সূচনা: ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য প্রসার রােধে মারাঠারা এগিয়ে আসে। এর পরিণতি হিসেবে ইংরেজদের সঙ্গে মারাঠাদের তিনবার দ্বন্দ্ব বাঁধে।
প্রথম ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধ
[1] সুরাটের সন্ধি:
-
সন্ধি স্বাক্ষর: রাজ্যচ্যুত রঘুনাথ রাও পেশােয়া পদ পুনরায় ফিরে পাওয়ার জন্য ইংরেজদের সাহায্য প্রার্থনা করেন। ফলে ইংরেজ এবং রঘুনাথ রাওয়ের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয় সুরাটের সন্ধি।
-
শর্তাবলি: এই সন্ধির মাধ্যমে স্থির হয়— ইংরেজদের সাহায্য নিয়ে রঘুনাথ রাও পেশােয়া থাকবেন। ইংরেজরা রঘুনাথ রাওকে ২১/২ হাজার সেনা দিয়ে নিরাপত্তা দেবেন যাদের খরচ চালানাের জন্য তিনি কোম্পানিকে মাসে ১১/২ লক্ষ টাকা দেবেন। কোম্পানির বােম্বাই কর্তৃপক্ষকে তিনি গুজরাতের বিস্তীর্ণ অঞ্চল, সলসেট ও বেসিন ছেড়ে দেবেন।
-
ফলাফল: রঘুনাথ রাও ও ইংরেজদের মিলিত বাহিনী আরাসের যুদ্ধে পেশােয়ার সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে। রঘুনাথ রাও পুনরায় পেশােয়া হন। সূচনা ঘটে প্রথম ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধের।
[2] পুরন্দরের সন্ধি: ব্রিটিশ পার্লামেন্টের রেগুলেটিং অ্যাক্ট পাশ করিয়ে বলা হয় বােম্বাই ও মাদ্রাজ কাউন্সিলের সমস্ত সিদ্ধান্ত কলকাতা কাউন্সিলের অনুমােদিত হতে হবে। কলকাতা কাউন্সিল সুরাট চুক্তিকে অনুমােদন হিল বলে উল্লেখ করে। গর্ভনর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস সুরাটের সন্ধি বাতিল করে দিয়ে পেশােয়ার সঙ্গে পুরন্দরের সন্ধি স্বাক্ষর (১৭৭৬ খ্রি.) করেন।
[3] ওয়ারগাঁও এর সন্ধি: মুম্বাই কর্তৃপক্ষ পুরন্দরের সন্ধি মানেনি তারা ইংল্যান্ডের কোম্পানির সভাকে জানিয়ে সুরাটের সন্ধি মেনে রঘুনাথ রাও-এর পক্ষ নেয়। মারাঠা পেশােয়ার পক্ষে নানা ফড়নবিশ লড়াই শুরু করে তা ফড়নবিশের কুটনীতির কাছে রঘুনাথ রাও ও ইংরেজদের মিলিত জোট হার মানে এবং ওয়ারগাঁওয়ের সন্ধি স্বাক্ষরে বাধ্য হয় (১৭৭৯ খ্রি.)।
[4] সলবাই-এর সন্ধি:
-
সলবাই-এর প্রেক্ষাপট: ওয়ারেন হেস্টিংস এই সন্ধি অস্বীকার করে এবং মারাঠাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যান। দীর্ঘস্থায়ী এই যুদ্ধে ইংরেজ শক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। শেষপর্যন্ত মারাঠা নায়ক মাহাদজি সিন্ধিয়ার মধ্যস্থতায় সলবাই-এর সন্ধি (১৭৮২ খ্রি.) স্বাক্ষরিত হয়।
-
সলবাই-এর সন্ধির শর্ত: ইংরেজরা সলসেট ও ব্রোচ লাভ করে। বেসিন মারাঠাদের হাতে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। দ্বিতীয় মাধব রাও পেশােয়া হিসেবে স্বীকৃতি পান। রঘুনাথ রাওকে বার্ষিক বৃত্তিদানের ব্যবস্থা করা হয়। সিন্ধিয়া যমুনা নদীর পশ্চিম উপকূল অবস্থিত সমগ্র ভূখণ্ড ফিরে পান। উভয়পক্ষ যাতে সন্ধির শর্তাবলি মান্য করে তা দেখার দায়িত্ব পান মহাদজী সিন্ধিয়া।
-
সলবাই-এর সন্ধির গুরুত্ব: হেস্টিংসের মারাঠা নীতি ফলপ্রসু হয়নি। বরং ইংরেজদের যথেষ্ট আর্থিক ক্ষতি হয়। সলবাই-এর সন্ধির ফলে পরবর্তী ২০ বছর ইংরেজ ও মারাঠাদের মধ্যে কোনাে সংঘর্ষ হয়নি। এই সুযােগে ইংরেজরা ভারতের অন্যান্য শক্তিকে পরাস্ত করতে পেরেছিল।
[5] বেসিন-এর সন্ধি:
-
পটভূমি: ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে নানা ফড়নবিশের মৃত্যুর পর মহারাষ্ট্রে গৃহ বিবাদের সূচনা হয়। যশােবন্ত রাও হােলকার ও দৌলত রাও সিন্ধিয়ার মধ্যে বিরােধ বাধলে পেশােয়া দ্বিতীয় বাজীরাও সিন্ধিয়ার পক্ষ নেন। এতে ক্রুদ্ধ হয়ে হালকার পুনা আক্রমণ করে পেশােয়া ও সিন্ধিয়ার সম্মিলিত বাহিনীকে পরাজিত করেন। পেশােয়া দ্বিতীয় বাজীরাও আত্মরক্ষার জন্য ইংরেজের সাহায্যপ্রার্থী হন। ফলে উভয়ের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয় বেসিনের সন্ধি (১৮০২ খ্রি.)।
-
বেসিন-এর সন্ধির শর্ত: এই সন্ধির শর্তানুযায়ী স্থির হয়- পেশােয়াকে রক্ষা করার জন্য পুনেতে ৬ হাজার ব্রিটিশ সৈন্য মােতায়েন থাকবে, পেশােয়া কোম্পানিকে বেসিন, সুরাট-সহ কিছু অঞ্চল ছেড়ে দেবে। কোম্পানির অনুমতি ছাড়া পেশােয়া তৃতীয় কোনাে শক্তির সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করতে পারবেন না। নিজাম, গায়কোয়াড় এদের সঙ্গে বিরােধ বাধলে পেশােয়া ইংরেজদের মধ্যস্থতা মেনে নেবেন। কোম্পানি অনুমতি না দিলে সেনাদলে পেশােয়া কোনাে ইউরােপীয়কে নিয়ােগ করতে পারবেন না।
-
বেসিন-এর সন্ধির গুরুত্ব: এইভাবে পেশােয়া দ্বিতীয় বাজীরাও ওয়েলেসলির অধীনতামূলক মিত্রতা নীতি মেনে নিয়ে মারাঠাদের স্বাধীনতা বিকিয়ে দেন। বেসিনের সন্ধির দ্বারা ব্রিটিশের প্রধান দেশীয় প্রতিপক্ষ মারাঠাদের উত্থানের সম্ভাবনা চিরতরে বিনষ্ট হয়।
দ্বিতীয় ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধ
সিন্ধিয়া ও ভোঁসলে এবং পেশােয়া বাজীরাও মনেপ্রাণে এই সন্ধি মেনে নেয়নি। তারা একজোট হয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিলে শুরু হয় দ্বিতীয় ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধ। যুদ্ধে হেরে গিয়ে সিন্ধিয়া ও ভোঁসলে ইংরেজদের সঙ্গে সন্ধি করেন ও অধীনতামূলক মিত্রতা নীতি মেনে নেন। এরপর মারাঠা শক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে।
ইংরেজ-বিরােধী জোট গঠন
দ্বিতীয় ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধে ব্যর্থতার ফলে মারাঠা রাষ্ট্রসংঘে হতাশ দেখা দেয়। তবে স্বাধীনচেতা মারাঠাদের পক্ষে বিদেশি ইংরেজদের কর্তৃত্ব দীর্ঘদিন সহ্য করা সম্ভব ছিল না, তাই পেশােয়ার নেতৃত্বে তারা আবার ইংরেজ বিরােধী জোট গঠন করে।
তৃতীয় ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধ
পটভূমি: গভর্নর-জেনারেল লর্ড হেস্টিংস (লর্ড ময়রা) কঠোর শর্তে পেশােয়াকে পুনার সন্ধি (১৮১৭ খ্রি.) স্বাক্ষর করতে বাধ্য করেন। কঠোর শর্তে সন্ধি আরােপ করায় মারাঠা নেতাদের আত্মমর্যাদা ও জাতীয়তাবাদ আহত হয়। তাই আত্মকলহে দীর্ণ মারাঠারা শেষবারের মতাে পেশােয়ার সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে ইংরেজের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য প্রস্তুত হয়।
যুদ্ধের সূচনা ও সমাপ্তি: পেশােয়া দ্বিতীয় বাজীরাও হঠাৎ কিকির ব্রিটিশ দূতাবাস আক্রমণ করলে তৃতীয় ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধ (১৮১৭-১৮ খ্রি.) শুরু হয়। এই যুদ্ধে পেশােয়ার সঙ্গে যােগ দেন হােলকার, সিন্ধিয়া, ভোঁসলে ও নাগপুরের আগা সাহেব। কিন্তু এই যুদ্ধে পেশােয়া দ্বিতীয় বাজীরাও পরাস্ত হয়ে আত্মসমর্পণ করলে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে।
ফলাফল: এই যুদ্ধের ফলাফলগুলি নিম্নরূপ-
- [a] ইংরেজরা পেশােয়ার রাজ্য পুরােপুরি দখল করে নেয় এবং পেশােয়া পদ বিলােপ করা হয়।
- [b] দ্বিতীয় বাজীরাওকে কানপুরের কাছে বিঠুরে নির্বাসিত করার পাশাপাশি তাকে বাৎসরিক ভাতা দেওয়া বন্ধ করা হয়।
- [c] সাতারার সিংহাসনে শিবাজির জনৈক বংশধর ইংরেজদের ইচ্ছায় নামেমাত্র অধিষ্ঠিত হয়।
- [d] ইংরেজরা সমগ্র মারাঠা সাম্রাজ্যের প্রকৃত অধীশ্বর হওয়ায় অস্তমিত হয় স্বাধীন মারাঠা সাম্রাজ্য গড়ার সম্ভাবনা।
উপসংহার: ইঙ্গ-মারাঠা দ্বন্দ্বে জয়ী হওয়ায় ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের প্রসার অনেক সহজ হয়।
Leave a comment