মার্কসীয় দৃষ্টিতে রাজনীতিক মতাদর্শ: মতাদর্শ সম্পর্কিত মার্কসীয় ধারণা পৃথক প্রকৃতির। ভাবধারা বা ধ্যান-ধারণার এক ব্যবস্থা হল মতাদর্শ। সমাজের আর্থ-সামাজিক চাল-চরিত্র প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এই ব্যব মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়। শুধু তাই নয়, এই ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রচলিত সামাজিক কাঠামো এবং বিশেষ সামাজিক শ্রেণীর উদ্দেশ্য, অবস্থান ও স্বার্থ সংরক্ষণ অথবা আমূল পরিবর্তনের ব্যবস্থা করা হয়। মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বলা হয় সামাজিক সচেতনতার সৃষ্টি হয় সমাজের অর্থনীতিক ভিত্তির উপর। এই সচেতনতার বিভিন্ন প্রকাশ আছে। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে ন্যায়-নীতি, ধর্ম, দর্শন, আইন, শিল্প প্রভৃতির কথা বলা যায়। যাই হোক এসবের মধ্যে মতাদর্শ হল সর্বোচ্চ সামাজিক সচেতনতা। এবং এই মতাদর্শ সামাজিক সচেতনতার অন্যান্য দিকগুলিকে প্রভাবিত করে। সমাজের আর্থ-সামাজিক সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে মতাদর্শের কাঠামো স্থিরীকৃত হয়। নির্দিষ্ট একটি সামাজিক শ্রেণীর স্বার্থ ও অবস্থান মতাদর্শের মাধ্যমে অভিব্যক্তি লাভ করে। সামাজিক চেতনার এই রকম প্রকাশই হল রাজনীতিক মতাদর্শ। রাজনীতিক মতাদর্শের মাধ্যমে কতকগুলি বিষয়ের সুসংবদ্ধ, সুবিন্যস্ত ও তাত্ত্বিক রূপ প্রকাশিত হয়। এই বিষয়গুলি হল রাষ্ট্রব্যবস্থা ও তার প্রকৃতি; বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণী ও গোষ্ঠীসমূহের পারস্পরিক সম্পর্কের প্রকৃতি; রাষ্ট্র, জাতি ও নির্দিষ্ট শ্রেণী; রাজনীতিক সংগঠন প্রভৃতি। রাজনীতিক মতাদর্শের মাধ্যমে সমাজের সঠিক চেহারা-চরিত্রের অভিব্যক্তি ঘটে। রাজনীতিক মতাদর্শ সামাজিক শ্রেণীগুলির মৌল স্বার্থটির ব্যাপারে সকলকে সচেতন করে তোলে। সংক্ষেপে রাজনীতিক মতাদর্শ মানুষকে শ্রেণী-সচেতন করে তোলে এবং এইভাবে শ্রেণী-সংগ্রাম ও বিপ্লবের পটভূমি প্রস্তুত করে।

বৈজ্ঞানিক ও অবৈজ্ঞানিক মতাদর্শ: মরিস কর্নফোর্থ (Maurice Conforth) তাঁর Dialectical Materialism শীর্ষক গ্রন্থে মতাদর্শ এবং মতাদর্শগত বিকাশ সম্পর্কে প্রাসঙ্গিক বক্তব্য ব্যক্ত করেছেন। তাঁর মতানুসারে মতাদর্শ হল সমাজ বিকাশের এক নির্দিষ্ট স্তরে নির্দিষ্ট কোন সামাজিক গোষ্ঠী কর্তৃক গড়ে তোলা সুবিন্যস্ত ধ্যান-ধারণা। আর মতাদর্শগত বিকাশ বলতে এই ধ্যান-ধারণার বিকাশকে বোঝায়। প্রকৃত প্রস্তাবে মার্কসীয় ধারণা অনুসারে বিশ্ববীক্ষ্যার একটি অংশ হিসাবে মতাদর্শের কথা বলা হয়। বিশেষ সামাজিক গোষ্ঠীর স্বার্থ, সামাজিক শ্রেণীসমূহের পারস্পরিক সম্পর্ক, রাজনীতিক ঘটনাবলী প্রভৃতি বিষয়ের সঙ্গে রাজনীতিক মতাদর্শ সম্পর্কযুক্ত থাকে। মার্কসবাদীরা আবার প্রকৃতিগত বিচারে রাজনীতিক মতাদর্শকে বৈজ্ঞানিক ও অ বৈজ্ঞানিক এই দু’ভাগে বিভক্ত করার পক্ষপাতী। তাঁদের মতানুসারে রাজনীতিক মতাদর্শটি বৈজ্ঞানিক হলে তার মাধ্যমে সমাজের যাবতীয় বৈষয়িক সম্পর্ক যথাযথভাবে প্রতীয়মান হয়। এ দিক থেকে মার্কসবাদ হল একটি বৈজ্ঞানিক মতাদর্শ। অপরদিকে সমাজের বৈষয়িক সম্পর্কসমূহ বিকৃতভাবে ব্যক্ত করলে তাকে অবৈজ্ঞানিক মতাদর্শ বলে। অবৈজ্ঞানিক মতাদর্শ বিভ্রান্তিকর চেতনার সৃষ্টি করে। এ ধরনের মতাদর্শে ভাববাদী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা হয় এবং ভাবধারা ও তত্ত্ব চিত্তার স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্র্য্যের উপর জোর দেওয়া হয়।

ভূমিকানুসারী শ্রেণীবিন্যাস: প্রত্যেক রাজনীতিক ব্যবস্থাতেই কোন-না-কোনো মতাদর্শের ভূমিকার অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। বিভিন্ন মতাদর্শের ভূমিকার মধ্যে পার্থক্য বর্তমান। এই ভূমিকার পরিপ্রেক্ষিতে মতাদর্শের নামকরণ ও শ্রেণীবিন্যাস করা হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে দক্ষিণপন্থী, বামপন্থী, রক্ষণশীল, প্রগতিশীল, প্রতিক্রিয়াশীল প্রভৃতি নামাঙ্কিত মতাদর্শের কথা বলা যেতে পারে।

বিভিন্ন মতাদর্শের মধ্যে মৌল বিষয়বস্তুগত পার্থক্য বর্তমান থাকে। এ বিষয়ে দ্বিমতের অবকাশ নেই। তবে ব্যবহারিক বা প্রায়োগিক ক্ষেত্রেই বিভিন্ন মতাদর্শের মধ্যে প্রকৃত পার্থক্য স্পষ্টত প্রতিপন্ন হয়। অনেকের মতানুসারে মতাদর্শ কোন শাশ্বত, চিরন্তন বা স্থিতিশীল বিষয় নয়। মতাদর্শের পরিবর্তন ঘটে। সমাজব্যবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে মতাদর্শের পরিবর্তন সম্পর্কযুক্ত। বাস্তবের সঙ্গে সামঞ্জস্য সাধনের জন্য পরিবর্তন প্রয়োজন।

মতাদর্শ সম্পর্কিত মার্কসবাদী বক্তব্যের বিভিন্ন দিক আছে। মতাদর্শ সম্পর্কিত মার্কসীয় ধারণার মৌলিক দিকগুলি সম্পর্কে আলোচনা করা আবশ্যক।

(১) মার্কসবাদীদের অভিমত অনুযায়ী সমাজের বিদ্যমান আর্থনীতিক বিন্যাস ও ব্যবস্থার দ্বারা মতাদর্শের আকৃতি-প্রকৃতি বহুলাংশে নির্ধারিত হয়। সমাজের আর্থনীতিক বিন্যাস বা বন্দোবস্ত মতাদর্শের চেহারা চরিত্রকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে।

(২) মতাদর্শ ও বিজ্ঞানের মধ্যে এবং সত্য ও মিথ্যার মধ্যে বৈসাদৃশ্য বা তুলনামূলক বিরোধিতার পরিপ্রেক্ষিতে মতাদর্শ সম্পর্কে মার্কসবাদীদের অবস্থান অনুধাবন করা যায়। অ্যান্ড্রু হেউড তাঁর Political Ideologies শীর্ষক গ্রন্থে এ বিষয়ে বলেছেন: “The contrast between ideology and science, between falsehood and truth, is … vital to Marx’s use of the term.” মার্কসবাদীদের বক্তব্য অনুসারে মতাদর্শে বিশ্বসংসার সম্পর্কে মিথ্যা ও প্রতারণাপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে চর্চা করা হয়। মতাদর্শ হল প্রতারণা-প্রবঞ্চনা এবং ধোঁকা-ধাঁধা সম্পর্কিত বিষয়। পরবর্তী কালে এঙ্গেলস মতাদর্শকে বলেছেন ‘ভ্রান্ত চেতনা’ (false consciousness)। মার্কস ‘মতাদৰ্শ’ এই শব্দটিকে একটি সমালোচনামূলক ধারণা হিসাবে ব্যবহার করেছেন। তদনুসারে সুসম্বন্ধ প্রবঞ্চনা প্রক্রিয়াকে অনাবৃত করাই হল মতাদর্শের উদ্দেশ্য।

(৩) শ্রেণী সমাজে শ্রেণী-স্বার্থসমূহের দ্বারা মতাদর্শসমূহ বিকৃত হয়। মতাদর্শ শ্রেণীব্যবস্থার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। মার্কস বিশ্বাস করতেন যে, মতাদর্শের মধ্যে বিকৃতি বর্তমান। কারণ শাসক শ্রেণীর স্বার্থই মতাদর্শের মাধ্যমে অভিব্যক্ত হয়। শাসকশ্রেণী নিজেদের শোষক-পীড়ক হিসাবে স্বীকার করতে চায় না। শাসকশ্রেণী শোষণ-পীড়নের সঙ্গে শোষিত-পীড়িতদের সংযুক্ত করতে চায়। এই উদ্দেশ্যে মতাদর্শকে ব্যবহার করা হয়। এই বক্তব্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে হেউড বলেছেন: Liberalism, which portrays rights that can only be exercised by the propertied and privileged as universal entitlements, is therefore the classic example of ideology.”

(৪) সামাজিক জ্ঞানের প্রচার প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রিত হয় শাসক শ্রেণী ও প্রধান্যকারী গোষ্ঠীসমূহের স্বার্থের দ্বারা। মতাদর্শ এই শাসকশ্রেণী ও প্রভাবশালী গোষ্ঠীসমূহের স্বার্থের অনুগত। পরস্পর বিরোধী সামাজিক কার্যপ্রক্রিয়াসমূহ থেকে ধ্যান-ধারণার সৃষ্টি হয়। এই সমস্ত ধ্যান-ধারণা পরস্পরবিরোধী সামাজিক প্রক্রিয়ার সৃষ্টিতে সাহায্য করে। মতাদর্শের কাজ হল বিদ্যমান উৎপাদন ব্যবস্থা এবং উৎপাদন সম্পর্কের সমর্থনে প্রচার চালানো; বিদ্যমান উৎপাদন সম্পর্ক সম্ভৃত কর্তৃত্ব ও অধীনতার সম্পর্ককে অব্যাহত রাখা। মার্কস ও এঙ্গেলস তাঁদের German Ideology শীর্ষক গ্রন্থে এ বিষয়ে বলেছেন: “The class which has the means of material production at its disposal, has control at the same time over the means of mental production, so that thereby, generally speaking, the ideas of those who lack the means of mental production, are subject to it.”

(৫) মতাদর্শ হল ক্ষমতার অভিব্যক্তি। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় বা শ্রেণীবিভক্ত সকল সমাজব্যবস্থায় শাসক-শোষক এবং শাসিত-শোষিত শ্রেণীর মধ্যে দ্বন্দ্ব-বিবাদ থাকে। মতাদর্শ এই দ্বন্দ্ব-বিবাদকে আড়াল করে; শোষিত সর্বহারাদের কাছ থেকে তাদের শোষিত হওয়ার ঘটনাকে গোপন করার বা চাপা দিয়ে রাখার চেষ্টা করে। এইভাবে মতাদর্শ এক অসম শ্রেণী-শক্তির ব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠিত রাখার ব্যাপারে উদ্যোগ আয়োজন গ্রহণ করে। হেউড বলেছেন: ‘Socialists, following Marx, have seen ideology as a body of ideas that conceal the contradictions of class society thereby promoting false consciousness and political passivity amongst subordinate classes.”

(৬) মার্কসের মতানুসারে মতাদর্শ হল সাময়িক বা অস্থায়ী একটি বিষয়। শ্রেণী ব্যবস্থাই মতাদর্শের জন্ম দেয় এবং মতাদর্শকে টিকিয়ে রাখে। শ্রেণী-ব্যবস্থা যত দিন টিকে থাকবে, মতাদর্শও ততদিন অব্যাহত থাকবে। শ্রেণীব্যবস্থার অবসান ঘটলে, মতাদর্শেরও মৃত্যু ঘটবে। সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত হলে শ্রেণীবৈষম্য দূর হবে, সম্পত্তির সমষ্টিগত মালিকানা কায়েম হবে। সর্বহারা শ্রেরীর মতাদর্শের প্রয়োজন থাকবে না। হেউড বলেছেন: “The proletariat, in short, does not need ideology because it is the only class that needs no illusions.”

(৭) পরবর্তী প্রজন্মের মার্কসবাদীরা মতাদর্শের ব্যাপারে অধিকতর আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। পরবর্তী কালের মার্কসবাদীদের মধ্যে মতাদর্শের অর্থ সম্পর্কে ধারণাগত পরিবর্তন ঘটেছে। এই সময়কার মার্কসবাদীরা বলতে শুরু করেন যে, সকল শ্রেণীরই স্বতন্ত্র মতাদর্শ বর্তমান। হেউড এ বিষয়ে বলেছেন: “Later Marxists adopted a neutral concept of ideology, regarding it as the distinctive ideas of any social class, including the working class.” এ প্রসঙ্গে লেনিন ও গ্রামসির নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁদের অভিমত অনুসারে মতাদর্শ বলতে কতিপয় ধারণার সমষ্টিকে বোঝায়। বিশেষ সামাজিক শ্রেণীর স্বার্থের বাহক হিসাবে মতাদর্শ কাজ করে। প্রত্যেক সামাজিক শ্রেণী তার মতাদর্শের জন্ম দেয়। বুর্জোয়া মতাদর্শ বুর্জোয়া শ্রেণীস্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করে। সর্বহারা শ্রেণীর মতাদর্শ মেহনতী মানুষের স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করে। What is to be done? শীর্ষক রচনায় লেনিন বলেছেন সর্বহারাদের মতাদর্শ হল ‘সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শ’ (‘Socialist ideology) বা ‘মার্কসবাদী মতাদর্শ’ (Marxist ideology)। হেউড বলেছেন: “For Lenin and most twentieth century Marxists, ideology referred to the distinctive ideas of a particular social class, ideas that advance its interests regardless of its class position.” অ্যান্টোনিয়ো গ্রামসি (Antonio Gramsci)-র অভিমত অনুযায়ী সমাজের প্রতিটি পর্যায়ে মতাদর্শ সম্পৃক্ত; শিল্প-সাহিত্য, শিক্ষা ব্যবস্থা, গণ-মাধ্যম, গণ-সংস্কৃতি প্রভৃতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে মতাদর্শের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা যায় না।