‘ভক্তিবাদই শাক্ত পদাবলীর প্রাণ’

উত্তর: শক্তি কালী, স্ত্রী দেবতা, শ্যামা মায়ের নিবেদনে রচিত পদাবলীকে শাক্ত পদাবলী বলা হয়। অন্যকথায়, বৈষ্ণব প্রেমবাদের প্রত্যক্ষ প্রভাবে বাৎসল্য রসাশ্রিত শাক্তমত তথা সন্তান বাৎসল্য জননী রূপিণী শ্যামা মায়ের স্তুতির জন্য রচিত শ্যামা সংগীতকেই বলা হয় শাক্ত পদাবলী। প্রাচীন অনার্য নারী দেবতা হচ্ছেন চণ্ডী, যিনি শতাধিক নামে অনার্য সমাজে পুঁজিত হতেন। চণ্ডী হলেন শক্তির দেবতা। ক্রমে আর্য সমাজে তিনি শিবানী, উমা, গৌরী, পার্বতী নামে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। পৌরাণিক যুগে এর মর্যাদা ও প্রতিষ্ঠা অসামান্যরূপে বৃদ্ধি পায়। এ সময় চণ্ডতী কালো বলে শ্যামা নামে শক্তি দেবতারূপে পূজিত হতে থাকেন। বৌদ্ধ প্রভাবের পর চণ্ডীর উগ্র রৌদ্ররূপ কমনীয় করুণাময়ীরূপে পরিণত হয়। ১৮ শতক থেকে শ্যামা ভক্তিবাদ বাংলাদেশে প্রসার লাভ করে। এ মতের আদি সাহিত্যিক হলেন রামপ্রসাদ সেন ১৭২৩-১৭৭৫)।

শাক্ত পদাবলী ভক্তি প্রীতিতে পরিণত হয়ে কবিগানের কল্পনা ও কবিত্বের উৎস উন্মুখ করে দিয়েছে। পদকর্তাগণ ধর্ম সাধনার জন্য ভক্তিবাদকে অবলম্বন করেছেন। উপাস্য দেবতাকে আত্মার আত্মীয় করে নিয়েছেন। সৃষ্টি, স্থিতি ও সংহারকারিণী মহাশক্তিকে লীলারসময়ী পরমানন্দ সাধক একেবারে আপনার করে মাতৃজ্ঞানে আস্বাদ করেছেন। তার উদ্দেশ্য অকপটে মনের আবেগ, বিশ্বাস ও বিস্ময়কে প্রকাশ করেছেন পদাবলীর মাধ্যমে। আত্মোপলব্ধি করতে চেয়েছেন আত্মনিবেদনের মধ্য দিয়ে।

তাই কবি কণ্ঠে আমরা শুনি-

একবার খুলে দে মা চোখের ঠুলি

দেখি শ্রীপদ মনের মত

কুপুত্র অনেক হয় মা, কুমাতা নয় কখনো তো

রামপ্রাসাদের এই আশা মা, অন্ত থাকি পদানত।

শাক্ত পদাবলী মানবের অনুভূতি আকুতিকে আশ্রয় করে গড়ে উঠেছে। মর্ত্যজগতে শোক-তাপ, দুঃখ-বেদনা কবিদের সংবেদনশীল মনকে গভীরভাবে আলোড়িত করেছেন। তাই শাক্ত পদাবলীতে একটি বেদনার সুরও বেজে উঠেছে। এর অন্যতম কারণ সমকালীন সমাজ ও পরিবেশ।

শাক্তপদগুলো রচনাকালে দেশের শাসক সম্প্রদায় এর উদ্ধত অবিচার, অনিয়ম, নির্মম উৎপীড়ন মানুষকে কাতর করে তুলেছিল। ফলে মানুষের শুভবোধগুলো বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছিল। তাই মাতৃরূপী দেবীর প্রতি ভক্তির শক্তিতে শাক্ত কবির হৃদয়ে বীররসের সঞ্চার হয়েছে। তাই কবি রামপ্রসাদ সেন আত্মবোধন পদে বলেছেন-

আমি কি দুখেরে ডরাই?

দুখে দুখে জন্ম গেল, আর কত দুখ দেও, দেখি তাই।

আগে পাছে, দুখ চলে মা, যদি কোনখানেতে যাই

তখন দুখের বোঝা মাথায় নিয়ে দুখ দিয়ে বাজার মিলাই।

শাক্ত কবিদের প্রার্থনায় মাতৃস্নেহ। পার্থিব জগতে ভোগ, পরলোকে স্বর্গের জন্য তারা উৎকণ্ঠিত হননি। তারা চেয়েছেন মাতৃস্নেহ। মায়ের মধুর স্নেহকণার মুক্তিও নিকট অনেক সময় তুচ্ছ বলে মনে হয়েছোয় পার্থিব ভোেগর ভক্তের বিতৃষ্ণা, মুখে তার বিরক্তি, ঐশ্বর্যে অনাসক্তি। তার একমাত্র কামনা জননীর স্নেহ, মায়ের চরণ। ভক্ত একাত্মভাবেই মায়ের পদতলে আশ্রয় লাভের আশা স্তুতির মাধ্যমে ব্যক্ত করেন।

শাক্ত কবির পদে তাদের আরাধ্য দেবীর চিত্র স্নেহময়ী মাতৃরূপে অঙ্কিত হয়েছে। মায়ের উপর একান্ত নির্ভরশীল শিশু যেমন জননীর প্রতি স্নেহের দাবিতে আবদার করে, শাক্ত পদকর্তারাও তেমনি শ্যামা মায়ের নিকট আবদার করেছেন। দুঃখ বেদনায় দগ্ধ হয়ে তার সাথে কলহ করেছেন কিন্তু তাদের কলহ গঞ্জনা প্রকট। তার মধ্যেই শ্যামা মায়ের প্রতি অগাধ ভক্তি বিশ্বাসের পরিচয় ফুটে উঠেছে। আত্মসমর্পণের ভক্তিরসে শ্যামাসংগীত পরিপূর্ণ।

শ্যামা জননীকে সকল শক্তির আধার জেনেও তারা দেবীকে কেবল অন্তরের শ্রদ্ধা নিবেদন করেননি। শ্যামার সাথে নিগূঢ় স্নেহের, মধুর রসের সম্পর্ক স্থাপন করে তার কাছে অন্তরের প্রীতিও নিবেদন করেছেন। আরাধ্য এবং আরাধকের মধ্যকার এ স্নেহ মধুর সম্পর্ক শাক্ত পদে অপরূপ সৌন্দর্যে ভূষিত হয়েছে। শাক্ত সংগীত সাধক ভক্তি ও শান্তরসের প্রসরণ। শাক্ত পদকর্তাদের নিকট কালী অনেক সুন্দর, ভয়ংকর, মধুর, কোমল এবং কঠোর। পৃথিবীর দুঃখের আঘাতে শাক্ত বীরের ভঙ্গিতে প্রশ্ন করেছেন-

“কোন অধিকারে আমার পরে

করলে দুখের ডিক্রি তারি।”

জন্ম যন্ত্রণায় অস্থির, ত্রিবিধ তাপে জর্জরিত, কাম সিন্ধুনীরে নিমজ্জিত ভক্তের আর্তনাদে আকাশ বাতাস পরিপূর্ণ হয়ে উঠে। মনে জাগে ব্যাকুল প্রশ্ন। এমন আশ্রয় নেই যেখানে ঠাঁই মিলতে পারে। সন্তান একুল-ওকুল হারা। তখন মার দিকে ভক্ত ফিরে দাঁড়িয়ে বলেন-

বল মা আমি দাঁড়াই কোথা?

আমার কেহ নাই শঙ্করী হেথা।

অনুরাগ, অভিমান যাই থাকুক না কেন পরম শরণাগতি আকুতি ভঙ্গের সর্বপ্রধান আকুতি। ভক্ত জানেন যে, যা চিন্তাময়ী, তারিণী শঙ্করী, কল্পনাময়ী, তিনিই একমাত্র স্মরণযোগ্য। তিনি আবার ত্রাণকর্ত্রীও বটে। সুতরাং মায়ের সাথে যতই দ্বন্দ্ব হোক মায়ের স্নেহ চরণই একমাত্র ভরসা। তাই ভক্তের অভিপ্রায় এরকম-

দ্বন্দ্ব হবে মায়ের সনে

তবু বর মায়ের চরণে।

ভক্ত মায়ামোহে যতই আবদ্ধ থাকুক না কেন তার জ্ঞানদৃষ্টি একেবারে আচ্ছন্ন নয়। । সকল রিপু সম্পর্কে ভক্তের সজাগ জ্ঞান আছে। অতএব, মোহমুক্তি লাভ করতে হলে মহামায়াকেই আশ্রয় করতে হবে। তাই ভক্ত বলেন-

মন তোর এত ভাবনা কেন।

একবার কালী বলে বসরে ধ্যানে।

যেকোনো সাধনার প্রথম সোপান হচ্ছে ইষ্টের প্রতি একান্ত | নিষ্ঠা। এই নিষ্ঠার উদয় না হলে সাধনার সার্থকতা নেই। সাধন কর্মের প্রথম প্রয়োজন নিখুঁত শ্রদ্ধা। এই শ্রদ্ধা থেকে ভক্তি, ভাব এবং প্রেম জন্মে। সেই প্রেম থেকেই ভক্ত মাকে বিভিন্নভাবে আরাধনা করার আকাঙ্ক্ষা করেছে। তবে বাহ্য পূজা নয়, অন্ত পূজার দিকেই ভক্তের ঝোঁক। “ভক্তি আছে মা আমার, তাই দিব উপহার।” বস্তুত এই ভক্তিই শাক্ত পদাবলীতে শতধারা উৎসারিত হয়ে আধ্যাত্ম ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করেছে।

পরিশেষে বলা যায় যে, মাতৃরূপিণী, শ্যামামায়ের প্রতি ভক্তি ও শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্যই মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে শ্যামাসঙ্গীত রচিত হয়েছিল। আর শ্যামাসংগীত তথা শাক্ত পদাবলীতে ভক্তের মান অভিমানের সুর প্রবলভাবে ফুটে উঠেছে।