অথবা, মঙ্গলকাব্য বলতে কী বুঝ? চণ্ডীমঙ্গলকাব্যের প্রধান প্রধান কবির পরিচয় দাও।
অথবা, মঙ্গলকাব্য কাকে বলে? চণ্ডীমঙ্গলকাব্যের বিভিন্ন কবিদের উল্লেখ কর। এ শাখার শ্রেষ্ঠ কবির পরিচয় দাও।
অথবা, “মঙ্গলকাব্যগুলো সমকালীন বাঙালির কাব্য, সমাজ ও সংস্কৃতির আলেখ্যও বটে।” যে কোন শাখার মঙ্গল পাঁচালি অবলম্বনে এই মন্তব্য যাচাই কর।
অথবা, ‘চণ্ডীমঙ্গলকাব্যে’র উদ্ভব ও বিকাশ নির্দেশ করে এ ধারার প্রধান কবিদের পরিচয় দাও।
অথবা, “মঙ্গলকাব্যের বিস্ময়কর জনপ্রিয়তার কারণ শুধু ধর্মীয় নয়, সাহিত্যিকও বটে।” বাংলা মঙ্গলকাব্যের প্রধান তিনটি শাখার যে কোন একটির বিশেষ পরিচয় দান প্রসঙ্গে উদ্ধৃত উক্তির বিচার কর।
উত্তরঃ আনুমানিক খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দী হতে আরম্ভ করে অষ্টাদশ শতাব্দীর কবি ভারতচন্দ্রের কাল পর্যন্ত বঙ্গ সাহিত্যে যে এক শ্রেণীর ধর্মবিষয়ক আখ্যানকাব্য প্রচলিত ছিল সেটাই বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে মঙ্গলকাব্য নামে পরিচিত। এটি বাংলাদেশে একটি বিশেষ সাহিত্য সাধনা হলেও বাংলাদেশে লৌকিক বা বহিরাগত বিভিন্ন ধর্মমতের যে অপূর্ব সমন্বয় সাধন ঘটেছে মঙ্গলকাব্যগুলো তারই পরিচয় বহন করে। বিভিন্ন যুগের ও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের আচার-আচরণ, সংস্কার সংস্কৃতি ও ধর্মবিশ্বাসের বিস্তৃত বিভক্তির উপর এদের প্রতিষ্ঠা।
বাংলা মঙ্গলকাব্যের বিভিন্ন কাহিনী বাংলার সামাজিক অবস্থা হতে উদ্ভূত হলেও, কালক্রমে তা শিক্ষিত হিন্দু সমাজের অনুশীলনের বিষয় হওয়ার ফলে তাদের উপর সংস্কৃত পুরাণগুলোর প্রভাব দুর্নিবার হয়ে ওঠে। ফলে মঙ্গলকাব্যগুলো আট দিন, বার দিন বা এক মাসব্যাপী গীত হবার একটা বিশেষ রীতি অবলম্বন করে। এই নির্দিষ্ট কাল পূরণ করার জন্য মৌলিক কাহিনীগুলোর মধ্যে নির্বিচারে পৌরাণিক কাহিনী যোগ হতে থাকে। কিন্তু যেহেতু পুরাণের লক্ষ্য দেবতা, মঙ্গলকাব্যের লক্ষ্য মানুষ অর্থাৎ পুরাণ একান্ত অলৌকিকতাশ্রয়ী, মঙ্গলকাব্য বাস্তব জীবনাশ্রয়ী। ফলে উভয়ের লক্ষ্যের ভিন্নতার কারণে মঙ্গলকাব্যে পৌরাণিক কাহিনীগুলো সুস্থাপিত নয়।
প্রত্যেক মঙ্গলকাব্য দেবখণ্ড ও নরখণ্ড অর্থাৎ পুরাণ ও কাব্য পরস্পর স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করে নির্মিত। মঙ্গলকাব্যের প্রত্যেক দেবতাই একান্ত অনিচ্ছুক ভক্তের কাছ থেকে জোরপূর্বক পূজা আদায় করে। স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে কেউ তাদের পূজা দেয় না৷
প্রত্যেক মঙ্গলকাব্যের দেবতা স্বতন্ত্র। কোন কোন মঙ্গলকাব্যের দেবতা কাব্যের নায়কের সাথে বিরোধিতা করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে। কোন কোন দেবতার সাথে নায়কের কোন বিরোধ নেই। বরং দেবতাদের আশীর্বাদ ও সহায়তাই তাদের জীবনে সাফল্য আনে। এই শ্রেণীর দেব চরিত্রে নিম্নশ্রেণীর মানবোচিত দুর্বলতা নেই, উন্নত আর্য দেব পরিকল্পনায় সুষমিত।
বাংলাদেশের ভোগেচ্ছু অনার্য মানব মানস একান্তভাবে জীবনমুখী। ফলে অধ্যাত্মবোধের তুলনায় ভোগবাদী জীবনমুখিনতাই ছিল মুখ্য। বাঙালি ভোগবাদী কিন্তু কর্মকুণ্ঠ, তাই দৈবশক্তি ও তুকতাকের উপর তাদের অগাধ বিশ্বাস ছিল। তবে এদের দেবতা ছিল ইহকালীন দেবতা। তাই মনসা, শীতলা, শনি প্রভৃতি অরি দেবতার পূজা দিয়ে যেমন পার্থিব অকল্যাণ এড়াতে চেয়েছে তেমনি লক্ষ্মী, চণ্ডী, ধর্মঠাকুর, সত্যনারায়ণ প্রভৃতির সেবায় সুখ, শান্তি ও ঐশ্বর্যের আশ্বাস তারা লাভ করেছে।
প্রত্যেক মঙ্গলকাব্যের নায়কই স্বর্গভ্রষ্ট দেবশিশু। বিশেষ কোন দেবতার পূজা প্রচারের উদ্দেশ্যেই মর্ত্যলোকে জন্মগ্রহণ করার জন্য অভিশাপগ্রস্ত হয়। তারপর স্পৃশ্য অস্পৃশ্য নির্বিচারে যে কোন মানবীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করে মর্ত্যের ধূলিমাটিতে ভূমিষ্ঠ হয়। তাই পূজা প্রচার সম্পর্কে যত প্রকার বাধা-বিপত্তি সব কিছুর হাত থেকেই সেই মঙ্গলকারী দেবতাই তাকে রক্ষা করেন।
মঙ্গলকাব্যের বৈশিষ্ট্যঃ
১. এ কাব্যের আখ্যানভাগ নায়কের সাথে দেবদেবীর দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে বিপুলায়তন পায়।
২. সৃষ্টি-কথা বর্ণনা প্রসঙ্গে কাব্যলক্ষ্মীর বন্দনা করা হয়। কবি সাধারণত স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে কাব্য রচনায় আত্মনিয়োগ করেন।
৩. এতে দেবতা মর্ত্যলোকে পূজা পাবার জন্য চেষ্টা করে থাকেন।
৪. এতে সুখ-দুঃখের বারমাসী গান, চৌতিশা, স্তুতি, নারীর পতিনিন্দার বর্ণনা, রন্ধন শিল্প বর্ণনা, ফলফুল, পশুপাখির আলোচনা প্রভৃতির অবতারণা করা হয়।
৫. এ কাব্যের ছন্দ সাধারণত পয়ার ও ত্রিপদী।
৬. দেবচরিত্র ছাড়া কোন কোন কাব্যে মানব চরিত্র অঙ্কন করতেও দেখা যায়।
৭. সমকালীন ধর্ম, রাষ্ট্র ও সমাজচিত্রও অঙ্কিত হয়।
মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য মঙ্গলকাব্যের ধারায় চণ্ডীমঙ্গল একটি বিশিষ্ট স্থান জুড়ে আছে। চণ্ডীদেবীর কাহিনী অবলম্বনে রচিত চণ্ডীমঙ্গল কাব্য এদেশে যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল এবং কয়েকজন শিল্পীর দ্বারা কাব্যধারায় রূপায়িত হয়েছে। নিম্নে চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের প্রধান প্রধান কবিদের পরিচয় দেয়া হলঃ
১. মানিক দত্তঃ চণ্ডীমঙ্গলের আদি কবি মানিক দত্তকে উল্লেখ করা যায়। চণ্ডীমঙ্গল, কাব্যের শ্রেষ্ঠ কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তী মানিক দত্তের কবিত্ব সম্বন্ধে বলেছেন-
মানিক দত্তেরে আমি করিয়ে বিনয়
যাহা হৈতে হৈল গীতপথ পরিচয়।
এতে মনে হয় যে, মানিক দত্ত চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের পথপ্রদর্শক ও মুকুন্দরামের কবিগুরু। তার নামে যে প্রচলিত কাব্যখানি পাওয়া গেছে তা নিতান্তই অর্বাচীন। যদিও মানিক দত্তের আবির্ভাব কাল সম্পর্কে গবেষকদের মধ্যে যথেষ্ট মতানৈক্য রয়েছে। তবে তিনি মনে হয় ষোড়শ শতকের বহুপূর্বে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তার নিবাস ছিল মালদহ জেলার বর্তমান ফুলবাড়ি। কবির আত্মবিবরণী পাঠ করলে জানা যায় প্রথম জীবনে তিনি কানা ও খোঁড়া- ছিলেন। দেবীর কৃপা লাভ করায় বিকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সুস্থ হয়ে ওঠে এবং কবিত্ব শক্তি লাভ করেন।
২. দ্বিজ মাধবঃ চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের দ্বিতীয় এবং অন্যতম কবি দ্বিজ মাধব। তিনি শুধু বাংলা সাহিত্যের নন, বৈষ্ণব সমাজেও বেশ সুপরিচিত। দিল্লীশ্বর আকবরের শাসন আমলে এক ব্রাহ্মণ বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তার নিবাস
করেন। তার নিবাস ছিল চট্টগ্রামে। এ সম্পর্কে মঙ্গলকাব্যবিশারদদের মধ্যে বেশ মতানৈক্য রয়েছে। কবির পুঁথি চট্টগ্রামে বিশেষভাবে প্রচলিত ছিল এবং প্রাপ্ত পুঁথিসমূহ চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকেই আবিষ্কৃত হয়েছে। দ্বিজ মাধব তাঁর কাব্যের নাম কোথাও সারদামঙ্গল কোথাও সারদাচরিত সারদাচরণ বলে উল্লেখ করেছেন।
ইন্দু বিন্দু বার্ণ ধাতা শক নিয়োজিত
দ্বিজ মাধব গায় সারদা চরিত।
এ পদ দুটি হতে দ্বিজ মাধবের কাব্য রচনাকাল ১৫৭৯ বলে ধরা হয়।
৩. কবিকঙ্কণ মুকুন্দরামঃ তিনি চণ্ডীমঙ্গলের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি। মধ্যযুগের কবিদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় একজন। কাব্যের মধ্যে ও তার আত্মবিবরণী আমরা দেশের তৎকালীন অবস্থার একটি জীবন্ত চিত্র দেখতে পাই, যা মূল্যবান বলে বিবেচিত।
তিনি বর্ধমান জেলার দামুন্যা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মিশ্র জগন্নাথের পৌত্র এবং পিতার নাম হৃদয় মিশ্র। গোত্র সাবর্ণ। মাহমুদ শরীফ নামের ডিহিদারের উৎপীড়নের ফলে কবি বাস্তুত্যাগ করেন ও তখনকার উড়িষ্যার অন্তর্গত ব্রাহ্মণভূমির শাসন কেন্দ্র আড়রায় সামন্ত বাঁকুড়া রায়ের আশ্রয়ে আশ্রিত হন। বাঁকুড়া রায় কবিকে তাঁর নিজ পুত্র রঘুনাথের গৃহশিক্ষক নিযুক্ত করেন। বাঁকুড়া রায়ের মৃত্যুর পর রঘুনাথ জমিদার হন এবং কবিকে গুরুরূপে মান্য করেন। তার নির্দেশে মুকুন্দরাম কাব্য রচনা করেন । তিনি বলেছেন-
রাজা রঘুনাথ শুনে অবদাত রসিক মাঝে সুজন
তার সভাসদ রুচি চারুপদ শ্রীকবি কঙ্কণ গান।
মুকুন্দরামের জন্ম এবং তার কাব্যের রচনাকাল সম্পর্কে পণ্ডিতদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। ড. দীনেশচন্দ্র সেনের মতে, আনুমানিক ১৫৩৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে ষোড়শ শতকের শেষে এ কাব্য রচিত হয়েছিল। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতানুসারে এ কাব্যের রচনাকাল ১৫৯৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৬০৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে।
চণ্ডীমঙ্গলের কাহিনী নিয়ে মুকুন্দরামের আগেও কাব্য রচিত হয়েছিল। পরবর্তীকালেও এ ধারা সম্প্রসারিত হয়েছে। কিন্তু কবি প্রতিভার শ্রেষ্ঠত্ব বিচারে অন্য কোন কবির পক্ষে মুকুন্দরামের সমকক্ষতা লাভ করা সম্ভব হয় নি। চরিত্র চিত্রণের ব্যাপারেও তিনি অসাধারণ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। মুকুন্দরাম ছিলেন দুঃখের কবি—দুঃখ বর্ণনায় কবির অসাধারণ কৃতিত্ব ছিল। বাংলা মঙ্গলকাব্যের ইতিহাস রচয়িতা আশুতোষ ভট্টাচার্য কবি কঙ্কণকে আধুনিক বাংলা কাব্যের বস্তুতাত্ত্বিক ঔপন্যাসিকদের অগ্রদূত বলেছেন৷ ড. সুকুমার সেন এ মতের সমর্থক।
মুকুন্দরামের কবিত্ব যেমন মধুর, পাণ্ডিত্যও তেমনি প্রশংসনীয়। মাতৃভাষা বাংলা ছাড়াও বিদেশি সংস্কৃত এবং ফারসি ভাষায় তার যথেষ্ট ব্যুৎপত্তি ছিল। কবির কাব্যে এর স্বাক্ষর রয়েছে। কবি কঙ্কণের আর একটি বৈশিষ্ট্য হল তিনি সুনিপুণভাবে সমাজ গৃহস্থালির চিত্র তুলে ধরতে সক্ষম। সে যুগে সমাজের নর-নারীর সুখ-দুঃখ, বেদনা, ব্যর্থতা এবং আশা- আকাঙ্ক্ষার প্রকৃত চিত্র তার কাব্যে রূপায়িত হয়েছে। সেকালের সামাজিক রীতিনীতি, বৃত্তি, ব্যবসা, আচার-অনুষ্ঠান অথবা ধর্মকর্ম সম্পর্কিত বিবরণের একটি উল্লেখযোগ্য দলিল মুকুন্দরামের এই চণ্ডীমঙ্গলের কাব্য।
৪. দ্বিজ রামদেব চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের পরবর্তী কবিগণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য দ্বিজ রামদেব। তিনি চট্টগ্রাম অঞ্চলের ঐতিহ্য অবলম্বন করে অভয়ামঙ্গলকাব্য রচনা করেছিলেন। দ্বিজ রামদেব দ্বিজ মাধবকে পদে পদে অনুসরণ করেছেন। ড. আশুতোষ দাসের সম্পাদনায় অভয়ামঙ্গল কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত হয়েছিল।
৫. মুক্তারাম সেনঃ তিনি চণ্ডীমঙ্গলের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি । চট্টগ্রাম জেলার একটি বিখ্যাত গ্রামে (যা বর্তমানে আনোয়ারা নামে খ্যাত) তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার কাব্যের নাম সারদামঙ্গল। এর রচনার তারিখ—
গ্রহ ঋতুকাল শশী শক শুভ জানি।
মুক্তারাম সেন ভণে ভাবিয়া ভবানী।
১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দে কবির গ্রন্থ রচনা সম্পূর্ণ হয়৷
৬. রামানন্দ যতিঃ যে সময় মঙ্গলকাব্যের সমালোচনা ছিল ধৃষ্টতা ও সাহসের বিষয় সে সময় রামানন্দ যতি মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর কাব্যের দোষত্রুটি উল্লেখ করেও মুখ্যত মুকুন্দরাম ও ভারতচন্দ্রের অনুসরণে ও অনুকরণে তার চণ্ডীমঙ্গল কাব্য রচনা করেন। রামানন্দ পুরো বিদ্রোহী নন বরং প্রতিবাদী কবি। গজ বসু ঋতুচন্দ্র শাকে গ্রন্থ হয়। অর্থাৎ গ্রন্থের রচনাকাল ১৭৬৬–৬৭ খ্রিস্টাব্দ।
৭. কৃষ্ণরাম দাসঃ বহু পাঁচালি প্রণেতা কৃষ্ণরাম দাস মুখ্যত রায়মঙ্গলের কবি হিসেবেই পরিচিত। কৃষ্ণরামের চণ্ডীমঙ্গলের পুরো পুঁথি আজও সংগৃহীত হয় নি, কেবল কমলেকামিনী ও অষ্টমঙ্গলার সামান্য অংশ পাওয়া গেছে।
৮. দ্বিজ হরিরামঃ ইনি কবিকঙ্কণ মুকুন্দ প্রভাবিত একজন কবি। সতেরো শতকের শেষপাদে শোভা সিংহের প্রতিপোষণে দ্বিজ হরিরাম তার চণ্ডীমঙ্গল রচনা করেন। প্রাপ্ত পুঁথির লিপিকাল ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দ। রচনা গতানুগতিক ও বৈশিষ্ট্যহীন। শোভা সিংহের মত কবিও হয়ত মেদিনীপুরের ঘাটাল অঞ্চলের লোক।
৯. জয়নারায়ণ সেনঃ যশোহর থেকে এসে ঢাকার বিক্রমপুরে বসবাসকারী এক সেনবংশের সন্তান। তিনি একখানি চণ্ডীর পাঁচালি রচনা করেছিলেন। তার চণ্ডীমঙ্গল বৈশিষ্ট্যহীন, তবে এ চণ্ডীমঙ্গলে সংযোজিত মাধব-সুলোচনা উপাখ্যান উল্লেখযোগ্য। তাঁর চণ্ডীমঙ্গল ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দের দিকে রচিত।
১০. ভবানীশঙ্কর দাসঃ কবির পিতামহ মধুসূদন কর্ণফুলীর বটতলী থেকে এসে পটিয়া থানার নিকটবর্তী ছনহরা গাঁয়ে বাস করেন। কবির জন্ম এখানেই। তার কাব্য রচনার কাল–
ধাতা বিন্দু সাগরেন্দু শকাদিত্য সনে।
ভবানীশঙ্কর দাসে পঞ্চালিকা ভণে।
তার কাব্য, ১৭৭৯ খ্রিস্টাব্দে রচিত। তার কাব্যটি কলেবরে বৃহৎ এবং কবি যে সংস্কৃত ব্যাকরণনিষ্ঠ ও পাণ্ডিত্য প্রিয় ছিলেন, তার সাক্ষ্য কাব্যের সর্বত্র সুলভ।
১১. দ্বিজ জনার্দনঃ সম্ভবত ইনি আঠারো শতকের কবি। তার চণ্ডীমঙ্গলে কালকেতু ও ধনপতির উপাখ্যান দুটো সংক্ষিপ্ত ও বাহুল্য বর্জিত। কবির কোন পরিচয় পাওয়া যায় নি।
১২. কবীন্দ্র অকিঞ্চন চক্রবর্তীঃ তিনি চণ্ডীমঙ্গলের সর্বশেষ কবি। তার নিবাস ছিল মেদিনীপুরের ঘাটাল মহকুমার বরদা পরগনার বেঙ্গারাল গ্রামে। কবির উপাধি ছিল কবীন্দ্র। সম্ভবত তার কাব্যটি অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে রচিত।
উপসংহারঃ মঙ্গলকাব্যগুলো দেবদেবীর কাহিনী অবলম্বনে রচিত হলেও এতে বাঙালি জীবনের ইতিহাস প্রতিফলিত হয়েছে। মধ্যযুগের বাংলার জীবন ইতিহাসের বহু অপ্রাপ্ত তথ্যের শূন্যস্থান পূরণ করেছে মঙ্গলকাব্য। এ কাব্য থেকে বাঙালির জাতীয় জীবনের একটি নিত্যকালের চিত্রের সঙ্গে পরিচিত হওয়া যায়। বাঁধাধরা কাহিনীর মধ্যে বাস্তব জীবন চিত্র অঙ্কনে করিগণের বিশেষ কৃতিত্ব এতে প্রকাশিত হয়েছে।
Leave a comment