অথবা, চণ্ডীদাস ও জ্ঞানদাসের ভাব ভাষার সাদৃশ্য বৈসাদৃশ্য নির্ণয় কর

অথবা, চণ্ডীদাস ও জ্ঞানদাসের কবি প্রকৃতির তুলনা কর

উত্তর: বাংলা ভাষায় বৈষ্ণব পদাবলীর আদি রচয়িতা ও শ্রেষ্ঠ কবি হলেন চণ্ডীদাস। আর কবি জ্ঞানদাস হলেন চণ্ডীদাসের ভাব শিষ্য। উভয়ের রচনায় ভাব-রূপের চমৎকার অভিব্যক্তি ঘটেছে। তন্ময়তা উভয় কবিরই ছিল এবং ব্যক্তিগত হৃদয়োত্তাপতঁয়া কাব্যে সঞ্চারিত করতে পারতেন। তাঁদের এই স্বকীয় উপলব্ধি সম্পর্কে সমালোচক শ্রীশঙ্করী প্রসাদ বসু মন্তব্য করেছেন,

“অন্য এক শ্রেণির পদকর্তা আছেন যাঁহারা মূলত ভাববিদ্ধ প্রাণ তন্ময়। তাঁহারা যখন কথা বলেন, রাধার মুখে কহিলেও তাহা ঐ কবিদের নিজের কথাই থাকিয়া যায় এবং কবিদের সেই ব্যক্তিগত ‘বাণী’, রস সৃষ্টির কৌশলে নিত্যকালের বাণী হইয়া উঠে। রাধার কথা তখন বিশেষ রাধার কথা, নির্বিশেষে সকলের কথা। এই একান্ত আনন্দ বেদনার ভাষাটুকু যাঁহারা বৈষ্ণব কাব্যে আবিষ্কার করিয়াছেন, তাঁহারা হইতেছেন চণ্ডীদাস ও জ্ঞানদাস।” ( মধ্যযুগের কবি ও কাব্য)

চণ্ডীদাস ও জ্ঞানদাসের তন্ময় আত্মলীনতার মুখে একটি গভীর মিল ছিল। তাঁরা উভয়েই বিশিষ্ট কবিমনের অধিকারী ছিলেন। উভয়ের কবিতা ‘লিরিক’ অর্থাৎ গীতিধর্মসম্পন্ন। ভাব ও ভাষাগত সাদৃশ্য চণ্ডীদাস ও জ্ঞানদাস ভণিতার বহু পদে মেলে। নিচে কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া হলো:

চণ্ডীদাস লিখেছেন,

‘গুরুজন মাঝে যদি থাকিয়ে বসিয়া।

পরসঙ্গে নাম শুনি দর বয়ে হিয়া।।

পুলক পূরয়ে অঙ্গ আঁখে নামে জল।

তাহা নিবারিতে আমি হইয়ে বিকল।।’

একই আদর্শে জ্ঞানদাস লিখেছেন,

‘গুরু গরবিত মাঝে রহি সখী-সঙ্গে।

পুলকে পুরয়ে তনু শ্যাম পরসঙ্গে।।

পুলক ঢাকিতে করি কত পরকার।

নয়নের ধারা মোর বহে অনিবার।।’ (পদ-৬১)

চণ্ডীদাস ও জ্ঞানদাসের প্রেমদৃষ্টির মধ্যে অতলস্পর্শী গভীরতা ছিল। এই গভীরতা রাধার চিত্তদীর্ণ তীব্র ব্যাকুলতা তো বটেই, কবিদের নিজেদেরও হৃদয় বিদীর্ণকারী বেদনা প্রকাশ করেছে। ‘মান’ পর্যায়ের একটি পদে চণ্ডীদাসের রাধা রয়েছে,

সই, কেমনে ধরিব হিয়া

আমার বঁধুয়া আন বাড়ী যায়

আমার আঙিনা দিয়া। (পদ-১৯০)

অনুরূপভাবেই জ্ঞানদাসের রাধাও আপন দুঃখের কথা বলতে গিয়ে সখীকে বলেছে,

সই, কত না রাখিব হিয়া

আমার বঁধুয়া আন বাড়ী যায়

আমারি আঙ্গিনা দিয়া ৷।

উভয় কবির ভাব ও ভাষায় এমন আরো সাদৃশ্য রয়েছে। তবে একটু অন্তরঙ্গভাবে লক্ষ করলে দেখা যায়, চণ্ডীদাসের কাব্যে ভক্ত কবির আত্মশীলতার সুর তাঁকে সম্পূর্ণভাবে কৃষ্ণ রাধিকা শ্রীরাধার সঙ্গে এক করে দিয়েছে। দৃষ্টান্ত,

‘সই, কেবা শুনাইল শ্যাম-নাম।

কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল গো

আকুল করিল মোর প্রাণ॥’ (পদ-৫৭)

শ্যামের নাম মাত্র শুনে রাধার মতো কবির গভীর প্রেমানুভূতির রাজ্যে প্রবেশ করেছেন। এখানে রাধার প্রেম ইন্দ্রিয় বোধের ঊর্ধ্বচারী। ফলে অনেক সমালোচক চণ্ডীদাসের প্রেমের মানবিক রূপ গ্রাহ্য করতে চাননি। অন্যদিকে, জ্ঞানদাস তাঁর পদগুলোতে ব্যক্তিক কবিসত্তার লিরিকধর্মী প্রেমবেদনাকে প্রকাশ করেছেন। জ্ঞানদাস ভাব বৃন্দাবনের রাধাকৃষ্ণের ধর্মীয় জগতের ছবি আঁকতে গিয়েও তারই ফাঁকে ফাঁকে আপন মনের নিভৃত ভাবনার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। যেমন ছলনাকারী নাগর কানু কদম্বতলে রাধার মন চুরি করেছে। এই বিস্ময়কর প্রেমানুভূতি কবি প্রকাশ করেছেন এভাবে,

আলো মুঞি কেন গেলু কালিন্দীর জলে।

কালিয়া নাগর চিত হরি নিল ছলে।। (পদ-৬০)

এছাড়াও চণ্ডীদাস ও জ্ঞানদাসের মধ্যে ক্ষেত্রবিশেষে আরও পার্থক্য রয়েছে। যে পার্থক্য কাব্যের পরিণতির ব্যাপারে উভয় কবি একইভাবে আরম্ভ করেন কিন্তু চণ্ডীদাস তাঁর কাব্যের সমাপ্তিতে ব্যক্তিগত অনুভূতিকে এমনই নির্বিশেষে করে ফেলেন যে, শেষ পর্যন্ত তাঁর কাব্যরূপ অনেকাংশে শিথিলতা পায়। চণ্ডীদাসে যে পরিমাণ গভীরতা ছিল, সেই পরিমাণে রূপসৃষ্টির ক্ষমতা ছিল না। অথবা বলা যায় রূপাঙ্কণের দিকে তাঁর যেন কোনো আকর্ষণই নেই চণ্ডীদাসের কাব্যের বিচ্ছিন্ন পংক্তি রূপের ক্ষণিক চাঞ্চল্য মাত্র সৃষ্টি করেই একাকারের ভাবপ্লাবনে আত্মহারা হয়ে যায়। তাই শেষ পর্যন্ত তিনি মিস্টিক।

“চলে নীল শাড়ি নিঙাড়ি নিঙাড়ি পরাণ মোহিত মোর।” এই ধরনের রোমান্টিক রসানুভূতি চণ্ডীদাস অল্প ক্ষেত্রেই প্রকাশ করেছেন। এটাকে অতিক্রম করে এক অতীন্দ্রিয় ভাবাকুলতায় প্রাণ সমর্পণ করতে তাঁর পরম তৃপ্তি। তাই অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁর কাব্যে রূপরহস্য নয়-

অপার্থিব উক্তি প্রাণ তাই জয়যুক্ত হয়েছে।

‘সদাই ধেয়ানে চাহে মেঘ-পানে

না চলে নয়ান-তারা।

বিরতি আহারে রাঙ্গা বাস পরে

যেমত যোগিনী-পারা।। (পদ-৫৯)

এটাই চণ্ডীদাসের কাব্যের মূলভাব। আত্মনিবেদনের ভক্তি ক্ষেত্রে তাঁর প্রতিভার বিশেষ বিকাশ ঘটেছে।

একটি উদাহরণ:

“বঁধু কি আর বলিব আমি

জীবনে মরণে জনমে

জনমে প্রাণনাথ হৈও তুমি।”

জ্ঞানদাসের মধ্যেও ভক্তিপ্রবণতা আছে এবং তাঁরও আত্মনিবেদন চমৎকার। তথাপি জ্ঞানদাসের কাব্য মিস্টিক হয়ে পড়েনি। তাঁর কাব্যের একটি মূলধর্ম রোমান্টিকতা। রোমান্টিক। রহস্যময়তায় জ্ঞানদাসের কাব্য পূর্ণ। তাছাড়া জ্ঞানদাস হৃদয়ার্তিকে। রূপ চিত্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে সঞ্চারিত করে দিয়েছেন। ভাবের বর্ণে বস্তুর ছবি এঁকেছেন, যে ছবির রেখা অরূপের আকুল তৃষ্ণায়, অস্পষ্টতায় কুহেলিঘেরা রহস্যরাজ্যে বিলীন হয়ে গেছে। দৃষ্টান্ত,

‘রূপের পাথারে আঁখি ডুবিয়া রহিল।

যৌবনের বনে মন হারাইয়া গেল।। (পদ-৬০)

এই চিত্রাঙ্কনে জ্ঞানদাস নিছক বৃন্দাবনের রাধাকৃষ্ণ লীলার রূপকার নন, সর্বকালের যৌবনের দূত, তরুণ-তরুণীর জীবন অনুভূত আনন্দ রহস্যময় প্রেমানুভূতির সহৃদয় চিত্রকর। এই রহস্যময়তাটুকু জ্ঞানদাসের নিজস্ব সম্পদ, অন্যান্য বৈষ্ণব কবির কবিধর্মের সাথে জ্ঞানদাসের পার্থক্য এখানেই।

চণ্ডীদাস ও জ্ঞানদাস- উভয় কবির কাব্যে আমরা একটি বিষাদের সুরকে বাজতে দেখি। প্রায় সকল শ্রেষ্ঠ বৈষ্ণব পদকারের মধ্যে হতাশা বা আর্তির অনুভূতির প্রকাশ থাকায়ও জ্ঞানদাস এক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠতর। চণ্ডীদাসও চরম মিলনের দিনে বিচ্ছেদের ভয়ে শঙ্কিত এবং গভীর আলিঙ্গনে থেকেও বলেছে,

‘এমন পিরীতি কভু দেখি নাই শুনি।

পরাণে পরাণে বান্ধা আপনা-আপনি।।

দুহু ক্রোড়ে দুহু কাঁদে বিচ্ছেদ ভাবিয়া।

আধ তিল না দেখিলে যায় যে মরিয়া।।’ (পদ-১৮৮)

কিন্তু জ্ঞানদাসের মত বার বার নয়-

‘রূপ লাগি আঁখি ঝুরে গুণে মন ভোর।

প্রতি অঙ্গ লাগি কান্দে প্রতি অঙ্গ মোর।।

হিয়ার পরশ লাগি হিয়া মোর কান্দে।

পরাণ-পিরীতি লাগি থির নাহি বান্ধো।।’ (পদ-৬১)

এরকম গীতিক্রন্দন বৈষ্ণব সাহিত্যে সত্যিই বিরল।

চণ্ডীদাস ও জ্ঞানদাস উভয়ের কবিতায় একটি মাধুর্যের প্রকাশ লক্ষণীয়। ফলে সর্বগ্রাসী হাহাকার, মর্ম বিদারণ, বক্ষবিদার ক্রন্দন- এগুলো তাঁদের পদে নেই। মাধুর্যগুণের কারণে মানুষ বিরহ পদে চণ্ডীদাস ও জ্ঞানদাস বিশেষ সাফল্য দেখাতে পারেনি। মানুর শেষে দীর্ঘকাল পরে দেখা হলে চণ্ডীদাসের রাধা শুধু বলে:

বহু দিন পরে বঁধুয়া এলে।

দেখা না হইতে পরাণ গেলে ৷৷

…………………………..

দুখিনীর দিন দুখেতে গেল।

মথুরা নগরে ছিলে ত ভাল ৷৷ (পদ-২৭৮)

জ্ঞানদাসের বেদনায়ও এত গভীরতা নেই। বেদনাকে তিনিও সুমিষ্ট করে প্রকাশ করেছেন। রাধার বিরহদশা প্রকাশ করতে গিয়ে তিনি কোনো আবেগের সঞ্চার করেন না, কেবল শান্ত সংক্ষিপ্ত বিরল বর্ণ উক্তিতে ব্যথার্ত অবস্থাটি বর্ণনা করেছেন। কৃষ্ণের বিরুদ্ধে অভিযোগের সুরেও উত্তেজনা নেই। চণ্ডীদাসের মতো জ্ঞানদাসের পদেও উচ্চরব হাহাকার অপেক্ষা অভাগা কণ্ঠের অশ্রুসিক্ত আক্ষেপ ও আত্মধিক্কারই মুখ্য হয়েছে,

সুখের লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু

অনলে পুড়িয়া গেল।

অমিয়া-সাগরে সিনান করিতে

সকলি গরল ভেল ৷৷ (পদ-১২৪)

আত্মনিবেদনের পদে আবার চণ্ডীদাস ও জ্ঞানদাসের মধ্যে খানিকটা পার্থক্য রয়েছে। চণ্ডীদাসের আত্মনিবেদন সত্যকার আত্মসমর্পণে সার্থক। তার মধ্যে আত্মগৌরব অবশিষ্ট নেই। চণ্ডীদাসের রাধা বলেছে,

‘বধু তুমি সে আমার প্রাণ।

দেহ মন আদি তোঁহারি সঁপেছি

কুলশীল জাতি মান ৷৷’ (পদ-৩০৮)

অপরপক্ষে, জ্ঞানদাসের রাধাকৃষ্ণের প্রেমভাজন হলেও গৌরবটুকু ছাড়তে রাজি নয়; তাই তো রাধা বলেছে,

বঁধু, তোমার গরবে গরবিনী আমি

রূপসী তোমার রূপে।

হেন মনে করি ও দুটি চরণ

সদা লইয়া রাখি বুকে ৷৷’ (পদ-৩১০)

পরিশেষে বলা যায় যে, চণ্ডীদাস চৈতন্য পূর্ববর্তী আর জ্ঞানদাস চৈতন্য পরবর্তী যুগের কবি। উভয়েই প্রাণ তনায়- ভাবসিদ্ধ কবি। রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা বর্ণনায় চণ্ডীদাস যে বিশিষ্ট ধারা প্রবর্তন করেছিলেন জ্ঞানদাস তাই অনুসরণ করেছে। তবে দুই কবি-ই স্ব স্ব যুগের শ্রেষ্ঠ কবি হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করেছেন।