মীয় উত্তেজনা হ্রাস পাবার ফলে সুলতানির ভিত্তি সুদৃঢ় হবে, এই কারণে সুলতান রাজধানী স্থানান্তরের সাথে সুফিসন্তদের নতুন রাজধানীতে গিয়ে খানকা স্থাপন ও মুসলিম-সংস্কৃতি প্রসারের আহ্বান জানান।
গার্ডনার ব্রাউনের মতে, মহম্মদ তুঘলক কর্তৃক দেবগিরিতে রাজধানী স্থানান্তর ছিল একান্তভাবে আর্থ-রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত এবং অনিবার্য। মোঙ্গলদের পুনঃপুন আক্রমণের ফলে দিল্লির নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক ভিত্তি শিথিল হয়ে পড়েছিল। সুলতান উপলব্ধি করেন যে, উত্তরের তুলনায় দক্ষিণ ভারতের অর্থনৈতিক অবস্থা অনেক সুদৃঢ়। তাই তিনি দক্ষিণ ভারতের কোনো শহরে রাজধানী স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। আধুনিক লেখকদের বিশ্লেষণ থেকে প্রতিষ্ঠিত হয় যে, মহম্মদ তুঘলক নিছক উদ্ভাবনী প্রবৃত্তি চরিতার্থ করার জন্য কিংবা দিল্লির অধিবাসীদের ওপর প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে, অথবা দক্ষিণ ভারতে ইসলামের সম্প্রসারণের জন্য রাজধানী স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নেননি।
বারাণী ও ইবন বতুতা দৌলতাবাদে রাজধানী স্থানান্তরের পদ্ধতি ও প্রকৃতি সম্পর্কে যে বিবরণ দিয়েছেন, আধুনিক গবেষকরা তার যথার্থতা সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছেন। ইয়াহিয়া সিরহিন্দির মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে ড. নিজামী প্রমুখ লিখেছেন যে, অন্তত দু-বছর আগে থেকে সুলতান রাজধানী পরিবর্তনের প্রস্তুতি শুরু করেছিলেন। শিরহিন্দি লিখেছেন, সুলতান ১৩২৬- ২৭ খ্রিস্টাব্দে দিল্লি ও দৌলাতাবাদের মাঝে প্রশস্ত রাস্তা, অসংখ্য সরাইখানা, বিশ্রামের জন্য রাস্তার দু-পাশে বৃক্ষরোপণ ইত্যাদি কাজ সম্পন্ন করেন। অতঃপর দলে দলে বিভক্ত হয়ে স্থানান্তরের কাজ শুরু হয়। প্রথমে সুলতানের মা মুকদুমা জাহান, আমির মালিক উচ্চপদস্থ কর্মচারীবৃন্দকে দেবগিরিতে পাঠানো হয়। অতঃপর শেখ, সৈয়দ, উলেমা প্রমুখকে নতুন রাজধানীতে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। শিরহিন্দির মতে, ১৩২৮-২৯ খ্রিস্টাব্দে স্থানান্তরের নির্দেশ কার্যকরী হয়। বারাণী লিখেছেন, দিল্লি পরিত্যাগ করার মুহূর্তে এবং দৌলতাবাদে প্রবেশ করার মুহূর্তে সুলতান প্রত্যেককে প্রীতি-উপহার প্রদান করে উৎসাহিত করেন। শেখ মুবারক লিখেছেন : “দৌলতাবাদে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে সুলতান বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের জন্য আলাদা আলাদা উপনগরী গড়ে তোলেন। প্রতিটি এলাকায় বাজার, স্নানাগার, মসজিদ, বেকারি ইত্যাদি এমনভাবে গড়ে তোলা হয় যাতে প্রতিটি এলাকা স্বনির্ভর হয়ে নিজেদের চাহিদা মেটাতে পারে।”
সুলতান সমস্ত শ্রেণির মানুষ, এমনকি দিল্লির কুকুর-বেড়ালকেও, নতুন রাজধানীতে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন বলে যা বলা হয়েছে, তা-ও সঠিক নয়। ড. হোসেন তৎকালীন লেখকদের মন্তব্য বিশ্লেষণ করে প্রমাণ করেছেন যে, সাধারণ মানুষ বা হিন্দুদের নতুন রাজধানীতে যাওয়ার জন্য কোনো চাপ সুলতান দেননি। স্বয়ং বারাণী এই ঘটনাকে “misfortune to the upper classes, as well as decline of the select and distinguished people” বলে উল্লেখ করেছেন। অর্থাৎ সুলতানের এই সিদ্ধান্তের ফলে সাধারণ মানুষের কোনো অসুবিধা হয়নি। ‘মতলব-উৎ-তালিবন’গ্রন্থে মহম্মদ বল্ক লিখেছেন যে, কেবলমাত্র অগ্রণী মুসলমানরাই দেবগিরি রওনা হয়েছিলেন; সাধারণ মানুষ নয়। ১৩২৭ ও ১৩২৮ খ্রিস্টাব্দে দিল্লিতে প্রাপ্ত দুটি সংস্কৃত লিপি থেকে প্রমাণিত হয় যে, ওই সময়ে দিল্লিতে হিন্দুরা সুখেই বসবাস করছিল এবং কৃপখনন ইত্যাদি উন্নয়নমূলক কাজও অব্যাহত ছিল। সুলতান মহম্মদকে ওই লিপিতে সুশাসক বলেও বর্ণনা করা হয়েছে। তা ছাড়া, দক্ষিণ ভারতে হিন্দু-আধিপত্য শিথিল করার জন্য সুলতান দিল্লি থেকে হিন্দুদেরই সেখানে নিয়ে যাবেন—এমন ধারণা করা হাস্যকর।
‘মাসালিক-ই-আবসর’ গ্রন্থের বিবরণ এবং ১৩৩০-৩১ খ্রিস্টাব্দে খোদিত দুটি মুদ্রার ভিত্তিতে আধুনিক কোনো কোনো গবেষক মনে করেন যে, সুলতান কখনোই দিল্লিকে রাজধানী শহর হিসেবে বর্জন করতে চাননি। ‘মাসালিক এ বলা হয়েছে, দিল্লি ছিল মহম্মদের প্রধান রাজধানী এবং দৌলতাবাদ ছিল দ্বিতীয় রাজধানী। দুই রাজধানীর মধ্যে যোগাযোগ রাখার জন্য নির্দিষ্ট দূরত্ব থেকে ঢোলের বাদ্যসংকেত ব্যবহার করা হত। মুদ্রা দুটিতে ‘তাখতাঘ-ই-দিল্লি’ এবং ‘তাখতাঘ-ই দৌলতাবাদ’ শব্দ দুটি ব্যবহার করে দুটি রাজধানীর অস্তিত্ব স্বীকার করা হয়েছে। এমনকি ইবন বতুতা স্বয়ং ১৩৩৪ খ্রিস্টাব্দে দিল্লিতে এসে নগরীর ব্যস্ততা, বিশালতা ও ব্যাপক জনসমাবেশ লক্ষ্য করেছেন। সেখানে জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিদের সংস্পর্শেও তিনি এসেছেন। অথচ এর তিন বছর পর আনুষ্ঠানিকভাবে দৌলতাবাদ থেকে পুনরায় দিল্লিতে প্রত্যাবর্তনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। তাই ড. হোসেন দৃঢ়তার সাথে বলেছেনঃ “Delhi never ceased to be the capital, and as such, was never depopulated or deserted.” অধ্যাপক এন. বি. রায় ঐতিহাসিকদের মতবৈচিত্র্যকে সমন্বিত করে। লিখেছেনঃ ‘পুরোনো রাজধানী (দিল্লি) কখনোই চূড়ান্তভাবে বর্জিত হয়নি। প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসেবে এর অধিষ্ঠান অব্যাহত ছিল। ১৩২৭-৩০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী কালেও সুলতানের ক্ষণিক উপস্থিতির কালে রাজপ্রাসাদে কলগুঞ্জন শোনা যেত। অবশ্য নগরীর জনস্ফীতি বা ব্যক্ততা কিছুটা ক্ষীণ হয়েছিল।” ড. নিজামীর মতে, মহম্মদ তুঘলক কর্তৃক রাজধানী স্থানান্তরের ঘটনাটির এত বিরূপ সমালোচনা হবার মূল কারণ হল বারাণী, ইসামী প্রমুখের ভ্রান্ত ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ব্যাখ্যা। বারাণীর কাছে দিল্লি ছিল। শুধুমাত্র অভিজাতদের শৌর্যবীর্য, বিলাসব্যসনের কেন্দ্রভূমি এবং সাধু, সম্ভ, ফকির ইত্যাদি ধর্মাচরণদের ক্ষেত্র। তাই এই দুই শ্রেণির অপসারণের ফলে দিল্লি তাঁর চোখে শ্মশানভূমিতে পরিণত হয়েছিল। ইসামীর বৃদ্ধ পিতামহ দৌলতাবাদ যাওয়ার পথে তিলপতে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন। তাই সুলতানের এই পরিকল্পনা ইসামীর লেখনীতে একটা বীভৎস রূপ পেয়েছে। ইবন বতুতা দিল্লির দুরবস্থার কথা লিখেছেন লোকমুখে শুনে। তাই ঘটনার ৪/৫ বছর পরে স্বয়ং দিল্লিতে এসে যে বিবরণ লেখেন, তাতে বিপরীত চিত্রই ফুটে উঠেছে।
একথা সত্য যে, সুলতানের রাজধানী স্থানান্তরের পদ্ধতি, সময়কাল ও লক্ষ্য সুচিন্তিত ছিল না। বিগত ১৬০ থেকে ১৭০ বছর ধরে দিল্লি তার প্রশাসনিক ঐতিহ্য গড়ে তুলেছে। ধর্মগুরুদের পীঠস্থান হিসেবেও দিল্লি একটা নির্দিষ্ট মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত। সুলতানি-প্রাসাদকে কেন্দ্র করে যেমন অভিজাতদের জীবনধারা, সুখদুঃখ, উত্থানপতন বয়ে চলেছিল, তেমনি হাজার হাজার ‘খানকা’, ধর্মশালা ও ধর্মগৃহকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছিল মৌলানা, দরবেশ, প্রমুখ সস্তসাধকদের জীবনদর্শন। একধরনের একাত্মতা সৃষ্টি হয়েছিল ভূমির সাথে তার অধিবাসীদের। ফলে সুলতান যখন তাদের অজানা প্রান্তরে যাওয়ার নির্দেশ দেন, তখন জনমনে একটা বিরূপ প্রতিক্রিয়া হওয়া ছিল খুবই স্বাভাবিক। পরিবর্তনের সময়টাও সঠিক ছিল না। প্রচণ্ড গ্রীষ্মে দীর্ঘ পথ (কম করে ৪০ দিনের যাত্রা) অতিক্রম করে নির্দিষ্ট স্থানে অনেকেই পৌঁছাতে পারেনি। যাঁরা পৌঁছাতে পারেন, তারাও দুঃখদুর্দশার জন্য সুলতানের সমালোচনায় মুখর হন। কিছুদিনের মধ্যে সুলতানও বুঝতে পারেন, তার পরিকল্পনা যথার্থ হয়নি। কারণ সুদূর দক্ষিণ ভারত থেকে উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের নিরাপত্তা বজায় রাখা দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছিল। শেষ পর্যন্ত ১৩৩৫-৩৭ খ্রিস্টাব্দে আবার তিনি সদলবলে দিল্লি প্রত্যাবর্তনের সিদ্ধান্ত নেন। বহু সমালোচনা, অজস্র অর্থব্যয় আর জনগণের চরম দুগর্তির পরে পরিত্যক্ত হয় সুলতানের এই পরিকল্পনা।
দেবগিরিতে দ্বিতীয় রাজধানী স্থাপনের প্রচেষ্টা শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হলেও এর সুদূরপ্রসারী সুফল লক্ষ্য করা যায়। অধ্যাপক সতীশ চন্দ্রের মতে, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটার ফলে উত্তর ভারত ও দক্ষিণ ভারত পরস্পরের নিকটে আসে এবং মুসলিম অভিজাত ও ধর্মগুরুদের দৌলতাবাদে বসবাসের ফলে উত্তর ভারতের তুর্কি-সংস্কৃতি, ধর্মীয় ও সামাজিক ভাবধারা দক্ষিণ ভারতে প্রসারিত হয়েছিল। এর ফলে উত্তর ভারত ও দক্ষিণ ভারতের মধ্যে এক নতুন সাংস্কৃতিক যোগসুত্র রচিত হয়। ড. নিজামী মনে করেন, মহম্মদ-বিন্-তুঘলক কর্তৃক দৌলতাবাদে মুসলিম জনসমাবেশের পরোক্ষ ফলই হল বাহমনী রাজ্যের সৃষ্টি। ড. সৈয়দ মইনুল হক্ এই মত সমর্থন করে লিখেছেন: “We cannot ignore the fact that the foundation and maintenance of Independent Musalman kingdom in the Deccan would not have been possible if we had not plated a strong muslim colony there.”
মহম্মদ-বিন্-তুঘলকের মুদ্রাসংস্কার :
মহম্মদ-বিন্-তুঘলকের পরীক্ষামূলক সংস্কার কর্মসূচির আর একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন ছিল প্রতীক-মুদ্ৰা (Token currency)-র প্রচলন। এই ধরনের শেষ মুদ্রার তারিখ ১৩৩১-৩২ খ্রিস্টাব্দ। ইসামী লিখেছেন : তিন বছর চালু থাকার পর এই প্রতীক-মুদ্রা তুলে নেওয়া হয়েছিল। তাই ধরে নেওয়া যেতে পারে যে, ১৩২৯-৩০ খ্রিস্টাব্দে সুলতান প্রতীক-মুদ্রার প্রবর্তন করেছিলেন। ভারতে প্রথম হলেও প্রতীক-মুদ্রার ব্যবহার তখনও বিশ্বের অন্যান্য দেশে চালু ছিল। বর্তমান কালে বিশ্বের প্রায় সকল দেশে স্বর্ণ বা রৌপ্যমুদ্রার পরিবর্তে কাগজের প্রতীক-মুদ্রা (নোট) বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে চালু আছে। স্বভাবতই মধ্যযুগে এই ধরনের অর্থব্যবস্থার প্রবর্তন মহম্মদ তুঘলকের উদ্ভাবনী প্রতিভা ও দূরদর্শিতার পরিচায়ক। তবে এই ব্যবস্থায় সুলতানের নতুন উদ্ভাবন ছিল না। ত্রয়োদশ শতকে চিন ও পারস্যে প্রতীক-মুদ্রার প্রচলন করা হয়েছিল। চিনে কুবলাই খাঁ (১২৬০-‘৯৪ খ্রিঃ) এবং পারস্যে কাইঘাটু খাঁ (১২৯৩ খ্রিঃ) নিজ নিজ দেশে প্রতীক-মুদ্রার প্রচলন করে খ্যাত হয়েছিলেন। অবশ্য চিনে এই নতুন মুদ্রাব্যবস্থা সফল হলেও পারস্যে হয়নি। যাই হোক, অতীত থেকে দৃষ্টান্ত গ্রহণ করে মহম্মদ তুঘলক ভারতে প্রতীক-মুদ্রা চালু করেন। এই নতুন মুদ্রায় ব্যবহৃত ধাতু সম্পর্কে প্রাথমিক কিছুটা মতভেদ আছে। বারাণী লিখেছেন : প্রতীক-মুদ্রায় তামা ব্যবহার করা হয়েছিল। কিন্তু ফেরিস্তার মতে, এই ধাতুটি ছিল ব্রোঞ্জ। দেশের নানা অংশ থেকে সংগৃহীত এবং জাদুঘরে সংরক্ষিত মহম্মদের প্রতীক-মুদ্রা পরীক্ষা করে তর্কবিশারদরা এটিকে ব্রোঞ্জ বলেই স্বীকার করেছেন। ইতিপূর্বে বিনিময়-অর্থ হিসেবে স্বর্ণমুদ্রা ‘দিনার, রৌপ্যমুদ্রা ‘টঙ্কা’ এবং তাম্রমুদ্রা ‘জিতল’ চালু ছিল। মহম্মদ-বিন-তুঘলক এখন টঙ্কার সমমানে (value) ব্রোঞ্জের নতুন মুদ্রা চালু করেন। বলা যেতে পারে, তিনি এখন জিতলকে কিছুটা পরিবর্তিত করে রূপার টঙ্কার সমান মূল্যে বাজারে চালু করেন। ইতিপূর্বে প্রচলিত মুদ্রাগুলিতে আরবি ভাষা খোদিত থাকত। নতুন ব্রোঞ্জ মুদ্রায় আরবির সাথে সাথে ফারসি ভাষাও খোদাই করা হয়। ফারসিতে লেখা হয় ‘সরকারি’ টাকশালে প্রস্তুত এই টঙ্কা মহম্মদ তুঘলকের আমলে প্রচলিত, যিনি (মহম্মদ) ঈশ্বরের কৃপাপ্রার্থী। অন্যদিকে আরবিতে লেখা হয় : “যিনি সুলতানকে মান্য করেন, তিনি ঈশ্বরকেও মান্য করেন ; ঈশ্বরকে মান্য করো; নবিকে মান্য করো এবং তোমাদের মধ্যে যাঁরা কর্তৃত্ব করেন, তাঁদের মান্য করো।” সম্ভবত, এই প্রতীক-মুদ্রা জনগণকে আগ্রহী করে তোলার উদ্দেশ্যে সুলতান এরূপ ধর্মীয় প্রেরণামূলক বাক্য ব্যবহার করেছিলেন।
মহম্মদ-বিন্-তুঘলক কর্তৃক প্রতীক-মুদ্রা প্রবর্তনের কারণ সম্পর্কেও কিছুটা বিতর্ক আছে। বারাণী লিখেছেনঃ সুলতান রাজকোষের শূন্যতা দূর করার জন্যই প্রতীক-মুদ্রা চালু করেছিলেন। তাঁর মতে, সুলতানের কয়েকটি ব্যর্থ সামরিক পরিকল্পনা, বদান্যতা ও দান-খয়রাতের ফলে রাজকোষ শূন্য হয়ে পড়েছিল। তাঁর প্রয়োজন হয়েছিল প্রচুর অর্থের। তাই স্বল্পমূল্যের ধাতু ব্যবহার করে নতুন মুদ্রা চালু করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ড. নিজামী, ড. হোসেন প্রমুখ অর্থাভাবকে প্রতীক-মুদ্রা প্রচলনের একমাত্র কারণ না বলে অন্যতম কারণ বলার পক্ষপাতী। দোয়াবের রাজস্ব আদায়ের ব্যর্থতা, মহামারী, রাজধানী স্থানান্তরের প্রস্তুতি প্রভৃতির ফলে রাজকোষের ওপর বিরাট চাপ পড়েছিল সত্য; কিন্তু রাজকোষ শূন্য হয়ে যায়নি। কারণ বারাণী নিজেই স্বীকার করেছেন যে, প্রতীক-মুদ্রাব্যবস্থা ব্যর্থ হবার ফলে সুলতান জনসাধারণের কাছ থেকে সংগৃহীত সমস্ত ব্রোঞ্জ টঙ্কার পরিবর্তে রাজকোষ থেকে সোনা বা রূপার টঙ্কা দিয়ে ক্ষতিপূরণ করেছিলেন। রাজকোষ শূন্য হলে এটা করা সম্ভব হত না। পক্ষান্তরে, আধুনিক ঐতিহাসিকেরা মুদ্রাবিশারদ নেলসেন রাইট (Nelson Wright)-এর মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে মনে করেন যে, চতুর্দশ শতকে বিশ্বব্যাপী রৌপ্যসংকট দেখা দিয়েছিল। বাংলা ও দক্ষিণ ভারত থেকে রূপা সংগ্রহের পরিমাণও কমে গিয়েছিল। মহম্মদ তুঘলক চরিত্রগতভাবে যে-কোনো সমস্যার মূলে প্রবেশ করে তার স্থায়ী সমাধান করার চেষ্টা করতেন। তাই রূপার সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি দেশের মুদ্রাব্যবস্থার একটা স্থায়ী সমাধানের জন্য ব্রোঞ্জমুদ্রার প্রবর্তনে উদ্যোগী হন।
মহম্মদ-বিন্-তুঘলক মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে প্রতীক-মুদ্রা চালু করলেও তার পরিণতি ছিল খুবই দুঃখজনক। সহজলভ্য ধাতু দ্বারা মুদ্রা তৈরি হওয়ার ফলে দেশে জাল মুদ্রায় ভরে যায়। আসল ব্রোঞ্জমুদ্রা এবং জাল-মুদ্রার প্রভেদীকরণ সহজ ছিল না বলে জনসাধারণ সহজেই তা গ্রহণ করে। বারাণী লিখেছেন : “প্রতিটি হিন্দুর গৃহ জাল-মুদ্রার কারখানায় পরিণত হয়েছিল। এখানে ‘হিন্দু’ বলতে তিনি সম্ভবত স্বর্ণকারদের কথা বলেছেন। কারণ তখন অধিকাংশ স্বর্ণকার ছিলেন হিন্দু। অবশ্য ঈশ্বরীপ্রসাদের মতে, বারাণী এত গোঁড়া ও পরধর্মবিদ্বেষী ছিলেন যে, এ ক্ষেত্রেও তিনি মুসলমানদের অব্যাহতি দিয়ে কেবল হিন্দুদের নামে দোষারোপ করেছেন, যদিও মুদ্রা জাল করার বিদ্যা সকলের অধিগত ছিল। যাই হোক্, জাল মুদ্রার যে ব্যাপক লেনদেন শুরু হয়েছিল তা বোঝা যায়। এমতাবস্থায় সাধারণ মানুষ সরকারি রাজস্ব-প্রদানের কাজে কেবলমাত্র ব্রোঞ্জমুদ্রা ব্যবহার করে এবং রৌপ্যমুদ্রা হস্তগত হলেও তা ঘরে লুকিয়ে ফেলে। ফলে সরকারি কোষাগারে রূপার আমদানি শূন্য হয়ে যায়। বিদেশি বণিকরা প্রতীক-মুদ্রার ধাতুমূল্য বিচার করে তাদের বাণিজ্যকর্মে তা গ্রহণ করতে অস্বীকার করে। সরকারকে দেয় শুল্ক বা দেশের মধ্যে কেনাকাটার সময় তারা ব্রোঞ্জমুদ্রা ব্যবহার করে, কিন্তু তাদের দ্রব্যাদি বিক্রয়ের সময় স্বর্ণমুদ্রা বা রৌপ্যমুদ্রা ছাড়া অন্য কিছু গ্রহণ করতে অস্বীকার করে। ক্রমে বিদেশি বণিকরা ভারতে দ্রব্য আমদানি প্রচণ্ডভাবে কমিয়ে দেয়। সুলতান তাঁর প্রতীক-মুদ্রার এই করুণ পরিণতি লক্ষ্য করে তিন বছরের মধ্যেই ব্রোঞ্জমুদ্রা প্রত্যাহার করে নেন। সমস্ত ব্রোঞ্জমুদ্রার পরিবর্তে মুদ্রার গ্রাহকদের স্বর্ণমুদ্রা বা রৌপ্যমুদ্রা প্রদান করা হয়।
এডোয়ার্ড টমাস মনে করেন, অর্থনৈতিক পরিকল্পনা হিসেবে সুলতানের প্রতীক-মুদ্রা প্রচলন অন্যায্য ছিল না। ড. মেহদী হোসেন সুলতানের এই পরিকল্পনার প্রশংসা করে লিখেছেন: “On the whole it was quite good and statesmanlike.” এঁদের বক্তব্য যে যথার্থ তার প্রমাণ বর্তমানে বিশ্বে প্রতীক-মুদ্রা (কাগজী নোট)-এর একচ্ছত্র আধিপত্য। তাই অর্থনীতির বিচারে সুলতানের এই পরিকল্পনা তাঁর প্রজ্ঞার পরিচায়ক। কিন্তু দুখঃজনক হলেও সত্য যে, সুলতানের এই পরিকল্পনাও ব্যর্থ হয়েছিল এবং তাঁর উদ্ভাবনী প্রতিভা কিছুটা সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছিল। প্রতীক-মুদ্রার বিফলতার কারণ হিসেবে ইতিহাসবিদেরা একাধিক কারণ উল্লেখ করেছেন। এল্ফিনস্টোন রাজকোষের দেউলিয়া অবস্থা ও সরকারের অস্থায়িত্বকে প্রতীক-মুদ্রার বিফলতার কারণ বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু ঈশ্বরীপ্রসাদ মনে করেন,—এ দুটি অভিযোগই যথার্থ নয়। কারণ সুলতান পরবর্তীকালে রৌপ্যমুদ্রা ও স্বর্ণমুদ্রার বিনিময়ে সমস্ত ব্রোঞ্জমুদ্রা বাজার থেকে তুলে নিয়েছিলেন। মুদ্রাবিশারদ এডোয়ার্ড টমাসের বিশ্লেষণটি বহুলাংশে সত্য। তিনি লিখেছেন : “সরকারি টাকশালে এবং বেসরকারি দক্ষ কারিগররা প্রায় একই ধরনের যন্ত্রে মুদ্রা তৈরি করত। কারণ এই সকল যন্ত্র বাজারে সহজলভ্য ছিল। সরকারি টাকশালে প্রস্তুত মুদ্রা এবং ব্যক্তিগতভাবে দক্ষ কারিগরদের তৈরি মুদ্রার প্রভেদ ধরার মতো কোনো ব্যবস্থা সরকারের ছিল না।” অথচ এটিই ছিল সহজলভ্য ধাতুমুদ্রা সচল রাখার প্রধানতম শর্ত। ব্রটমাস লিখেছেন : “চিনে প্রচলিত কাগজী-মুদ্রার নকল আটকানোর জন্য সরকার যতখানি সতর্ক ছিলেন, মহম্মদ তুঘলক তাঁর ব্রোঞ্জমুদ্রার ক্ষেত্রে ততটা ছিলেন না।” ফলে দেশে জাল মুদ্রা ছেয়ে গিয়েছিল। এখানে মহম্মদ হাবিবের ব্যাখ্যাটি প্রণিধানযোগ্য। হাবিব লিখেছেন: সেখানে মানুষ সোনা বা রূপার মুদ্রা গ্রহণ করার সময় পরশপাথরে ঘষে ধাতু পরীক্ষা করে নিত। সরকারি টাঁকশালে প্রস্তুত ব্রোঞ্জ মুদ্রাতেও ধাতু মিশ্রণের বৈশিষ্ট্য এমন ছিল, যা পাথরে ঘষলে ধরা পড়ত কিন্তু ধাতুর অনুপাত সহজে ধরা যেত না। সুলতান আশা করেছিলেন ব্রোঞ্জমুদ্রা গ্রহণের কালেও জনগণ ধাতু পরীক্ষা করে নেবে। কিন্তু সুলতানের আশা পূরণ হয়নি। সকলে সাধারণভাবে নতুন মুদ্রা গ্রহণ করার ফলেই জাল-মুদ্রার ব্যাপক প্রসার রোধ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। উলসী হেগ্ লিখেছেন : “সুলতান এরূপ নোট প্রচলনের কথা জানতেন, কিন্তু এর নীতি বা পদ্ধতি সম্পর্কে তাঁর কোনো ধারণা ছিল না।” তিনি স্বীকার করেছেন যে, উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করলে নতুন মুদ্রাব্যবস্থা বিফল হত না। ড. ঈশ্বরীপ্রসাদ লিখেছেন : “The scheme failed more on account of prejudice, ignorance and lack of proper safeguards than on account of any inherent defect.” টমাস বা ঈশ্বরীপ্রসাদের যুক্তি স্বীকার করে নিয়েও ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার মনে করেন, এ ধরনের একটি অভিনব ব্যবস্থা গ্রহণের মুহূর্তে কেবল তত্ত্বগত দিক নয়, প্রায়োগিক দিক সম্পর্কেও গবেষকের সচেতন থাকা উচিত ছিল। তিনি লিখেছেন : “One who cannot properly judge of the fitness or ripeness of the time for it or provide for and even think of adequate precaution to ensure its success, fully deserves condemnation.”
মহম্মদ-বিন্-তুঘলকের সামরিক পরিকল্পনা :
মহম্মদ-বিন-তুঘলক ছিলেন উচ্চাকাঙ্ক্ষী শাসক। সাম্রাজ্যের পরিধি বিস্তারের দিকেও তাঁর বিশেষ নজর ছিল। এমনকি ভারতের চিরাচরিত সীমানা অতিক্রম করে পার্শ্ববর্তী পার্বত্য অঞ্চলে সুলতানি কর্তৃত্ব সম্প্রসারিত করার দুঃসাহসিক পরিকল্পনাও তিনি গ্রহণ করেছিলেন। সামরিক পরিকল্পনাগুলির ক্ষেত্রে সুলতানের সাফল্য ও অসাফল্য দুইই ছিল। পরিকল্পনার মধ্যে অভিনবত্ব যেমন ছিল, তেমনি ছিল চিন্তাশক্তির গভীরতা। সম্ভবত, মোঙ্গল আক্রমণের পরে তিনি সীমান্তবর্তী কালানুর ও ফারাসুর (বা পেশোয়ার) আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। এজন্য তিনি সৈন্যদের একমাসের অগ্রিম বেতন এবং যুদ্ধের সাজসরঞ্জাম সংগ্রহের জন্য আরও কিছু অর্থ প্রদান করেন। মহম্মদ তুঘলক স্বয়ং এই অভিযানের নেতৃত্ব দেন। সুলতান নিজে লাহোরে অবস্থান করেন এবং মূল বাহিনীকে পেশোয়ারে যাওয়ার নির্দেশ দেন। বস্তুত, সম্ভাব্য মোঙ্গল আক্রমণের বিরুদ্ধে দিল্লির নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার জন্যই সুলতান এই অভিযানের পরিকল্পনা করেছিলেন। মোঙ্গলরা এই সকল অঞ্চলে মাঝেমাঝেই লুঠতরাজ চালাত এবং এখান থেকে রসদ সংগ্রহ করে ভারতের অভ্যন্তরে প্রবেশ করত। সুলতানি বাহিনী এই অভিযান দ্বারা এখানে বসবাসকারী মোঙ্গলদের বিতাড়িত করতে সক্ষম হয়। কিন্তু শস্যজাত খাদ্যের অভাবে সুলতানি বাহিনীর পক্ষে এখানে স্থায়ীভাবে অবস্থান করা সম্ভব হয়নি। রাজধানী স্থানান্তরের সময়কালেই সুলতান পুনার আট মাইল দক্ষিণে অবস্থিত কোন্ধালা দুর্গ (সিংহগড়)-টির বিরুদ্ধে এক অভিযান পাঠান। কোলি উপজাতীয়দের প্রচণ্ড প্রতিরোধ সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত এটি দিল্লির অধীনস্থ হয়।
মহম্মদ তুঘলকের সিংহাসনে আরোহণের সূচনাপর্বে চিতোরের বিরুদ্ধে সুলতানি-বাহিনীর সংঘর্ষ ও তার পরিণাম সম্পর্কে কিছুটা বিতর্ক আছে। টড্ (Tod)-এর ‘বিবরণী’ থেকে জানা যায় যে, আলাউদ্দিনের মৃত্যুর পর দিল্লি-সুলতানির দুর্বলতার সুযোগে রাজপুতরা, বিশেষত মেবার, পুনরায় শক্তি সঞ্চয় করে দিল্লির অধীনতা অস্বীকার করতে শুরু করেছিল। প্রতিভাবান যোদ্ধা ও সংগঠক রানা হামির (১৩০০-১৩৬৪ খ্রিঃ) ১৩২৬ খ্রিস্টাব্দে চিতোর দখল করে নেন এবং ক্রমে সমগ্র মেবারের ওপর নিজ কর্তৃত্ব স্থাপন করেন। তিনি ‘মহারাজা’ উপাধিও গ্রহণ করেন। তখন দিল্লি-সুলতানের প্রতিনিধি হিসেবে মালদেবের পুত্র জইজা মেবার শাসন করছিলেন। হামির কর্তৃক ক্ষমতাচ্যুত হয়ে তিনি সুলতান মহম্মদ-বিন্-তুঘলকের সাহায্যপ্রার্থী হন। এবং সুলতান স্বীয় ক্ষমতা পুনঃপ্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে মেবারের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন। কিন্তু সুলতান যুদ্ধে পরাজিত ও বন্দি হন এবং তিন মাস বন্দিজীবন কাটিয়ে বহু ক্ষতিপূরণের বিনিময়ে মুক্তি পান। ড. মেহদি হোসেনের মতে, সম্পূর্ণ ঘটনাটাই ভিত্তিহীন। বস্তুত, অন্য কোনো সূত্র থেকে এই ঘটনার সমর্থনও পাওয়া যায় না। ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার মনে করেন, বিষয়টাকে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন বলা চলে না। ১৪৩৮ খ্রিস্টাব্দের একটি ‘জৈনলিপি’ থেকে জানা যায় যে, রানা হামির একটি মুসলমান বাহিনীকে যুদ্ধে পরাজিত করেছিলেন। সুতরাং মহম্মদ তুঘলকের আমলে একটা রাজপুত-মুসলমান সংঘর্ষ হয়েছিল—এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। তা ছাড়া মহম্মদ তুঘলকের আমলে মেবারসহ সমগ্র রাজপুতানা অঞ্চল যে একপ্রকার স্বাধীন ছিল এবং অন্যান্য রাজপুত রাজ্যগুলি যে মেবারকে নেতৃত্বের মর্যাদা দিত, তা সমসাময়িক বিবরণ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়। সুতরাং রানা হামির কোনো যুদ্ধে মুসলমানদের পরাজিত করেছিলেন, এটা অসম্ভব নয়। তবে সেট পরাজিত বাহিনী সুলতানি বাহিনী ছিল এবং তার নেতা ছিলেন স্বয়ং সুলতান—–এ কথা বিশ্বাস করা যায় না। এক্ষেত্রে ড. গৌরীশংকর ওঝা-র মন্তব্যটি গ্রহণযোগ্য। ড. ওঝা’র মতে, মহম্মদ তুঘলকের আমলে প্রায় সমগ্র রাজপুতানা দিল্লির অধীনতামুক্ত হয়ে গিয়েছিল। তবে মেবারের সাথে যুদ্ধে সুলতান পরাজিত হয়েছিলেন—এ কথা প্রমাণ করা কষ্টকর। সম্ভবত, সেই সংঘর্ষে কোনো সাধারণ সেনাপতি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং মেবারের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন।
মহম্মদ-বিন্-তুঘলকের খোরাসান অভিযানের প্রস্তুতি :
তরমাশিরিনের অভিযানের অল্পকালের মধ্যে মহম্মদ-বিন-তুঘলক ট্রান্স-অক্সিয়ানা, খোরাসান এবং ইরাক জয়ের এক উচ্চাকাঙ্ক্ষী প্রকল্প গ্রহণ করেন। বারাণী সম্ভবত ভৌগোলিক জ্ঞানের অভাবহেতু খোরাসান অঞ্চলের সাথে ইরাককে যুক্ত করেছেন। ফেরিস্তা প্রমুখের বর্ণনা ও সমসাময়িক রাজনৈতিক পরিস্থিতি থেকে মনে করা হয়, সুলতান মধ্য-এশিয়ার খোরাসান ও তুরান অঞ্চলে অভিযান পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ফেরিস্তা লিখেছেন : “খোরাসান ও তুরানের কিছু অভিজাত সুলতানের দরবারে অতিথি হিসেবে অবস্থান করছিলেন এবং এঁরাই খোরাসানের অপদার্থ, অত্যাচারী শাসক আবু সৈয়দের বিরুদ্ধে অভিযান পাঠানোর জন্য সুলতানকে প্ররোচিত করেছিলেন।” তবে মহম্মদ তুঘলক কী উদ্দেশ্যে এই পরিকল্পনা নিয়েছিলেন, সে বিষয়ে বারাণী কিছু বলেননি। ড. নিজামী মনে করেন, ইল খাঁ বংশের পতন এবং তৈমুর লঙের উত্থানের মধ্যবর্তী কালে মধ্য-এশিয়ার রাজনীতিতে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছিল, তাকে কাজে লাগিয়ে মহম্মদ তুঘলক ওই অঞ্চলে নিজ-কর্তৃত্ব সম্প্রসারিত করতে আগ্রহী হয়েছিলেন। এজন্য তিনি ইজিপ্ট-সহ কয়েকটি বিদেশি রাষ্ট্রের সাথে মিত্রতাও গড়ে তোলেন। কিন্তু এক বছর প্রস্তুতির পর সুলতান এই পরিকল্পনা বাতিল করে দেন। সুলতান দীর্ঘ প্রস্তুতি ও প্রচুর অর্থব্যয়ের পরেও আকস্মিক কেন এই পরিকল্পনা বাতিল করলেন, সে বিষয়ে বারাণী কিছু বলেননি। ড. আগা মেহদী হোসেনের মতে, “ইরান, ইজিপ্ট ও ট্রান্স-অক্সিয়ানার রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক পালাবদলের মধ্যেই সুলতানের সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের কারণ নিহিত আছে।” আবু সৈয়দের সাথে ‘ইজিপ্টের আল নাসের’-এর মিত্রতা এবং তরমাশিরিনের ক্ষমতাচ্যুতির ফলে পরিস্থিতি পালটে যায়। এবং মহম্মদ তুঘলক বাধ্য হয়ে পরিকল্পনাটি বাতিল করে দেন।
বারাণী মহম্মদ তুঘলকের এই কাজটিকে তাঁর ভ্রান্ত বিদেশনীতির আর একটি দৃষ্টান্ত বলে উল্লেখ করেছেন। একথা সত্য যে, এই পরিকল্পনা রূপায়ণের উদ্দেশ্যে সুলতান রাজকোষের বহু অর্থ ব্যয় করেছিলেন। এজন্য সুলতান প্রায় ৩ লক্ষ ৭০ হাজার নতুন অশ্বারোহী সৈন্য সংগ্রহ করেছিলেন। সম্ভবত, এদের বেতনের হার ও অন্যান্য সুযোগসুবিধা ছিল খুবই বেশি। নচেৎ এত অল্প সময়ের মধ্যে প্রায় ৪ লক্ষ সৈন্য সংগ্রহ করা অসম্ভব ছিল। এই খোরাসান বাহিনীতে কেবল ভারতীয় নয়, মোঙ্গল, আফগান ইত্যাদি বহির্ভারতীয় জাতীয় লোকও ছিল। এই বাহিনী ছিল একান্ত অস্থায়ী এবং মূল সুলতানি-বাহিনীর অতিরিক্ত। স্বভাবতই এদের পেছনে যে অতিরিক্ত অর্থ অকারণে ব্যয়িত হয়েছিল, তা দেশের আর্থিক ভিতকে দুর্বল করেছিল। আধুনিক ঐতিহাসিকেরাও মনে করেন যে, সামগ্রিক বিবেচনায় এটিকে সুলতানের একটি হটকারী সিদ্ধান্ত বলেই অভিহিত করা যায়। পরিকল্পনা রূপায়ণের আগে তিনি ভৌগোলিক পরিস্থিতিকে বিচারের মধ্যে আনেননি। হিমালয় ও হিন্দুকুশের দুর্গম গিরিবর্ত্র অতিক্রম করে ওই দূরদেশে সেনাদল, রসদ ও সাজসরঞ্জাম নিয়ে যাওয়া এবং স্থানীয় উপজাতির বিরুদ্ধে দীর্ঘকাল লড়াই করে টিকে থাকা ছিল প্রায় অসম্ভব একটা চিন্তা। তা ছাড়া, রাজধানী স্থানান্তর, প্রতীক-মুদ্রার প্রচলন, অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ ইত্যাদি কারণেও সুলতানি প্রশাসন তখন বিব্রত ছিল। স্বভাবতই, আপাতবিচারে মধ্য-এশীয় অঞ্চলে কর্তৃত্ব প্রসারের সম্ভাবনা থকলেও, মহম্মদ তুঘলকের এই পরিকল্পনা সুবিবেচনাপ্রসূত ছিল না। মন্দের ভালো এই যে, সুলতান অন্তত পরিকল্পনাটি বাতিল করার সিদ্ধান্ত নিতে বেশি দেরি করেননি। নাহলে বিপত্তি আরও বৃদ্ধি পেত।
খোরাসান পরিকল্পনা পরিত্যক্ত হলেও মহম্মদ-বিন-তুঘলক রাজ্যবিস্তারের আশা সম্পূর্ণ ত্যাগ করেননি। ১৩৩৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি হিমালয়ের কাংড়া অঞ্চলে নগরকোট দুর্গের বিরুদ্ধে একটি অভিযান পাঠিয়েছিলেন। সামরিক গুরুত্বপূর্ণ এই দুর্গটি আলাউদ্দিনের সাম্রাজ্যবাদের যুগেও নিজের স্বাধীন অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছিল। এখন সুলতান মহম্মদ এটিকে দখলের চেষ্টা করেন এবং শেষ পর্যন্ত সফল হন। অবশ্য বশ্যতা স্বীকারের বিনিময়ে তিনি স্থানীয় অধিপতিকেই দুর্গের শাসনদায়িত্বে বহাল রেখেছিলেন।
মহম্মদ-বিন্-তুঘলকের কারাচল অভিযান :
মহম্মদ-বিন্-তুঘলক আনুমানিক ১৩৩৭-৩৮ খ্রিস্টাব্দে পার্বত্যভূমি কারাচল দখলের জন্য একটি অভিযান প্রেরণ করেন। এই স্থানটির নাম বিভিন্ন লেখক বিভিন্নভাবে দিয়েছেন, যেমন—কারাচিল, কারাজল, কুর্মাচল প্রভৃতি। কেবল নাম নয়, স্থানটির অবস্থান সম্পর্কেও কিছুটা বিরোধ লক্ষ্য করা যায়। ইবন বতুতা ও গার্ডনার ব্রাউনের বিশ্লেষণ থেকে অনুমান করা যায় যে, কারাচল বলতে হিমালয়ের কুমায়ুন-গাড়োয়াল অঞ্চলের কাংড়া জেলার কুলু অঞ্চলকে বোঝানো হয়েছে। বারাণীও এই স্থানটিকে ভারত ও চিনের মধ্যবর্তী অঞ্চল বলে উল্লেখ করেছেন। ড. মজুমদারও মনে করেন, এই স্থানটি হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত এবং বর্তমান কুমায়ুন বিভাগের অন্তর্ভুক্ত। মহম্মদ তুঘলক কর্তৃক কারাচল অভিযানের উদ্দেশ্য সম্পর্কেও কিছুটা মতভেদ আছে। বারাণী লিখেছেন : সুলতান খোরাসান অভিযানের পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে কারাচল দখল করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এ মত গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ দিল্লি থেকে খোরাসান অভিযানের পথে হিমালয়ের এই অঞ্চলটি পড়ে না। বরঞ্চ কারাচল পর্বতমালা চিন ও তিব্বত যাত্রাপথের অন্তর্ভুক্ত। সেই কারণে ফেরিস্তা লিখেছেন : সুলতান মহম্মদ চিন অভিযানের অংশ হিসেবে কারাচল অভিযান করেছিলেন। কিন্তু মহম্মদ চিন দখল করতে চেয়েছিলেন এমন কোনো প্রমাণ আদৌ পাওয়া যায় না। ইবন বতুতা সুলতানের সামরিক উদ্দেশ্যের কথা লিখেছেন। তাঁর মতে, কুমায়ুনের রাজপুত রাজ্যগুলিতে চিনারা প্রবেশ করে সামরিক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখলের চেষ্টা চালাতো। মহম্মদ চিনের গ্রাস থেকে এই সীমান্ত অঞ্চলকে রক্ষা করার জন্যই কারাচল অভিযানের সিদ্ধান্ত নেন। ড. মেহদী হোসেনের মতে, উত্তর সীমান্তের নিরাপত্তা বৃদ্ধির জন্য সুলতান এই অভিযানের সিদ্ধান্ত নেন। তিনি লিখেছেন : “The Qarachil expedition seems to have been sent to complete the chain of fortifications in the north.” ‘তারিখ-ই-মুবারকশাহি’গ্রন্থেও এই মতের সমর্থন পাওয়া যায়। এতে বলা হয়েছে যে, কুমায়ুনের পার্বত্য রাজ্যগুলি দিল্লি-সুলতানির বিরুদ্ধে বিদ্রোহে রত ব্যক্তিদের রাজনৈতিক আশ্রয় দিত। স্বভাবতই, এই অঞ্চল দখল করে সুলতান বিদ্রোহীদের আশ্রয়হীন করতে চেয়েছিলেন। হাজি দবির লিখেছেন : “কারাচলের সুন্দরী রমণীদের হারেমে বন্দি করার উদ্দেশ্যে সুলতান এই অভিযান করেছিলেন।”কিন্তু এটা সম্পূর্ণ অবাস্তব ও অসম্ভব একটা কল্পনা। কারণ মহম্মদ-বিন্-তুঘলকের চরিত্রে ধৈর্যহীনতা ছিল, কল্পনাবিলাস ছিল ; কিন্তু সামান্যতম ব্যভিচারিতা ছিল না।
মহম্মদ তুঘলকের ভাগিনেয় খসরু মালিকের নেতৃত্বে কারাচল অভিযান প্রেরিত হয়। বদাউনি ও হাজি দবির-এর মতে, সুলতানের সৈন্যসংখ্যা ছিল ৮০ হাজার। ইসামীর মতে, ১ লক্ষ সৈন্য কারাচল অভিযানে অংশ নিয়েছিল। বারাণী কোনো নির্দিষ্ট সংখ্যা দেননি। যাই হোক্, সুলতানি বাহিনী ‘জিদ্যা’ নামক স্থানটি দখল করতে সক্ষম হলে সুলতান তাঁর বাহিনীকে সেখানেই অবস্থান করার ও কর্তৃত্ব দৃঢ় করার নির্দেশ দেন। কারণ সুলতান জানতেন যে, আরও উঁচুতে উঠলে সুলতানি বাহিনীর পক্ষে সংকীর্ণ পাহাড়ি পথ ও জলবায়ু বিপজ্জনক হতে পারে। কিন্তু খসরু মালিক জয়ের আনন্দে সংকীর্ণ পথ ধরে আরও উঁচুতে উঠে যান এবং তিব্বত অভিমুখে এগোতে থাকেন। ইতিমধ্যে বর্ষা নেমে গেলে জলবায়ুর দ্রুত পরিবর্তন ঘটে। আকস্মিক প্লেগের আক্রমণ সুলতানি সেনার মনোবল নিঃশেষ করে দেয়। এই সুযোগ নেয় পার্বত্য উপজাতি। তাদের নিক্ষিপ্ত পাথর ও প্লেগের দাপটে সুলতানি বাহিনী প্রায় নিঃশেষিত হয়ে যায়। ইসামীর মতে, মাত্র ৬ হাজার সৈন্য প্রাণ নিয়ে দিল্লি ফিরে আসে। বারাণীর মতে, ৬ জন এবং ইবন বতুতার মতে, মাত্র ৩ জন কোনোক্রমে দিল্লি ফিরতে পারে। সংখ্যা যাই হোক ক্রুদ্ধ সুলতান তাদের প্রাণদণ্ডের আদেশ দেন। অবশ্য সামরিক অভিযান ব্যর্থ হলেও পার্বত্য অধিবাসীরা স্বেচ্ছায় সুলতানকে কর প্রদানে সম্মত হয়। ইবন বতুতা এবং ‘মাসালিক-উল-আবসর’ গ্রন্থে পার্বত্য উপজাতির বশ্যতা স্বীকার ও করদানের প্রসঙ্গ থাকলেও বারাণী বা ইসামী সম্ভবত সুলতানের প্রতি অন্ধ বিরূপতার কারণে ও প্রসঙ্গে নীরব থেকেছেন।
Leave a comment