চৈতন্যপরবর্তী পশ্চিমবঙ্গের শ্রেষ্ঠ কবি। জন্মস্থান বর্ধমান জেলার কাদড়া গ্রাম। ভাগ্যের বিচিত্র পরিবেশের মধ্য দিয়ে তাঁর বাল্য শিক্ষালাভ ঘটে। রাজা বিষ্ণুদাসের সহোদর ভারামল্লের দাক্ষিণ্যে তিনটি গ্রাম লাভ করে সেখানেই স্থিতিলাভ করেন। এইসময় এক সন্ধ্যা মুহূর্তে মুচিনী বেশ। গী ‘মনসা’ কবিকে দেখা‌ দিয়ে কাব্যরচনার নির্দেশ দেন। তার কাব্যের রচনাকাল সম্ভবত সপ্তদশ শতক। ‘মনসার’ আর এক নাম ‘কেতকা”। কবির ভাষায়— “কিয়াপাতে জন্ম হৈল কেতকাসুন্দরী।” এই কেতকার স্তাবক বা দাস’ কবি নাম নিয়েছেন কেতকাদাস।

(১) সেলিমাবাদ পরগনায় কাঁথোরা গ্রামে তাঁর জন্ম। ১৯৪৩ খ্রীস্টাব্দে অধ্যাপক সতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্যের সম্পাদনায় ‘কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ’ গ্রন্থানুযায়ী জানা যায়, কাংখা গ্রামে কবির জন্ম (অধুনা কঁাথোরা গ্রাম নামে চিহ্নিত)। কিন্তু ড. পঞ্চানন মণ্ডলের মতে (দ্রষ্টব্য: ‘পুঁথি পরিচয়’) এ মত ঠিক নয়। এই দুই গ্রামের কাছে অবস্থিত কেথেরা গ্রামই পঞ্চাননবাবুর মতে কবি-কথিত কাথোরা গ্রাম। কবির পিতার নাম শঙ্কর। বারাখা নামে সেলিমাবাদের পালনকর্তার অধীনে ছিলেন পরে বিষ্ণুদাসের ভারমল্লের (জগন্নাথপুর) কাছে আশ্রয় নেন। মুকুন্দরামের কাব্যে এই সারা ভারমল্লের কথা আছে। তারকেশ্বর থানায় জগন্নাথপুর ভরামলপুর গ্রামে অবস্থিত। কবির সময় ভরামলপুর ছিল না।

(২) মুচিনী রূপিণী মনসা কবিকে কাব্য রচনার আদেশ দেন।

(৩) ক্ষেমানন্দের বহু পুঁথি পাওয়া যায় পূর্ণ এবং খণ্ডিত অবস্থায়। পশ্চিমবাংলার কবি হলেও পূর্ববঙ্গেও তাঁর কাব্য জনপ্রিয় ছিল। ১৮৪৬ খ্রীস্টাব্দে প্রথম যে মনসামঙ্গল মুদ্রিত হয় তা হলো ক্ষেমানন্দেরই পুঁথি। উনিশ শতকে তাঁর কাব্যই প্রথম ও সর্বাধিক জনপ্রিয়তা অর্জন করে।

(৪) তার কাব্যে নির্দিষ্ট রচনাকাল না থাকলেও উল্লিখিত ঐতিহাসিক চরিত্র থেকে তার কাব্যের কাল মনে হয় সপ্তদশ শতকের শেষ ভাগে লেখা।

(৫) কাহিনীকে শিল্পরূপ দান তার অন্যতম কৃতিত্ব। কাহিনী ও চরিত্রগত ঐক্য রক্ষার কৃতিত্ব এখানে লক্ষণীয়। চরিত্রচিত্রণও প্রশংসনীয়। তাঁর কাব্যে বর্ণিত মনসা অত্যন্ত হিংস্র। কালনাগিনীর লখিন্দর দংশনের মুহূর্তে তার দ্বিধা ও মমতা এবং অন্যদিকে মনসার নির্মমতার সূক্ষ্ম রূপায়ণ করে ক্ষেমানন্দ কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। তাঁর চাদ চরিত্রও স্মরণীয়। লখিন্দরের মৃত্যুসংবাদে চঁাদ চরিত্রের আচরণ এইভাবে বর্ণিত হয়েছে

“লোহার বাসরে মৈল বালা লখীন্দর।

শুনিয়া যে চাঁদ বাণ্যা হরষিত হৈল।

কান্ধে হেঁতালের বাড়ি নাচিতে লাগিল 

ভাল হৈল পুত্র মৈল কি আর বিষাদ। 

কানি চেঙ্গমুড়ি সনে ঘুচিল বিবাদ ।”

সনকা-চরিত্রে জননীর দুই রূপ। একদিকে তার বেহুলাকে ভর্ৎসনা অন্যদিকে বেহুলার যাত্রা সংবাদে তার জননীসুলভ মমতার পরিচয় লক্ষিত হয়

“সনকা কান্দিয়া বলে আ লো অভাগিনী। 

এ তিন ভুবনে ইহা কখনও না শুনি ।”

তার কাব্যের ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে। সপ্তদশ শতকের বাঙালীর জীবন এখানে জানা যায়। এছাড়া লখিন্দরের বিবাহ, জন্ম-প্রসঙ্গ ও বাঙালীর ষষ্টি পূজা, ইত্যাদির পরিচয় পাওয়া যায়। শিবের সাময়িক মৃত্যু সংবাদে গঙ্গার সহমরণ ইচ্ছার প্রস্তাবে সামাজিক প্রথার পরিচয় আছে।

আন্তরিকতা অথবা সরলতা নয়, পাণ্ডিত্যপূর্ণ প্রকাশভঙ্গী এবং সামাজিক রীতিনীতি ও ভৌগোলিক সংস্থানের বিশ্বস্ত বর্ণনা একাব্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তার কাব্যে বেহুলার স্বর্গপথে যাত্রার যে ২২টি ঘাট বা গ্রামের নাম আছে তার মধ্যে ১৪টি ঘাট বা গ্রাম এখনও দামোদর ও তার শাখা বাঁকা নদী এবং বর্তমান বেহুলা নদীর উভয় তীরে অবস্থিত। করুণ ও হাস্যরস সৃষ্টিতে কবির দক্ষতার পরিচয় পরিস্ফুট। কারুণ্যের মর্মস্পর্শী বর্ণনা

“প্রাণনাথ-কোলে কান্দে বেহুলা নাচনী। 

ঘরে হৈতে শোনে তাহা সোনকা বাণ্যানী ।।

ক্রন্দন শুনিয়া তার শুকাইল হিয়া। 

পুত্রবধূ দেখিবারে চলিল ধাইয়া !”

লৌকিক কাব্য এবং Ballad-এর মতো একটি প্রধান লক্ষণ, এর কোন কোন অংশে ইংরেজী refrain-এর মতো পুনরাবৃত্তি সৃষ্টি করা হয়েছে। তাতে ঘন রসাবেশ হয়। ‘লৌহবাসর’ বর্ণনায় এমনি একটি অংশে পুনরাবৃত্তি করবার ফলে ক্ষেমানন্দের কাব্যের রসগৌরব আধুনিক শিল্পসুষমায় সুশোভিত হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে

“কপাটের আড়ে থাকি উকি দিয়া যায়। 

বেহুলার নিদ্রা নাহি দেবীর কৃপায় ৷৷

কপাটের আড়ে দেখে ভীষণ ভুজঙ্গ। 

চমকি বেহুলা উঠে নিদ্ৰা হইল ভঙ্গ ৷৷”

তার পরিকল্পনায় বেহুলা কেবল আদর্শ গৃহবধূ নয়, কারুণ্যেরও আধার। প্রাচীনকালের নটীনৃত্যের পূর্ণাঙ্গ চিত্র বেহুলার নৃত্যের মাধ্যমে রেখায়িত হয়েছে। মুকুন্দরামের কাব্যের প্রভাব কেতকাদাসের কাব্যে আভাসিত হয়েছে। এই কার্যটি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে বিশেষ একটি কারণে স্মরণীয়, সেটি হল, মঙ্গলকাব্যধারার মধ্যে এই গ্রন্থটি প্রথম মুদ্রণ সৌভাগ্য লাভ করে। শ্রীরামপুর মিশনারীদের সহায়তায় এই গ্রন্থ প্রথম ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হয়।