মনসামঙ্গলে কানা হরিদত্ত :
বিজয়গুপ্তের কাব্যের সমস্ত সংস্করণেই অভিযোগ শ্লোকটি নেই। প্যারীমোহন দাশগুপ্তের বরিশাল সংস্করণে (১৩০৮) ‘স্বপ্নাধ্যায়’ পালায় এটি লক্ষিত হয়। হরিদত্তের কাব্য বিলুপ্ত। তবে দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার ময়মনসিংহ জেলার দিঘাপইৎ গ্রাম থেকে একটি পুঁথি পান। দীনেশচন্দ্রের ‘বঙ্গসাহিত্য পরিচয়ে ও বিজয়গুপ্তের ‘পদ্মাপুরাণের’ মধ্যে হরিদত্তের ভণিতাযুক্ত ‘পদ্মার সর্পসজ্জা’ নামে কয়েক ছত্র পাওয়া যায়—
“দুই হাতে শঙ্খ হইল গরল শঙ্খিনী।
কেশের জাল কৈল এ কালনাগিনী ।।
সুতলিয়া নাগ কৈল গলার সুতলি।
দেবী বিচিত্র নাগে কৈল হৃদয়ে কাঁচুলী ।।
সিন্দুরিয়া নাগে কৈল সিত্যের সিন্দুর।
কাজুলিয়া কৈল দেবীর কাজল প্রচুর ॥”
চিত্রটি চিত্তকর্ষক, যদিও অংশটির প্রামাণিকতা সন্দেহাতীত নয়। অস্ততঃ তিনজন কবি হরিদত্ত নাম নিয়ে বাংলা সাহিত্যের আসরে উপস্থিত কালিকাপুরাণের দাস হরিদত্ত, মনসামঙ্গলের বৈদ্যহরিদাস এবং নারায়ণ দেব ও বিজয়গুপ্ত উল্লেখিত কানা হরিদত্ত। হরিদত্ত প্রকৃত অর্থে কবি না গায়েন সে সম্বন্ধেও গবেষকরা একমত নন।
মনসামঙ্গলে বিপ্রদাস পিপ্লাই :
বিপ্রদাস মনসামঙ্গলের প্রাচীনতম কবি হিসাবেই সুবিদিত। কিন্তু তার কাব্যের চারখানি পুঁথির মধ্যে দু’খানির ভাষা অপেক্ষাকৃত আধুনিক কালের এবং অন্ততঃ তিনটি পুঁথি আদ্যোপান্ত খণ্ডিত। এশিয়াটিক সোসাইটি ও বিশ্বভারতী গ্রন্থাগারে বর্তমানে পুঁথিগুলি রক্ষিত। কিন্তু মূল পুঁথিটি বিলুপ্ত, এগুলি তার অনুলিপি মাত্র।
কাব্যের একটি পুঁথিতে “সিন্ধু ইন্দু বেদ মহী শক পরিমাণ” (অর্থাৎ ১৪১৭ শকাব্দ– ১৪৯৪ খ্রীস্টাব্দ) কালজ্ঞাপক শ্লোক পাওয়া গেলেও তার সঙ্গে অন্য পুঁথির বৈসাদৃশ্য বর্তমান। ড. সুকুমার সেনের মতে, কাব্যটি পঞ্চদশ শতকের শেষার্ধে রচিত। কিন্তু শব্দ ও ভাষাপ্রমাণের ভিত্তি অনুসারে ড. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিমত, “ইহাকে কিছুতেই ষোড়শ শতাব্দীর পূর্বে লওয়া যায় না।” কাব্যের প্রকৃত নামটিও পরিষ্কার নয়—‘মনসাবিজয়’, ‘মনসামঙ্গল’ এবং ‘মনসাচরিত’ তিনটি নামই পাওয়া যায়। কবির জন্মস্থান ২৪ পরগনা জেলার বসিরহাট মহকুমার অন্তর্গত বাদুড়িয়া বা নাদুড়্যা বটগ্রাম।
বিপ্রদাসের কাব্যে কাহিনীর ঘটনা বিস্তৃতি স্বচ্ছ ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ণ এবং বর্ণনাভঙ্গী আতিশয্য-বর্জিত। তাঁর কাব্যে হাসান হুসেনের পালাটি দীর্ঘায়ত এবং অন্যান্য মনসা মঙ্গল অপেক্ষা সুপরিকল্পিত। মুসলমান সমাজের বিবরণে অনুপুঙ্খতা আছে—
“মিঞা যবে ফৌত হইল গোলামের ঘোষ পাইল
বিবি লইয়া পলাইতে চায়।”
‘ব্রতগীত’ এবং ব্যালাডের লক্ষণে কাব্যটির কাহিনী রচিত। চরিত্র-চিত্রণে মনসার স্বরূপ যথেষ্ট স্বাভাবিক, স্নেহ-মমতা এবং করুণায় দ্রবীভূত। প্রাক্চৈতন্য যুগের ক্রূর কঠিনতা থেকেও চরিত্র মুক্ত। কিন্তু তুলনামূলকভাবে চাদ চরিত্র এখানে আদৌ গৌরবের আসনে প্রতিষ্ঠিত নয়। মনসার পদাঘাত পর্যন্ত তার কাম্য—“হাসি পদাঘাত কৈলা চাদের মস্তকে। অন্তরীক্ষ হইয়া দেবী রহিল কৌতুকে।”
চাঁদসদাগরের বাণিজ্য পথের মধ্যে কলকাতার উল্লেখ একাব্যে আছে। কিন্তু Stravonius-এর বিবরণী অনুসারে ১৭৭০ খ্রীস্টাব্দে কলকাতা নগররূপে আত্মপ্রকাশ করে। সেইজন্য বিপ্রদাসের কাব্যের সর্বাঙ্গীণ বিশুদ্ধি সম্বন্ধে সত্যই সংশয় জাগে।
Leave a comment