বৈষ্ণব পদকর্তাগণ ছিলেন সকলেই ভক্ত মহাজন। তাঁদের কাছে বৈষ্ণবীয় তত্ত্ব তথা গৌড়ীয় বৈষ্ণবদর্শন অধ্যাত্মসাধনার মূল ভিত্তিস্বরূপ ছিল। কাজেই বৈষ্ণব পদাবলীতে অতি সহজেই এই অধ্যাত্মতত্ত্বের প্রলেপ লেগেছে। বলা বাহুল্য, বৈষ্ণব পদাবলীর মূল রস হল মধুর রস।

কৃষ্ণ আপন আনন্দশক্তির আস্বাদনের জন্যই জীব ও জগৎকে সৃষ্টি করেছেন। বৈষ্ণব দর্শন মতে, জীবমাত্রেই নারী পুরুষ নির্বিশেষে কৃষ্ণের আনস্ত শক্তির অংশ। জীবনের প্রতীক রাধা, কৃষ্ণ অপ্রাকৃত বৃন্দাবন ধামে রাধিকার সঙ্গে প্রেমলীলার মত্ত। এই জীবন ও জগৎ হচ্ছে পরম পুরুষের জ্ঞানের ও পূর্ণানন্দের আশ্রয়। এই প্রকৃতি নিত্যকাল পুরুষের অনুকরণ করছে আর পুরুষ তাঁকে আকর্ষণ করছে, ব্যক্ত ও অব্যক্তের নিত্যলীলাই পুরুষ ও প্রকৃতির লীলা। অব্যক্ত আমাদের কাছে তত্ত্ব মাত্র, কিন্তু তিনি তখন ব্যক্ত হন তখন আমরা তাঁকে বুঝতে পারি। এদের মধ্যে যুগপৎ ভেদ ও অভেদের সম্পর্ক, এটি অচিন্ত্য, মানববুদ্ধির অতীত, এটাই বৈষ্ণবের অচিন্ত্যভেদাভেদ তত্ত্ব। গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শনের সিদ্ধান্ত অনুসারে একমাত্র ভক্তিই কৃষ্ণ প্রাপ্তির উপায়।

বৈষ্ণব পদাবলী সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের অভিমতটি বিশেষ প্রণিধানযোগ্য, “অসীমকে সীমার মধ্যে আনিয়া ভক্ত তাহাকে উপলব্ধি করিয়াছেন। আকাশ যেমন গৃহের মধ্যে আবদ্ধ হইয়াও অসীম এবং আকাশই, সেইরূপ রাধা কৃষ্ণের মধ্যে পরিচ্ছিন্ন হইয়াও অসীম ব্রহ্মই আছেন। মানব মনে অসীমের সার্থকতা সীমা বন্ধনে আসিয়া। তাহার মধ্যে আসিলেই অসীম প্রেমের বস্তু হয়। নতুবা প্রেমাস্বাদ সম্ভবই নয়। অসীমের মধ্যে সীমাও নাই প্রেমও নাই। সঙ্গীহারা অসীম সীমার নিবিড় সঙ্গ লাভ করিতে চায়—প্রেমের জন্য। ব্রহ্মের কৃষ্ণরূপ ও রাধারূপের মধ্যে এই তত্ত্বই নিহিত।”

বাস্তুব জগতে নরনারীর প্রেমলীলার আধারেই এই পুরুষ প্রকৃতির লীলাকে বৈষ্ণব দর্শন ও সাহিত্যে রূপ দেওয়া হয়েছে। এই লীলারস উপলব্ধ করাবার জন্য বৈষ্ণব দর্শন ও সাহিত্যে পরমপুরুষকে প্রেমিকপ্রবণ চিরযৌবনসম্পন্ন কৃষ্ণ রূপে, এবং জীবন ও প্রকৃতিকে অনন্তযৌবনা রাধারূপে কল্পনা করা হয়েছে এবং এই প্রেমিক যুগলের প্রেমলীলা মানুষী প্রেমের আধারে ব্যক্ত করা হয়েছে। তত্ত্বের দিক থেকে রাধা কৃষ্ণের স্বশক্তিরই অভিব্যক্তি বলে স্বকীয়া এবং লৌকিক দৃষ্টিতে আয়ান বধু কৃষ্ণের পরকীয়া। জীব রূপ-রস-শব্দ-গন্ধ-স্পর্শের সহস্র বাঁধনে বাঁধা বলে জগতের স্বকীয়া, ভগবানের পরকীয়া। ঈশ্বর আহ্বানে সারা দিতে হলে জীবকে সংসার বন্ধন তুচ্ছ করে বের হতে হয়। এটাই পরকীয়ার অভিসার। ললিতা, বিশাখা, চন্দ্রাবলী, রাধা সকলেই হ্লাদিনীর মানবী রূপ। তার মধ্যে রাধাতে হ্লাদিনীর পূর্ণতম প্রকাশ। রাধা, ললিতা, বিশাখা প্রভৃতির কৃষ্ণরতি স্বভাবসিদ্ধ বলে তাঁদের সাধ্যভক্তি, জীবের কৃষ্ণভক্তি সাধন সাপেক্ষ বলে তা সাধনভক্তি। অর্থাৎ জীবকে গোপীভাবে কৃষ্ণকে সাধনা করতে হবে। একমাত্র চৈতন্যদেবই রাধাভাবে ভজনার অধিকারী ছিলেন।

আত্মেন্দ্রিয় প্রীতি ইচ্ছাকে ভক্তবৈষ্ণব কৃষ্ণেন্দ্রিয় প্রীতি ইচ্ছায় সমর্পণ করেন। রাধাভাবে ভাবিত জীবাত্মা যখন পরমাত্মা কৃষ্ণের সঙ্গে অস্তবৃন্দাবনে প্রেমবিলাস করেন তখন দ্বৈতভাবের ক্ষণিক তিরোভাব ঘটে, লীলার জন্য আপন আনন্দাংশ থেকে যে জীব সৃষ্টি করেছেন সেই জীব যখন তাঁর সঙ্গে একাত্ম হয়ে যায় তখন—

না সো রমণ না হাম রমণী। 

দুহু মন মনোভব পেষল জানি।।

এটাই হল মোটামুটিভাবে গৌড়ীয় বৈষ্ণব তত্ব, এই তত্ত্বকে বৈষ্ণব কবিরা কাব্যরূপ দিয়েছেন। এই কাব্যের নায়ক শ্রীকৃষ্ণ, নায়িকা শ্রীরাধা। এঁদের বিরহ-মিলন মধুর প্রেম কাহিনীই বৈষ্ণব কাব্যে রূপ পেয়েছে। বলা বাহুল্য, বৈষ্ণব কবিরা তাঁদের পারিপার্শ্বিক জগৎ থেকে সাধারণ নরনারীর প্রেমলীলার দ্বারা উদ্বুদ্ধ না হলে রাধাকৃষ্ণের অপ্রাকৃত প্রেমকাহিনী এত সুমধুর মর্মস্পর্শী হত না। বৈষ্ণব কবিরা সচেতন ভাবে সর্বদা বৈষ্ণব তত্ত্বকে অনুসরণ না করলেও এই তত্ত্বের প্রভাব তাদের মনে সর্বদাই জাগ্রত ছিল।

কিন্তু তাই বলে বৈষ্ণব মহাজনবৃন্দ পদাবলীর প্রেমলীলার মধ্যে দিয়ে দার্শনিক তত্ত্ব বা ধর্মতত্ত্ব ব্যাখ্যা বা প্রচার করতে সচেষ্ট হননি। পদাবলী সাহিত্যের মধ্যে মধুর রসের লীলাই সর্বাপেক্ষা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। মহাপ্রভু নিজে পদাবলীর মধ্যে তত্ত্বকথা ঢুকিয়ে রসভঙ্গ ঘটাতে পছন্দ করতেন না— কাব্যের মধ্যে যে নিবিড় মধুর রস পরিবেশিত হয় তাই আস্বাদন করে তিনি আনন্দ লাভ করতেন। বস্তুত, কাব্যের রসবস্তু জীবনের যতখানি প্রেরণা বা আবেগ সঞ্চার করতে পারে, শুষ্ক তত্ত্বকথায় তা সম্ভব নয়। এইজন্য বৈষ্ণব ভক্তকবিরা বৈষ্ণব তত্ত্বে বিশ্বাসী হলেও কাব্যের মধ্য দিয়ে প্রেমলীলাকেই বিচিত্র বর্ণে সমৃদ্ধ করে তুলেছেন।

বৈষ্ণব পদাবলীর মধ্যে মহাজনবৃন্দ প্রেমিক-প্রেমিকার জীবনের বিচিত্র রূপ ফুটিয়ে তুলেছেন। সকল কবিই কাব্যের মধ্যে মানবের বিচিত্র মনোজগতের রূপ প্রস্ফুটিত করেন— পদাবলীর মধ্যেও প্রেমমুগ্ধ অন্তরের বিচিত্র প্রকাশ ঘটেছে।

চৈতন্যদেবের আগমনের অনেক পূর্বেই বৈষ্ণব পদাবলীতে বৈষ্ণবতত্ত্ব আরোপ করার চেষ্টা হচ্ছিল। জয়দেব, বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস প্রভৃতির পদে এই বৈষ্ণবতত্ত্বের প্রচ্ছন্ন প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। তবে চৈতন্যদেবের পুণ্যজীবনের প্রভাবেই যে বৈষ্ণবপদাবলী লৌকিক জগতের সীমানা ছাড়িয়ে অতীন্দ্রিয় ভাবদ্যোতক হয়ে ওঠে তাতে সন্দেহ নেই। সেজন্য চৈতন্য-পরবর্তী ভক্ত কবিদের রচনায় মানসিক প্রেমলীলার সাথে ঈশ্বরানুভূতির সার্থক প্রকাশ দেখা যায়। চৈতন্য পরবর্তী বৈষ্ণব পদসমূহ লৌকিক জগতের গল্পমাখা হলেও ‘কামগন্ধহীন নিকষিত হেম।’