সর্বস্তরে মাতৃভাষা চর্চা শীর্ষক সেমিনারে প্রধান বক্তার ভাষণ রচনা কর |
✱এ শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে মাতৃভাষা বিষয়ে একটি ভাষণ তৈরি কর।
✱অথবা, সর্বস্তরে মাতৃভাষা চর্চা শীর্ষক সেমিনারে প্রধান বক্তার ভাষণ রচনা কর।
✱অথবা, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপন উপলক্ষ্যে আয়ােজিত সেমিনারে বাংলাদেশে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু হােক’- এই শিরােনামে একটি ভাষণ তৈরি কর।
আজকের আলােচনা সভার সম্মানিত সভাপতি, শ্রদ্ধেয় শিক্ষকমণ্ডলী এবং সম্মানিত আলােচকবৃন্দ, উপস্থিত শিক্ষার্থী ও প্রিয় সুধীবৃন্দ আস্সালামু আলাইকুম।
“শিক্ষায় মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধ স্বরূপ’- কবিগুরু যথার্থই একথা বলেছেন। মাতভাষার মধ্য দিয়ে শিশুর শিক্ষা পরিপূর্ণ রূপ লাভ করে। মাতৃদুগ্ধ পেয়ে শিশু যেমন বেড়ে ওঠে তেমনি মাতৃভাষাও শিশুর শিক্ষা তথা মানসিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তাই শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে মাতৃভাষা অনবদ্য।
সম্মানিত সুধী
একথা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না যে, প্রতিটি মানুষের কাছে প্রিয় হচ্ছে মা, মাটি ও মানুষ । সাধারণত শিশুর শৈশব থেকেই তার মায়ের কাছে তথা পরিবার থেকেই শিক্ষা আরম্ভ হয়ে থাকে। এজন্য কোনাে কোনাে মনােবিজ্ঞানী গৃহকেই শিক্ষার প্রথম পাঠশালা হিসেবে অভিহিত করেছেন। অর্থাৎ শিক্ষার শুরুটাই ঘটে মাতৃভাষার মধ্য দিয়ে। প্রিয় সুধী, কিন্তু আমরা একথা জানা সত্ত্বেও নানা মেরুকরণে মাতৃভাষাকে এড়িয়ে ভিনদেশি ভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম করতে উঠেপড়ে লেগেছি। সত্যিকার অর্থে এ আমাদের আত্মহত্যারই শামিল।
প্রিয় সুধীমণ্ডলী
আমাদের দেশে সর্বস্তরে যেমন মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠিত হয়নি তেমনি শিক্ষাক্ষেত্রেও মাতৃভাষার একই অবস্থা বিরাজমান। অথচ চিন্তা-চেতনার সমস্ত জায়গা জুড়ে রয়েছে মাতভাষার অপরিসীম প্রাধান্য। জাতি হিসেবে এই দীনতা আমাদের আর কতদিন বহন করতে হবে জানি না।
সম্মানিত সুধী
জীবন ও জগতের প্রাত্যহিক প্রবাহ মাতৃভাষার মাধ্যমেই এগিয়ে চলে । জীবনের নান্দনিক অভিব্যক্তি সুখ, দুঃখ, সৌন্দর্যবর্ধন ইত্যাদি বিচিত্র জীবনানুভূতি মাতৃভাষার মধ্য দিয়েই সাবলীলভাবে উপস্থাপন সম্ভব। সুতরাং মাতৃভাষা স্রোতস্বিনী নদীর মতােই জীবনের প্রতি পরতে পরতে ছড়িয়ে রয়েছে । বস্তুত মাতৃভাষার ভাবমন্থন, ভাবের সরল-সহজ আদান-প্রদান যেভাবে সম্ভব, বিদেশি যেকোনাে ভাষায় তা হোঁচট খায় । বন্ধুর পথ চলতে গিয়ে তা প্রায়ই মৌলিকত্ব হারিয়ে ফেলে । সুতরাং যে ভাষায় শিশুর মুখের বুলি ফোটে, নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের হৃদ্স্পন্দন জানায় আর যা রক্তের সঙ্গে মিশে রয়েছে- সেই মাতৃভাষার মধ্য দিয়ে চিন্তাচেতনার পরিস্ফুটন ঘটে।
প্রিয় সুধীবৃন্দ
আজ রাশিয়া, চীন, জাপান বিজ্ঞানসহ নানাবিধ বিষয়ে যে অগ্রগতি সাধন করেছে তার মূলে রয়েছে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা । এছাড়া পৃথিবীখ্যাত জার্মান জাতি মাতৃভাষাকে এতটা শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্রহণ করেছে যে, শুধু শিক্ষার ক্ষেত্রে নয় বরং জীবনের সর্বত্রই তাদের মাতৃভাষার ব্যবহার । প্রখ্যাত বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু মতামত দিয়েছেন যে, আমাদের জীবনের সকল ভাব-চিন্তা, আশা-আকাক্ষার সঠিক রূপায়ণ বাংলাভাষার মাধ্যমেই সম্ভব। অথচ আমাদের দেশের নীতিনির্ধারকরা মাতৃভাষায় শিশু শিক্ষাকে গ্রহণ করার কোনাে ব্যবস্থা না করে বরং নিজেদের সন্তানকে পাঠাচ্ছেন এমন সব স্কুলে যেখানে মাতৃভাষা বলা-কওয়া তথা উচ্চারণ করাও যেন পাপ । এসব শিক্ষার্থীদের কড়াকড়ি করে স্কুল থেকেই বলে দেওয়া হয় বাসায় বাংলা বলবে না। কী বিচিত্র আমাদের দেশ!
সম্মানিত সুধীমণ্ডলী
এসব স্কুল থেকে মাতৃভাষা বর্জিত শিক্ষা গ্রহণের সময় কোমলপ্রাণ শিশুদের অনেকেই অসহায়ত্ব বােধ করে, এরা যেন সমাজ। থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভােগে। ফলে শিশুদের এ ধরনের মানসিকতা তাদের ব্যক্তিত্ব বিকাশে মারাত্মক হুমকি হয়ে। দাঁড়াতে পারে ।
প্রিয় সুধী
শিক্ষার সর্বস্তরে মাতৃভাষার ব্যবহার না হওয়ায় দেশ আজ সমস্যায় জর্জরিত। কেননা একটি দেশের একই ভূখঞ্জে প্রতিনিয়ত নানাবিধ বৈষম্যের জন্য দিচ্ছে শুধু মাতৃভাষাকে অগ্রাহ্য করার ফলে । আমাদের তৃণমূল পর্যায় থেকে সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত এর একটা নেতিবাচক প্রভাব প্রবলভাবে বিদ্যমান। একজন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি, আইনে তার সকল অধিকার নিশ্চিত করা হলেও শুধু চূড়ান্ত রায়টি পড়ার সৌভাগ্য তার হয় না। কেননা এটি তার মাতৃভাষায় রচিত নয়।
সম্মানিত সুধী
শুধু মাতৃভাষার ব্যবহার সর্বস্তরে নেই বলে আমরা তার শেষ অধিকারটুকুও নিশ্চিত করতে পারছি না। জাতি হিসেবে নিঃসন্দেহে এটা মঙ্গলজনক নয়। মাঝে মধ্যে এ ব্যাপারে সরকার কিংবা সংশ্লিষ্ট মহল থেকে জোরালাে তৎপরতা লক্ষ করা গেলেও কোনাে রহস্যময়তায় তা যেন অতিশীঘ্রই মুখ লুকিয়ে ফেলে। আমাদের রক্তের বিনিময়ে পাওয়া প্রিয় মাতৃভাষা, ক্ষেত্র বিশেষে অনাদরে অবহেলায় গড়াগড়ি যায় । তাই তাে কবিকণ্ঠে দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে উচ্চারিত হয়ー
এখন তােমাকে ঘিরে খিস্তি-খেউড়ের পৌষমাস!
তােমার মুখের দিকে আজ আর যায় না তাকানাে,
বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা …
প্রিয় সুধীবৃন্দ
জানি এ ব্যাপারে বিশদ বলতে গেলে আপনাদের ধৈর্যচ্যুতিও ঘটতে পারে; তবুও প্রাণের আবেগ বার বার উথলে ওঠে; আমরা সুদীর্ঘ নয়মাস মুক্তিযুদ্ধ করেছি। এক সাগর রক্ত ও তিরিশ লক্ষ শহিদের পবিত্র আত্মদানে এবং অসংখ্য মা-বােনের সম্বমের বিনিময়ে পাওয়া আমাদের প্রিয় স্বাধীনতা অর্জনের অন্যতম বিষয় ছিল- সর্বস্তরে বাংলার ব্যবহার তথা শিক্ষাক্ষেত্রসহ সর্বত্র মাতৃভাষার ব্যবহার। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য স্বাধীনতার প্রায় অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে গেলেও তা সম্ভব হয়নি।
সম্মানিত সুধীমণ্ডলী
আমরা তবুও আশাহত হব না। কারণ আজও মাতৃভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে গ্রহণের জন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও গবেষণা অব্যাহত রয়েছে। ইতােমধ্যে ইউনেস্কো ঘােষণা দিয়েছে- ‘The use of vernicular languages in Education.’ অর্থাৎ মাতৃভাষার মাধ্যমেই শিক্ষার গুরুত্ব সর্বোচ্চ মর্যাদার সঙ্গে স্বীকৃত হচ্ছে।
প্রিয় সুধীমণ্ডলী
মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার গুরুত্বের কথা অনেক আগে থেকে আলােচিত হয়ে আসছিল- তা আপনারাও জানেন । আমি শুধু কবি গুরুর সেই বক্তব্যটুকু আপনাদের সামনূে সবিনয়ে উপস্থাপন করছি। মাতৃভাষার অপবাদ দূর হােক, যুগ শিক্ষার উদ্বেল ধারা বাঙালি চিত্তের শুষ্ক নদীর রিক্ত পথে বান ডাকিয়া বয়ে যাক, দুই কূল জাগুক পূর্ণ চেতনায় । ঘাটে ঘাটে উঠুক আনন্দ ধ্বনি ।…
প্রিয় সুধী
সেদিন হয়তাে আর বেশি দূরে নয়, যেদিন আমাদের উপলব্ধির সার্থকতায়- ‘মাতৃভাষাই হবে শিক্ষার মাধ্যম’- এই আনন্দ বার্তা দিয়ে আপনাদের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছি। সকলে ভালাে থাকুন, সুখে থাকুন।
Leave a comment