সনাতন সামাজিক ও রাজনীতিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের প্রয়োজনবোধের পরিপ্রেক্ষিতে মতাদর্শ সম্পর্কিত ধারণার মৌলিক সংস্কার সাধিত হয়। বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশক থেকে ‘মতাদর্শ’ প্রত্যয়টি ব্যাপকতর ব্যঞ্জনা অর্জন করে। একে বলা হয় মতাদর্শের সামাজিক-বৈজ্ঞানিক ধারণা। এই ধারণা অনুসারে মতাদর্শ হল নিরপেক্ষ প্রকৃতির একটি বস্তুনিষ্ট বিষয়। তদনুসারে মতাদর্শ সত্যও নয়, মিথ্যাও নয়; ভালও নয়, মন্দও নয়; উন্মুক্তও নয়, আবদ্ধও নয়; স্বাধীনতামূলক নয়, পীড়নমূলকও নয়। অর্থাৎ মতাদর্শ এরূপ সব রকমেরই হতে পারে। এদিক থেকে বিচার করলে মতাদর্শ হল ক্রিয়া-প্রক্রিয়া সম্পর্কান্বিত চিন্তাধারার এক ব্যবস্থা।

মতাদর্শ সম্পর্কিত সামাজিক বৈজ্ঞানিক ধারণা সুবিধাজনক বলে বিবেচিত হয়। কারণ এই ধারণা বা দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত অন্তর্ভুক্তিমূলক বা বিশেষভাবে পরিবেষ্টক। যে কোন মতবাদকে এই দৃষ্টিভঙ্গির আওতায় আনা যায়। উদারনীতিবাদ, মার্কসবাদ, ফ্যাসিবাদ প্রভৃতি সকল মতবাদকেই এই ধারণার অন্তর্ভুক্ত করা যায়। আবার মতাদর্শ সম্পর্কিত যে কোন নিরপেক্ষ ধারণার কিছু সীমাবদ্ধতাও আছে। নিরপেক্ষ অবস্থান ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রকৃতির কারণে এই ধারণা তার স্বাভাবিক ধার হারিয়ে ফেলে। সীমাবদ্ধতার কথা বলতে গিয়ে হেউড বলেছেন: “..in off-loading its political baggage the term may be rendered so bland and generalized that it loses its critical edge altogether.”

উপসংহার: মতাদর্শ কাকে বলে, সে বিষয়ে বিবিধ দৃষ্টিভঙ্গি বর্তমান। মতাদর্শের অর্থ সম্পর্কিত বক্তব্যের বিভিন্নতা অনস্বীকার্য। উপরের আলোচনাসমূহ থেকে তা স্পষ্টত প্রতিপন্ন হয়। যাইহোক উপরের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে মতাদর্শের অর্থ সাধারণভাবে ও সংক্ষেপে আলোচনা করা আবশ্যক।

মতাদর্শ হল জনগণের কাছে একটি দৃষ্টিশক্তি। এই দৃষ্টি দিয়েই ব্যক্তিবর্গ তাদের চারপাশের দুনিয়াকে দেখে। মতাদর্শ সূত্রে মানুষজন কিছু ধারণা, বিশ্বাস ও অবিশ্বাস লাভ করে। এসবের সাহায্যেই ব্যক্তিবর্গ তাদের রাজনীতিক পরিবেশ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এই মতাদর্শই মানুষকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে অনুপ্রাণিত করে। প্রকৃত প্রস্তাবে বিশেষ সামাজিক গোষ্ঠী বা শ্রেণীর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত বিশ্বাসসমূহের এক ধরনের সমাহার হল এই মতাদর্শ। বাস্তবে সমাজ কীভাবে কাজ করে বা সমাজের কিভাবে কাজ করা উচিত সে বিষয়ে একটি সামাজিক শ্রেণীর বা গোষ্ঠীর বিবিধ বিশ্বাস বর্তমান থাকে। মতাদর্শ হল এই সমস্ত বিশ্বাসেরই এক সমষ্টিগত অভিব্যক্তি। মতাদর্শ হল কতিপয় ধারণাসমূহের এক বিশেষ বিন্যাস। এই বিন্যাস বেশ আঁটোসাটো হতে পারে, আবার আলগা ধরনের হতে পারে। মতাদর্শ সমাজের একটি রূপরেখা চিত্রিত করে এবং একটি রাজনীতিক কর্মসূচী প্রদান করে। সুতরাং মতাদর্শের মধ্যে বর্ণনামূলক এবং নীতিমানমূলক উভয় ধরনের উপাদান বর্তমান থাকে। বিশেষ ধরনের মানবিক সম্পর্কসমূহ, সামাজিক সংগঠনসমূহ এবং ক্ষমতার বিশেষ ধরনের বন্টন ব্যবস্থা মতাদর্শের মাধ্যমে ব্যাখ্যাত হয় এবং ন্যায্যতা প্রাপ্ত হয়। মতাদর্শের মাধ্যমে নির্দিষ্ট সমাজের আর্থনীতিক, সামাজিক ও রাজনীতিক বিন্যাস ও মূল্যবোধসমূহ আলোচিত হয়। এই সমস্ত বিষয়ের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণও মতাদর্শে পাওয়া যায়। বিদ্যমান সামাজিক-রাজনীতিক কাঠামোসমূহ ও সম্পর্কসমূহের সংরক্ষণ, সংশোধন বা পরিবর্তনের ব্যাপারে মতাদর্শকে ব্যবহার করা হয়। অভিপ্রেত আদর্শ ব্যবস্থা এবং বিদ্যমান সামাজিক-রাজনীতিক ব্যবস্থা মোটামুটিভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ হলে স্থিতাবস্থা সংরক্ষণের জন্য ছোটখাট এবং সংশোধনমূলক ব্যবস্থাদি অবলম্বন আবশ্যক বিবেচিত হতে পারে। বিপরীতক্রমে বিদ্যমান বাস্তবতা ও অভিপ্রেত আদর্শের মধ্যে ব্যাপক ব্যবধান থাকলে প্রচলিত সামাজিক রাজনীতিক ব্যবস্থার আমূল সংস্কার সাধনের জন্য সুসংগঠিত কর্মসূচী প্রণয়ন ও প্রয়োগের প্রয়োজন দেখা দেয়। সুতরাং মতাদর্শ হল রাজনীতিক। কারণ মতাদর্শ হল কার্য সম্পাদনমূলক বিষয়। বিশেষ ধরনের সংগঠিত সামাজিক কার্যাদি সম্পাদনের ব্যাপারে মতাদর্শ শ্রেণী ও গোষ্ঠীসমূহকে অনুপ্রাণিত ও পরিচালিত করে। এর উদ্দেশ্য হল সামাজিক-রাজনীতিক আদর্শ ও বিদ্যমান বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্য সাধন।