প্রশ্নঃ ভারতীয় সমাজে সামন্তবাদের উৎপত্তি কীভাবে হয়েছিল? ভারতীয় সমাজে পুঁজিবাদ বিকশিত না হওয়ার কারণগুলো বর্ণনা কর।

অথবা,ভারতীয় সমাজে সামন্তবাদের উৎপত্তি কীভাবে হয়েছিল? ভারতীয় সমাজে পুঁজিবাদ বিকশিত না হওয়ার কারণগুলো আলোচনা কর।

ভূমিকাঃ সামাজিক স্তরবিন্যাস ও বিকাশের অন্যতম ধারা হলো সামন্তপ্রথা। মধ্যযুগে ইউরোপীয় সমাজে সামন্তপ্রথার উৎপত্তি। তবে প্রায় সাড়া পৃথিবীতেই পরবর্তীকালে সামন্তপ্রথা বিস্তার লাভ করে। ভারতীয় উপমহাদেশে সামন্তপ্রথা ইউরোপীয় সামন্তপ্রথা থেকে বৈশিষ্ট্যগত দিক দিয়ে ভিন্ন ছিল। মূলত ভৌগোলিক ও জলবায়ুগত কারণেই এ পার্থক্য ছিল।

ভারতীয় সমাজে সামন্তবাদের উৎপত্তিঃ মধ্যযুগে ভারতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার প্রকৃতি, ভূমিব্যবস্থা, অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাঠামো ইত্যাদি কারণে সামন্তপ্রথা গড়ে ওঠে। তবে ভারতীয় সামন্তবাদে ভূমি মালিকানা আনুপাতিক ছিল। অনানুষ্ঠানিক এ সামন্তপ্রথায় সামন্তপ্রভুরা শুধুমাত্র খাজনা আদায় করত। খাজনা আদায়ের জন্য সাধারণ কৃষকদের ওপর অনেক ক্ষেত্রে নিপীড়ন করা হতো। তবে কৃষকরা পরাধীন উৎপাদক ছিল না। ভারতীয় সামন্তপ্রথা চুক্তিভিত্তিক ছিল। ভারতীয় সামন্তপ্রথার কেন্দ্রীয় বেশ শক্তিশালী ছিল। এলাকাভিত্তিক খামার বা ম্যানর প্রথাও এখানে গড়ে উঠেছিল।

ভারতীয় সমাজে পুঁজিবাদ বিকশিত না হওয়ার কারণঃ ভারতীয় সমাজে ইউরোপের মতো পুঁজিবাদ বিকশিত হয়নি। তার প্রধান কারণগুলো হলোঃ

(১) পুঁজিবাদের জন্য যেসকল উপাদান প্রয়োজন ভারতীয় সমাজে তা অনুপস্থিত ছিল।

(২) ভারতীয় সমাজের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থায় পুঁজিবাদ বিকশিত হওয়ার জন্য প্রতিকূল ছিল। 

(৩) ভারতীয় সমাজে ধর্মীয় বিশ্বাস বেশ প্রবল ছিল।

(৪) ভৌগোলিক পরিবেশ ও জলসেচভিত্তিক অর্থনীতি ছিল পুঁজি বিকাশের অন্তরায়স্বরূপ।

(৫) ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থার কারণে ভারতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিকাশ ঘটতে পারেনি। ফলে শিল্পবিপ্লব হয়নি। 

(৬) ভারতীয় উপমহাদেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাব ছিল। ক্ষমতার পালাবদল ছিল ব্যাপক। ফলে পুঁজিবাদী বিকশিত হওয়ার কোনো সুযোগ তৈরি হয়নি।

(৭) বৈদেশিক শাসকরা তাদের স্থায়িত সম্পর্কে সন্দিহান ছিল। ফলে তারা অর্থনৈতিক উন্নয়নে পুঁজিবাদের চেষ্টা করেননি। 

(৮) ভারতীয় সমাজে স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামব্যবস্থা বিদ্যমান ছিল। ফলে তারা প্রয়োজনীয় সমস্ত জিনিসপত্র স্থানীয়ভাবেই পেত। যার কারণে অর্থনৈতিক গতিশীলতা ছিল মন্থর।

(৯) ভারতীয় সমাজের জাতি-বর্ণ-প্রথা পুঁজিবাদ বিকাশের পথে এক প্রাচীরস্বরূপ বিদ্যমান ছিল।

(১০) ভারতীয় সমাজে বণিকশ্রেণি জমিদার ও সামস্ত পতিদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। ফলে তারা পুঁজি গঠন করতে পারেনি। 

(১১) অনুন্নত যানবাহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, ভারতীয় সমাজব্যবস্থায় আর্থিক, সামাজিক ও ভৌগোলিক প্রেক্ষাপট ছিল পাশ্চাত্য থেকে ভিন্নতর। ফলে এখানে পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটেনি। মূলত গ্রামভিত্তিক সমাজব্যবস্থাই ভারতবর্ষে পুঁজিবাদ বিকশিত না হওয়ার অন্যতম কারণ। কারণ প্রত্যেকটি গ্রাম ছিল প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। গ্রামে মানুষের চাহিদা অনুযায়ী প্রায় সকল জিনিস পাওয়া যেত। গ্রামে উৎপন্ন দ্রব গ্রাম্য বাজারে বিক্রয় হতো। ফলে পুঁজির বিকাশ ঘটেনি। আবার পুঁজিবাদের বিকাশে পুঁজি তৈরি করতে বনিকশ্রেণি ভূমিকা পালন করত। কিন্তু ভারতীয় সমাজে বণিকরা শাসকদের নিয়ন্ত্রণে ছিল ফলে চূড়ান্তভাবে ভারতীয় সমাজে পুঁজিবাদ বিকাশ লাভ করতে পারেনি।