পূর্ব বাংলা থেকে নবনির্বাচিত সদস্য কুমিল্লার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত এই প্রস্তাব
উত্থাপন করেন। ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের এ সংসদীয় প্রস্তাব গৃহীত হয়নি বরং
প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান এ প্রস্তাবে সমালোচনা করেন। বাংলা ভাষাকে
রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে তমুদ্দিন মজলিস এবং রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গড়ে
ওঠে। ১৯৪৮ সালের ১০ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে বাংলা ভাষা সংগ্রাম পরিষদের সভায় বাংলাকে
রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১১ মার্চ ধর্মঘট ডাকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ১১ই মার্চ গ্রেফতার করা হয় সেই ধর্মঘটে পিকেটিং
এর সময়। এর কিছুদিন পর অর্থাৎ ২১ শে মার্চ মোহাম্মদ আলী জিন্না ঢাকায় আসেন
এবং ভাষণ দেন আর এই ভাষণে তিনি ঘোষণা করেন উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র
রাষ্ট্রভাষা। আবার ২৪ শে মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে গিয়ে তিনি
একই বক্তব্য রাখেন এবং তিনি বলেন উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।
তখন উপস্থিত ছাত্র জনতা সহ বাংলার দামাল ছেলেরা না,না বলে প্রতিবাদ জানান। তারা
দাবি করেন উর্দু নয় বাংলায় হবে পূর্ব পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। পূর্ব
বাংলার জনগণের মধ্যে জন্ম হয় গভীর ক্ষোভের। বাংলা ভাষার মর্যাদার দাবিতে
আন্দোলন দানা বেঁধে উঠে এবং কতিপয় দাবিতে নীতি গৃহীত হয় শান্তিপূর্ণ আন্দোলন
করা হবে।
ভাষা আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায়
তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন খাজা নাজিম উদ্দিন এবং তিনি
১৯৫২ সালের ২৭শে জানুয়ারি আবারো ঘোষণা করেন যে উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র
রাষ্ট্রভাষা। আর এই ঘোষণার ফলে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। এই
ঘোষণার প্রতিবাদস্বরূপ সিদ্ধান্ত হয় যে ২৯ শে জানুয়ারি ঢাকা শহরে প্রতিবাদ
মিছিল অনুষ্ঠিত হবে।
ভাষার দাবিতে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্দোলনকারী সংগঠনগুলো সম্মিলিতভাবে সমগ্র
পূর্ব বাংলায় প্রতিবাদ কর্মসূচি ও ধর্মঘটের আহ্বান করে। এই আন্দোলন দমন করতে
পুলিশ ১৪৪ ধারা জারি করে এর ফলে সেই দিন অর্থাৎ একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকা শহরের
সমগ্র মিছিল সমাবেশ বেআইনি এবং নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয়
নেতৃত্ব ভাষার দাবিকে বিনষ্ট করার জন্য দমনমূলক নীতির আশ্রয় গ্রহণ করেন।
সেই দিন ভাষা আন্দোলনের সমর্থকদের জেলে আটকে রাখা হয় যার কারণে এই
প্রতিবাদের ঝড় আরো প্রশস্ত হয়ে ওঠে। আটককৃত ছাত্রদের মুক্তির দাবিতে ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয় সহ দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালনের আহ্বান করা
হয়। এর ফলে ভাষার দাবিতে দেশের সর্বত্র আন্দোলন আরো জোরালো হয় এবং
পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী আরও কঠোরভাবে দমনমূলক নীতি গ্রহণ করতে উদ্ধত হন।
ভাষা আন্দোলনের শেষ পর্যায়ে
ভাষা আন্দোলনের শেষ পর্যায়ে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ কমিটি গঠন করা
হয়।
রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি
১৯৫২ সালের ৩০ জানুয়ারি এক জনসভায় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন
করা হয় আর এই সংগ্রাম পরিষদের মূল উদ্দেশ্য ছিল-
উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রতিবাদ ও
রাষ্ট্রভাষার আন্দোলন কে আরো তীব্রতর করা
আর এই কমিটিতে আওয়ামী লীগ থেকে দুইজন, ছাত্রলীগ থেকে দুইজন, পূর্ব
পাকিস্তানের যুবলীগ থেকে দুইজন এবং খেলাফত রব্বানী থেকে দুইজন করে সদস্য
নির্বাচন করা হয়। এই কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন গোলাম মাহবুব। আর এই
কমিটিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় যে, একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা দিবস হিসেবে
পালন করা ও দেশব্যাপী হরতাল পালন করা।
ঐতিহাসিক মিছিল ১৪৪ ধারা ভঙ্গ
১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি তৎকালীন গভর্নর নুরুল আলম সরকার ঢাকায় ১৪৪ ধারা
জারি করেন উক্ত কর্মসূচি কে বানচাল করার জন্য। কিন্তু ছাত্র জনতা ভয় পায়নি
বরং তারা ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি পূর্ব নির্ধারিত সময় অনুযায়ী অর্থাৎ
সকাল ৯ টা থেকে সরকারি আদেশ অমান্য করে বিভিন্ন স্কুল, কলেজের হাজার হাজার
ছাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে সমবেত হয়। পুরাতন কলাভবনের প্রাঙ্গনে আম
তলায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গের প্রশ্নেও অনুষ্ঠিত হয় ঐতিহাসিক ছাত্রসভা।
ছাত্ররা বিভক্ত হয় ৫৭ টি ছোট ছোট দলে এবং রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই স্লোগান
দিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে আসতে চাই কিন্তু পুলিশ অস্ত্র হাতে চারিদিকে ঘিরে
রাখে। কিন্তু ছাত্ররা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার দাবিতে স্লোগান দিতেই থাকে। সকল
ছাত্র একত্র হয়ে সকাল সোয়া ১১ টার দিকে সকল প্রতিবন্ধকতা ভেঙ্গে
রাস্তায় নামার প্রস্তুতি নিলে পুলিশ ছাত্রদের সতর্ক করে দেয় এবং কাঁদানে
গ্যাস নিক্ষেপ করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পুলিশকে অনুরোধ জানান যেন তারা কাঁদানে গ্যাস
নিক্ষেপ না করেন। এবং উপাচার্য ছাত্রদের বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগের নির্দেশ দেন।
উপাচার্যের এই নির্দেশে ছাত্ররা ক্যাম্পাস ত্যাগের সময় ১৪৪ ধারা ভঙ্গের
অভিযোগে কয়েকজন ছাত্রকে গ্রেপ্তার করলে সহিংসতা আরো ছড়িয়ে পড়ে।
এছাড়াও এই দিন আরো অনেক ছাত্রকে গ্রেফতার করা হয়। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে
ছাত্র-জনতা বিক্ষোভ মিছিল বের করে। ছাত্রদের এই মিছিল ঢাকা মেডিকেল
কলেজের কাছাকাছি আসলে পুলিশে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে আন্দোলনকারী ছাত্রদের ওপর
পুলি বর্ষণ করে। আর এই গুলিতে শহীদ হন সালাম, বরকত, রফিক, শফিক সহ আরো অনেকে।
সেই দিন রাজপথ রঞ্জিত হয় শহীদদের রক্তে।
সরকারের এই বর্বরোচিত হামলার প্রতিবাদে সারাদেশে বিক্ষোভের আগুন যেন আরো দাউ
দাউ করে জ্বলে ওঠে। ছাত্রদের পাশাপাশি সমাজের সর্বস্তরের জনগণ প্রতিবাদ মুখর
হয়ে রাজপথে নেমে আসে এবং প্রবল আন্দোলন গড়ে তুলে।
ভাষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক পটভূমি
ভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতির জন্য একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা এবং এই ভাষা আন্দোলনের
বীজ রোপিত হয়েছিল দেশ বিভাগের পর থেকেই বাংলার অধিকাংশ মানুষের মুখের ভাষা
বাংলা হওয়া শর্তেও উদ্যোগে বাংলা মানুষের মুখের ভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়া
হয় যা ছিল সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট এর ওই প্রেক্ষিতে ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ অধ্যাপক আবুল কাশেম এর নেতৃত্বে পহেলা সেপ্টেম্বর তিন
সদস্য বিশিষ্ট মজলিস গঠন করা হয়
দেশ বিভাগের মাত্র ১৭ দিন পরে এই মজলিস গঠিত হয়েছিল আর এর সংগঠনের সহযোগী
সদস্য ছিলেন আব্দুল গফুর অধ্যাপকের এস এম নুরুল হক ভূঁইয়া দেওয়ান মোহাম্মদ
প্রমুখ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি ছিল এই সংগঠন সংগঠনের মূল উদ্দেশ্য
কিন্তু পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত শাসকগোষ্ঠী এর দাবি মেনে
নিতে পারেননি
পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠীর এক তরফা ভাবে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা
হিসেবে চাপিয়ে দেওয়ার কারণেই প্রকৃত অর্থে ভাষা আন্দোলনের জন্ম হয়েছিল।
পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী উর্দুকেই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করতে
সচেষ্ট হন কিন্তু বাস্তবিক পক্ষে উর্দু ভাষার ভাষা লোক ছিল অনেক নগণ্য।
২১/ একুশে ফেব্রুয়ারি
১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি পূর্ব নির্ধারিত সময় অনুযায়ী অর্থাৎ সেই দিন
সকাল ৯ টা থেকে বিভিন্ন স্কুল কলেজের ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে
আসে এবং তারা ১৪৪ ধারা জারির বিপক্ষে স্লোগান দিতে থাকে এবং একই সাথে তারা
পূর্ব বাংলার মানুষের ভাষা সম্পর্কে সাধারণ জনগণের ক্ষমতাকে বিবেচনা করার
আহ্বান করতে থাকে। এ সময় ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের দিন
এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের উপস্থিতিতে পুলিশ অস্ত্র হাতে ছাত্রদের
চারিদিক থেকে দিকে ঘিরে রাখে।
সেই দিনই বেলা শোয়া ১১ টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গেটে ছাত্ররা জড়ো হয়ে
১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে রাস্তায় নামার প্রস্তুতি নিলে পুলিশ কাদানে গ্যাস নিক্ষেপ
করে এবং পুলিশ ছাত্রদের সতর্ক করে দেন যেন তারা ১৪৪ ধারা জারি ভঙ্গ না করে।
কিন্তু কিছু ছাত্র দৌড়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজের দিকে চলে গেলে ও বাদবাকি
ছাত্ররা পুলিশ দ্বারা অবরুদ্ধ হয়ে যায় এবং তারা বাধ্য হয়ে ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে যায়।
আরো পড়ুনঃ লঞ্চ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা রচনা সম্পর্কে জেনে নিন
এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য তখন পুলিশকে কাদা নিয়ে গ্যাস নিক্ষেপ
না করার জন্য অনুরোধ জানান এবং ছাত্রদের বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ ত্যাগ করার
জন্য নির্দেশ দেন। উপাচার্যের এই নির্দেশে ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ
করতে চাইলে কয়েকজন ছাত্রকে ১৪৪ ধারা জারি ভঙ্গের অপরাধে গ্রেফতার করা হয়।
আর এর ফলে ছাত্রদের মাঝে সহিংসতা আরো ছড়িয়ে পড়ে এবং অনেক ছাত্রকে গ্রেফতার
করে তেজগাঁও নিয়ে গিয়ে আবার তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়।
আর ছাত্ররা এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে তাদের আন্দোলন আরো জোরালো করতে শুরু করে। ওই
দিন অর্থাৎ ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি দুপুর ২ টার দিকে আইন পরিষদের
সদস্যরা আইনসভায় যোগ দিতে চাইলে ছাত্ররা তাদের বাধা দেয় এবং কিছু ছাত্র
সিদ্ধান্ত ন্যায় যে তারা আইন সভায় যাবে এবং তাদের দাবি উত্থাপন করবে।
ছাত্ররা আইন সভার দিকে রওয়ানা হলে পুলিশ দৌড়ে আসে এবং বেলা তিনটার দিকে
ছাত্রাবাসে গুলি বর্ষণ শুরু করে।
পুলিশের গুলি বর্ষণে শফিক, বরকত, রফিক, জব্বার সহ আরো অনেকেই ঘটনা স্থলে শহীদ
হন। এছাড়াও অলিউল্লাহ নামের ৮-৯ বছরের একজন কিশোর ও এই গুলি বর্ষনে নিহত
হয়। ছাত্র হত্যার সংবাদ দ্রুত চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লে ছাত্ররা ঘটনাস্থলে
আসার উদ্যোগ নেয়। মুহূর্তের মধ্যেই দোকান, অফিস সবকিছু বন্ধ হয়ে যায়। আর
এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ছাত্রদের আন্দোলনে সাধারণ মানুষের আন্দোলনের রূপ
নেয়।
মাওলানা তর্কা বাগিস পুলিশের গুলির খবর পেয়ে বেশ কয়েকজন বিক্ষুব্ধ
ছাত্রদের পাশে এসে দাঁড়ায় এবং ওই সময় গণপরিষদের অধিবেশনের প্রস্তুতি
চলছিল। গণপরিষদের ক্রান্ত কুমার দাস, মনোরঞ্জন শর্মা, আহমেদ ও ধীরেন্দ্রনাথ
সহ মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন কে অধিবেশন স্থগিত করতে অনুরোধ করা হয় এবং
হাসপাতালে আহত ছাত্রদের দেখতে যেতে ও তাকে অনুরোধ করা হয়। কিন্তু নুরুল আমিন
অনুরোধ রাখেনি বরং অধিবেশনে বাংলা ভাষার বিরোধিতা করেই বক্তব্য দেন।
২১/একুশে ফেব্রুয়ারির পরবর্তী আন্দোলন
একুশে ফেব্রুয়ারিতে সারাদেশে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে ছাত্র হত্যাকে
কেন্দ্র করে। বাইশ ২২ ও ২৩ তেইশে ফেব্রুয়ারি ছাত্র, শিক্ষ্ সাহিত্যিক,
বুদ্ধিজীবী, শ্রমিক ও সাধারণ জনগণ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে পূর্ব হরতাল পালন
করে। শফিউর রহমান শফিক শহীদ হন ২২শে ফেব্রুয়ারি। ২৩ শে ফেব্রুয়ারি
ফুলবাড়িয়ায় ছাত্র জনতার মিছিলেও পুলিশ নির্যাতন চালায়। ছাত্ররা
ঐদিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গনে প্রথম শহীদ মিনার স্থাপন করেন
শহীদের স্মৃতিকে অম্লান করে রাখতে।
২২ শে ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনে শহীদ শফিউর রহমানের বাবা ২৪ শে ফেব্রুয়ারি
শহীদ মিনারটি উদ্বোধন করেন। আবার ছাব্বিশ ২৬শে ফেব্রুয়ারি দৈনিক পত্রিকার
সম্পাদক আজাদ শহীদ মিনারটি আনুষ্ঠানিকভাবে পুনরায় উদ্বোধন করেন।
ভাষা আন্দোলন ও বাংলা ভাষার বিশ্বায়ন
১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি বাংলার আপামার জনসাধারণ ও ছাত্রসমাজ তাদের বুকের
তাজা রক্তের বিনিময়ে যে মাতৃভাষা অর্জন করেছে তা এখন শুধু দেশের মধ্যে
সীমাবদ্ধ নেই বরং তা এখন পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। বাঙালি জাতির ভাষার
জন্য যে ত্যাগ তা ভাবতে শিখিয়েছে পুরো বিশ্বকে। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর
জাতিসংঘের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও বিজ্ঞান সংস্থা ইউনেস্কো একুশে ফেব্রুয়ারিকে
মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেছে।
বাঙালি জাতির মাতৃভাষার জন্য আত্মত্যাগের সাথে বিশ্বের মানুষ আজ একাত্মতা
ঘোষণা করেছে। সালাম, বরকত, রফিক, শফিক, জব্বারসহ আরো অনেকের রক্তের বিনিময়ে
অর্জিত হয়েছে আমাদের আজকের এই বাংলা ভাষা। ইউনেস্কোর গ্রহীত প্রস্তাবের
প্রেক্ষিতে মাতৃভাষা দিবস পালনের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করা হয় এবং সেখানে বলা
হয় সাংস্কৃতিক ও ঐতিহ্যের সংরক্ষণের সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার হল ভাষা।
আরো পড়ুনঃ মাদকাসক্তি ও এর প্রতিকার রচনা সম্পর্কে জেনে নিন
মাতৃভাষার প্রচলন যে কেবল ভাষাগত প্রচলন বা চিত্রকে বা বহু ভাষাভাষীকে
উৎসাহিত করে তা নয়, ভাষাগত এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উন্নয়নের অনুধাবনের
ক্ষেত্রে ও তা সহায়তা করে। একুশে ফেব্রুয়ারি কে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস
হিসেবে পালন করছে বাংলাদেশ সহ জাতিসংঘ ভুক্ত প্রায় ১৯৩ টি দেশ। বাঙালি জাতির
জন্য বাংলা ভাষা আজ অজস্র মর্যাদার প্রতীক।
ভাষা আন্দোলনের অর্জন
-
১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালি জাতির যে আন্দোলন তা যদিও বাংলা
ভাষাকে রক্ষা করার আন্দোলন কিন্তু তা বাঙালি জাতির অধিকার সম্পর্কে ও তাদের
সচেতন করে তোলে। আর এই ভাষা আন্দোলনের ফলাফল হিসেবে ১৯৫৪ সালে গঠিত হয়
যুক্তফ্রন্ট। -
১৯৫৫ সালে গঠিত হয় বাংলা একাডেমি যুক্ত ফ্রন্ট বাংলা ভাষাকে চর্চা করার
জন্য। -
১৯৫৬ সালে বাংলা ভাষার উদ্যোগে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উল্লেখ করা
হয়। -
১৯৯৯ সালের ১৭ই নভেম্বর ইউনেস্কো কর্তৃক বাংলা ভাষাকে স্বীকৃতি প্রদান করা
হয়। -
একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালনের ঘোষণা করা
হয়। আর এই স্বীকৃতি প্রদানের জন্য যাদের অবদান সবচেয়ে বেশি তারা হলেন –
কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম ও আব্দুস সালাম।
উপসংহার
পরিশেষে আমরা এ কথা বলতে পারি যে, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানের
তাদের উপনিবেশ গড়ে তুলেছিল বাংলা ভাষার প্রতি আঘাত হানার জন্য। আর ১৯৫২
সালের রাষ্ট্রভাষা নিয়ে বাঙালি জাতির সর্বপ্রথম পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠীর
বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত হন। আর এই ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বাঙালি জাতি
সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ হয়ে পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠীকে পরাজিত করতে ও সক্ষম
হয়।
বাংলা মায়ের সন্তানেরা ভাষার জন্য যে তাদের বুকের তাজা রক্ত দিয়ে রাজপথ
রঞ্জিত করেছেন তাদের আত্মত্যাগ বাংলার মাটিতে চিরদিন অম্লান হয়ে থাকবে।
তাদের আত্মত্যাগের ফলে অর্জিত এই বাংলা ভাষা এখন আর বাংলার মধ্যে সীমাবদ্ধ
নেই। বাংলা ভাষায় এখন ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের আনাচে-কানাচে।
বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ৩০ কোটি লোক কথা বলে বাংলা ভাষায়। বাঙালি
জাতির বিজয় বাংলা শহীদের আত্মত্যাগের ফলে আমরা আজ বাংলা ভাষাকে নিয়ে
গর্ববোধ করি।
Leave a comment