ঊনবিংশ শতাব্দীর হিন্দু কলেজের ছাত্র ও ইংরেজি শিক্ষিত বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের মতো বঙ্কিমচন্দ্রও বেস্থাম, জন স্টুয়ার্ট মিল প্রভৃতি ব্রিটিশ দার্শনিকদের হিতবাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। বৃহত্তম জনসংখ্যার সুখস্বাচ্ছন্দ্য বা কল্যাণ এবং তার সঙ্গে ব্যক্তিজীবনের সঙ্গতিবিধানই সমাজের ভিত্তি—এটাই হল এই হিতবাদের মূল কথা। কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্র তার গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ না থেকে তাকে সম্প্রসারিত করে এক সর্বজনীন জীবনাদর্শের রূপ দিয়েছিলেন, তাঁর প্রচারিত সেই জীবনাদর্শ বা মানব প্রীতির আদর্শ ইংরেজ দার্শনিকদের হিতবাদের নিছক অনুকরণ নয়, সেটি বঙ্কিম মনীষার হিতবাদের সঙ্গে ভারতীয় ধর্মচেতনার সমন্বয়ের ফসল। বঙ্কিমচন্দ্রের এই উক্তিতে আমরা তার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত পাই : “হিতবাদ মতটা হাসিয়া উড়াইয়া দিবার বস্তু নহে। হিতবাদীদিগের ভ্রম এই যে, তাঁহারা বিবেচনা করেন যে সমস্ত ধর্মতত্ত্বটা এই হিতবাদ মতের ভিতরেই আছে। তাহা না হইয়া, ইহা ধর্মতত্ত্বের সামান্য অংশ মাত্র। আমি যেখানে উহাকে স্থান দিলাম, তাহা আমাদের ব্যাখ্যাত অনুশীলন তত্ত্বের একটি কোণের অংশমাত্র। তত্ত্বটা সত্যমূলক, কিন্তু ধর্মতত্ত্বের সমস্ত ক্ষেত্র আবৃত করে না। ধর্মভক্তিতে, সর্বভূতে সমদৃষ্টিতে সেই মহাশিখর হইতে যে সহস্র সহস্র নির্ঝরিণী নামিয়াছে—হিতবাদ ইহা তাহার একটি ক্ষুদ্র স্রোতঃ”। ভক্তি, সর্বভূতে সমদৃষ্টির ধর্মবোধ বঙ্কিমচন্দ্র ভারতবর্ষের ধর্মসাধনার ঐতিহ্য থেকেই লাভ করেছিলেন।

প্রবন্ধ, রঙ্গব্যঙ্গাত্মক রচনা, উপন্যাস প্রভৃতি বঙ্কিমচন্দ্রের বিভিন্ন ধরনের গদ্যরচনা এই মানব-প্রীতির জীবনাদর্শের আলোকে সমুজ্জ্বল। ব্যক্তির কামনাবাসনা যখন উদগ্র হয়ে ওঠে দুকুলপ্পাবী বন্যার মতো পারিবারিক সামাজিক জীবনের বন্ধনকে আঘাত করে, তখন যে সর্বনাশ বা বিপর্যয় দেখা দেয় সেটি শুধু ব্যক্তিগত বা পারিবারিক জীবনের নয়, সমগ্র সমাজ জীবনেরই, ‘চন্দ্রশেখর’, ‘বিষবৃক্ষ’, ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ প্রভৃতি উপন্যাসে বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর সেই ধর্মবোধভিত্তিক মানব প্রীতি তথা সমষ্টিগত জীবনের কল্যাণের জীবনাদর্শের পটভূমিতে প্রদর্শন করেছেন। কমলাকান্তের দপ্তরের কথক আফিমের নেশাখোর, অর্ধোন্মাদ কিন্তু জীবনের প্রকৃত সত্য উপলব্ধি করার মতো প্রজ্ঞাদৃষ্টির অধিকারী কমলাকান্তের বিভিন্ন উক্তির, আপাত উদ্ভট কল্পনা, রঙ্গব্যঙ্গের মধ্য দিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর জীবনদর্শনকে বিচিত্ররূপে প্রকাশ করেছেন। দপ্তরের ‘আমার মন’ শীর্ষক রচনায় তার মন কোথায় উধাও হয়ে গেল, সেই শূন্যতার কারণ অনুসন্ধান করার ছলে পৃথিবীতে কাম্য বা লোভনীয় বলে পরিচিত কোনো বস্তুই যে মানুষকে চিরস্থায়ী সুখ দিতে পারে না, মানব প্রীতিই তার একমাত্র উৎস, কমলাকান্ত সেই সত্য গভীর আবেগে উচ্চারণ করেছে : “আমি কখন কিছুতে মন বাঁধি নাই—এজন্য কিছুতেই মন নাই। এ সংসারে আমরা কি করিতে আসি, তাহা ঠিক বলিতে পারি না—কিন্তু বোধ হয়, কেবল মন বাঁধা দিতেই আসি। আমি চিরকাল আপনার রহিলাম—পরের হইলাম না, এইজন্যই পৃথিবীতে আমার সুখ নাই। যাহারা স্বভাবতঃ নিতান্ত আত্মপ্রিয়, তাহারাও বিবাহ করিয়া, সংসারী হইয়া, স্ত্রীপুত্রের নিকট আত্মসমর্পণ করে, এজন্য তাহারা সুখী। নচেৎ তাহারা কিছুতেই সুখী হইত না। আমি অনেক অনুসন্ধান করিয়া দেখিতেছি, পরের জন্য আত্মবিসর্জন ভিন্ন পৃথিবীতে স্থায়ী সুখের অন্য কোন মূল নাই।”

‘কমলাকান্তের দপ্তর’-এর প্রথম রচনা ‘একা’য় কমলাকান্তের প্রৌঢ় বয়সের আশাভঙ্গ ও নিঃসঙ্গতার বেদনার পটভূমিতে বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর এই জীবনদর্শনকে প্রকাশ করেছেন। জ্যোৎস্নাপ্লাবিত রাত্রির সৌন্দর্য দর্শনে উৎফুল্ল একজন পথিক তার মধুকণ্ঠের গানের মধ্যে মনের সুখের মাধুর্য বিকীর্ণ করে যাওয়ার সময় বহুকালবিস্মৃত সুখ স্বপ্নের স্মৃতির মতো ওই মধুর সংগীত কমলাকান্তের কানে প্রবেশ করে, সেই সংগীত কেন তার হৃদয়কে আলোড়িত করে তোলে সে তার কারণ অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হয়। রাত্রি জ্যোৎস্নাময়ী, নদীতীরে চাঁদের কিরণের হাসি, অর্থাবৃতা সুন্দরীর নীল বসনের মতো শীর্ণ-শরীরা নীল সলিলা তরঙ্গিনী, রাজপথে বালক-বালিকা, যুবক-যুবতী, প্রৌঢ়া, বৃদ্ধা চাঁদের কিরণে স্নাত হয়ে আনন্দিত; কমলাকান্তই শুধু আনন্দহীন, তাই ওই সংগীতে তার হৃদয়যন্ত্র বেজে ওঠে। সেই নিঃসঙ্গতার বেদনায় আর্ত হয়ে কমলাকান্ত সে সম্বন্ধে পাঠকদের সচেতন করে তুলতে চায় : “কেহ একা থাকিও না। যদি অন্য কেহ তোমার প্রণয়ভাগী না হইল, তবে তোমার মনুষ্যজন্ম বৃথা। পুষ্প সুগন্ধি, কিন্তু যদি ঘ্রাণ গ্রহণকর্তা না থাকিত, তবে পুষ্প সুগন্ধি হইত না—ঘ্রাণেন্দ্রিয়বিশিষ্ট না থাকিলে গন্ধ নাই। পুষ্প আপনার জন্য ফুটে না। পরের জন্য তোমার হৃদয় কুসুমকে প্রস্ফুটিত করিও।”

তারপরেই কমলাকান্ত আবার সেই পথচারীর সংগীতের প্রসঙ্গে ফিরে আসে এই সংগীত একবার শোনা মাত্রই তার কেন যে এত ভালো লাগল তা তো সে বলেনি। যৌবনকালে সে জগৎ ও জীবনের সমস্ত কিছুতেই সৌন্দর্য দেখতে পেত এবং আনন্দ অনুভব করতো, তখন সংগীত শুনে তার আনন্দ হত। সেই সময় চিত্তের যে প্রফুল্লতার জন্য কমলাকান্তের সংগীত ভালো লাগত, এই প্রৌঢ় বয়সে তা তিরোহিত হয়েছে বলেই সংগীত তার এখন ভালো লাগে না। সে মনের ভেতর মন লুকিয়ে সেই বিগত যৌবনসুখ চিন্তা করছিল, সেই সময় এই পূর্বস্মৃতিসূচক সংগীত তার কানে প্রবেশ করল, তাই এত মধুর বোধ হল।

সেই প্রফুল্লতা, সেই সুখ আর নেই কেন—নৈয়ায়িকের আলোচনার ভঙ্গিতে কমলাকান্ত এই প্রশ্ন উত্থাপন করে। সুখের বস্তু সঞ্চয় তো কমেনি। মানুষ জীবনের পথ যতই অতিবাহিত করে ততই সুখকর সামগ্রী সঞ্চয় করে চলে—“তবে বয়সে স্ফূর্তি কমে কেন? পৃথিবী আর তেমন সুন্দরী দেখা যায় না কেন? আকাশের তারা আর তেমন জ্বলে না কেন? আকাশের নীলিমায় আর সে উজ্জ্বলতা থাকে না কেন? যাহা তৃণপল্লবময়, কুসুমসুবাসিত, স্বচ্ছ কল্লোলিনী শিশিরসিক্ত, বসত্তপবনবিধৃত বলিয়া বোধ হইত, এখন তাহা বালুকাময়ী মরুভূমি বলিয়া বোধ হয় কেন? তার একমাত্র কারণ, যৌবনের সবথেকে বড়ো সম্বল আশারূপ রঙিন কাঁচ মানুষ পরিণত বয়সে হারিয়ে ফেলে। যৌবনে অর্জিত সুখ সামান্য, কিন্তু সুখের আশা অপরিমিত। এই প্রৌঢ়ত্বে কমলাকান্তের সুখের অর্জন অনেক, কিন্তু সেই বিশ্ব বিস্তীর্ণ আশা কোথায়? তখন সে জানত না কিসে কি হয়, অনেক আশা করত। এখন পরিণত বয়সের রূঢ় অভিজ্ঞতায় তাকে এই নিষ্ঠুর সত্য উপলব্ধি করতে হয়েছে, এই সংসারচক্রে আরোহণ করে যেখানকার আবার সেখানেই ফিরে আসতে হয়, যখন যে মনে ভাবছে এই অগ্রসর হল, তখন আসলে সে শুধু আবর্তন করেছে মাত্র। প্রৌঢ় বয়সের অভিজ্ঞতায় তাপদগ্ধ কমলাকান্ত এখন বুঝেছে, সংসার সমুদ্রে সাঁতার দিতে আরম্ভ করলে, তরঙ্গে তরঙ্গে প্রত্যক্ষ করে তাকে আবার তীরে ফেলে যাবে। প্রাপ্তি নয়, আশা-স্বপ্নসাধের পূর্ণতা নয়, আঘাত-বঞ্চনা, নৈরাশ্য, নিষ্ফলতাই জীবনের বাস্তব অমোঘ সত্য : “এখন জানিয়াছি যে, এ অরণ্যে পথ নাই, এ প্রান্তরে জলাশয় নাই, এ সাগরে দ্বীপ নাই, এ নদীর পার নাই, এ অন্ধকারে নক্ষত্র নাই। এখন জানিয়াছি যে কুসুমে কীট আছে, কোমল পল্লবে কণ্টক আছে; আকাশে মেঘ আছে। নির্মলা নদীতে আবর্ত আছে, ফলে বিষ আছে, উদ্যানে সৰ্প আছে; মনুষ্য হৃদয়ে কেবল আত্মাদর আছে।”

সংসারের এক সংগীত আছে, সংসারচক্রে রসিকেরাই তা শুনতে পায়, সেই সংগীত শোনার জন্য কমলাকান্তের চিত্ত ব্যাকুল। সে সংগীত সে কি আর শুনবে না, শুনবে, কিন্তু নানা বাদ্যধ্বনি সম্মিলিত বহু কণ্ঠপ্রসূত সেই পূর্বশ্রুত সংসার সংগীত শোনার সুযোগ তার আর হবে না, সে বয়েস নেই, সে আশা নেই। কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্র এই নৈরাশ্যে, নিষ্ফলতার বোধে ‘একা’র উপসংহার রচনা করতে পারেননি, তিনি তাঁর জীবন ভাবনায় কখনও নৈরাশ্যবাদী জীবন বিতৃষ্ণাকে সামান্য অন্ধকার ছায়াও ফেলতে দেননি। সেইজন্যই রচনাটির শেষ অংশে কমলাকান্ত বলেছে, সেই সংসার সংগীতের পরিবর্তে সে এখন যা শুনছে তা অধিকতর প্রীতিকর, কোনো পথের আশ্রয় ছাড়াই সেই সংগীত সে শুনতে পাচ্ছে “প্রীতি সংসারে সর্বব্যাপিনী—ঈশ্বরই প্রীতি। প্রীতি আমার কর্ণে এক্ষণকার সংসার-সংগীত। অনন্তকাল সেই মহাসংগীতের সহিত মনুষ্য-হৃদয়-তন্ত্রী বাজিতে থাকুক। মনুষ্য জাতির উপর যদি আমার প্রীতি থাকে তবে আমি অন্য সুখ চাই না”। প্রীতি ও ঈশ্বরের অভিন্নতা কল্পনা বঙ্কিমচন্দ্রের নিজস্ব, এর উপর পাশ্চাত্য আদর্শের প্রভাব নেই। প্রেমভক্তির যে আদর্শ বৈষ্ণবীয় চিন্তায় দেখা যায়, বঙ্কিমচন্দ্রকে তা আদৌ প্রভাবিত করতে পারেনি। এই উক্তিটি তাঁর নিজস্ব উপলব্ধির উপর প্রতিষ্ঠিত। এই আস্তিক্যবাদী মানবপ্রীতির দর্শন বঙ্কিমচন্দ্রের অন্যান্য রচনায় প্রকাশিত হলেও কমলাকান্তের মাধ্যমে ব্যক্তিহৃদয়ের আবেগ, কল্পনা ও মননশীলতার সমন্বয়ে, বহুসুরসমন্বিত ঐকতান সংগীতের মতো গীতিকবিতার আঙ্গিকের দিক থেকে আর একটু স্পষ্টভাবে বলতে গেলে আবেগ, রূপক, কল্পনা ও প্রবন্ধের মননশীলতার সমবায়ে এই জীবনদর্শন ‘একা’র যে বিচিত্র ব্যক্তি-হৃদয়ের আবেগস্পন্দিত রূপ লাভ করেছে তা সত্যই তুলনাহীন।