অথবা, বৈষ্ণব পদকর্তা হিসেবে গোবিন্দদাসের কবি প্রকৃতির পরিচয় দাও

অথবা, গোবিন্দদাসের পদসমূহের শিল্প মাধুর্য বিচার কর

উত্তর : মধ্যযুগের বৈষ্ণব কবিদের মধ্যে গোবিন্দদাস কবিরাজ ‘রূপসিদ্ধ কবি’ হিসেবে পরিচিত। তিনি চৈতন্যোত্তর যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পদকর্তা। ভক্তি আকুলতাকে রচনার সৌকর্যের সাথে দ্বিধাহীন সম্বন্ধে আবদ্ধ না করলে কবিতার সার্থক রসাবেদনের রাজ্যে তার স্থান হয় না- এ বোেধ গোবিন্দদাসের ছিল। তাছাড়া বৈষ্ণবধর্ম ও রসশাস্ত্রের গভীর জ্ঞান তাঁর ছিল। ফলে তাঁর কবিপ্রতিভা ধর্মবুদ্ধির দ্বারা আচ্ছন্ন হয়নি এবং রূপ- রচনার দিকে সচেতন প্রবণতা, অলঙ্করণের অতন্দ্র নিষ্ঠা তাঁর কবি প্রকৃতির বৈশিষ্ট্যরূপে পরিগণিত হয়েছে।

বৈষ্ণব পদকর্তা হিসেবে গোবিন্দদাসের কবি প্রকৃতির বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ প্রসঙ্গে যে লক্ষণগুলো প্রকাশ পেয়েছে তা হলো- কবির ভক্তিপ্রাণতা, চিত্রধর্মিতা, আত্মসংযম, নাটকীয়তা, আলঙ্কারিতা, সংগীতগুণ এবং কাব্যবস্তু অর্থাৎ বিভাবাদি হতে আর্টিস্টের দূরত্ব বজায় রাখার ক্ষমতা। মূলত এগুলোর সাহায্যে গোবিন্দদাসের কবিধর্মের স্বরূপ সন্ধান করা সম্ভব।

গোবিন্দদাস একজন পরম ভক্ত- ভাবাকুল হৃদয়ের অধিকারী। তিনি বৈষ্ণব ধর্মসম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত তো বটেই, শ্রীনিবাস আচার্যের প্রত্যক্ষ শিষ্য। তত্ত্বের সাথে পরিচিতই শুধু নন, তত্ত্বজ্ঞানে প্রাজ্ঞ। তাঁর কবিচিত্ত তাই রাধার প্রেমের তাত্ত্বিক চেতনা ছাড়া কোনো মানবিক প্রেমের বিশিষ্টতা কল্পনা করতে সক্ষম হয়নি। কৃষ্ণের ভাবরূপ বা চরিত্র চিত্র তাঁর কবিতায় ফুটে উঠেনি। তত্ত্ববোধের সাহায্যে কৃষ্ণের বিরহ ও গৌরাঙ্গের বিরহকে মিলিয়ে দিয়েছেন সহজেই। তত্ত্ববোধের এ জয়ে কবি কল্পনার জয় হয়নি। গোবিন্দদাস রাধার মধ্যে তাত্ত্বিক সাধনভাবটি কোথাও পরিহার করতে পারেননি। সমালোচকের ভাষায়,

“গোবিন্দদাস তাঁহার ভাষা, ছন্দ, ভাব ও অলঙ্কারের বিশেষ প্রকৃতির সহায়তায় রাধাকৃষ্ণের অপ্রাকৃতলোকে প্রাকৃতজনের দৃষ্টি মেলিবার অবসরটুকু দিয়াছেন।” [মধ্যযুগের কবি ও কাব্যঃ শঙ্করী প্রসাদবসু]

গোবিন্দদাস মূলত চিত্ররসের কবি। তিনি ভক্তি আবেগ আকুলতাকে চিত্ররূপে সংহত করেছেন। তাঁর চিত্র বস্তুলোকের- চিত্তলোকের নয়। হৃদয়ানুভূতির গভীর আর্তি সহযোগে রচিত চিত্র নয়। গোবিন্দদাসের কবিমন অন্যলোকের অধিবাসী। দেহরূপ, গতিভঙ্গি, বস্তুবিশ্ব ও প্রকৃতির চিত্রাঙ্কনে তাঁর সার্থকতা। তিনি বিষয়বস্তুর স্বাভাবিক ঘটমানতার চিত্রগুলোকে জীবন্ত করে তুলেছেন। চিত্র সৃষ্টির নানা পদ্ধতির মধ্যে দুটি প্রধান- প্রত্যক্ষ চিত্র ও অলঙ্করণ প্রাণ চিত্র। গোবিন্দদাস উভয় শ্রেণির চিত্র রচনায় দক্ষ। নিচে কয়েকটি উদাহরণ তুলে ধরা হলো:

১. অলঙ্কার বহুল চিত্রের উদাহরণ-

‘যাঁহা যাঁহা নিকসয়ে তনু তনু জ্যোতি।

তাঁহা তাঁহা বিজুরি চমকময় হোতি ৷৷ (পদ-৫২)

২. আবার অলঙ্কারের সাহায্য না নিয়েও গোবিন্দদাস ছবি এঁকেছেন। যেমন-

‘ঢল ঢল কাঁচা অঙ্গের লাবণি

অবনী বহিয়া যায়।

ঈসত হাসির তরঙ্গ-হিলোলে

মদন মূরুছা পায় ৷৷’ (পদ-২৫)

৩. রাধার অভিসারের চিত্রাঙ্কনে কবির সাফল্য তুলনা রহিত। যেমন-

‘সুন্দরি কৈছে করবি অভিসার।

হরি রহ মানস-সুরধুনী-পার ৷৷

ঘন ঘন ঝন ঝন বজর-নিপাত।

শুনইতে শ্রবণে মরম জরি যাত ৷৷

গোবিন্দদাসের কবিধর্মের মূলগত বৈশিষ্ট্য আত্মসংযম। হৃদয়ের আকুলতাকে কোথাও তিনি অকূল করেন না। রূপদক্ষ শিল্পীর মতো যথাদৃষ্ট রূপকে ভাষার তুলিকায়, অপূর্ব লাবণ্যরসে ডুবিয়ে প্রাণ সংযমে তিনি চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন।

অলঙ্করণের প্রতি গোবিন্দদাসের প্রবণতা কবির আরেকটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। এই অলঙ্করণ প্রবণতা তিনি পূর্বসূরি বিদ্যাপতি থেকে গ্রহণ করেছেন ভাবতিনি। সচেতন কাব্যশিল্পী ছিলেন বলে সংস্কৃত অলঙ্কারের প্রভাবও তাঁর কবিতায় খুব বেশি লক্ষ করা যায়। কয়েকটি দৃষ্টান্ত:

১. যাঁহা যাঁহা ভাঙ্গুর ভাঙ বিলোল।

তাঁহা তাঁহা উছলই কালিন্দী-হিলোলা। (পদ-৫২)

২. নন্দ-নন্দন চন্দ-চন্দন

গন্ধ নিন্দিত অঙ্গ। (পদ-১৩)

নাটকীয়তা গোবিন্দদাসের পদ রচনায় আরেকটি বিশেষ গুণ বা অপর বৈষ্ণব কবিদের রচনায় দুর্লভ। অভিসার পদগুলোতে গোবিন্দদাস নাটকীয়তা আমদানি করেছেন। এই নাট্যরস চিত্র সৌন্দর্যের সহায়ক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ। অভিসারের সাধনা বাস্তবের সাধনা। তার যে কষ্ট তা মানস-সৃজিত নয়। তা অনেকাংশে লৌকিক কষ্ট। সুতরাং সে কষ্টকে যখন কাব্যরূপ দান করতে হয়, তখন নাটকীয় না করে উপায় নেই। একটি উদাহরণ:

কৃষ্ণ সাধনার চিত্র-

‘কণ্টক গাড়ি কমল-সম পদতল

মঞ্জীর চিরহি ঝাঁপি।

গাগরি-বারি ঢারি করি পিছল

চলতহি অঙ্গুলি চাপি ৷৷ (পদ-১৫০)

গোবিন্দদাসের কাব্যে বা পদে লিরিক গুণ না থাকলেও ছিল সংগীতগুণ। এই সঙ্গীতগুণ তিনি লাভ করেছিলেন জয়দেবের নিকট হতে। এই সংগীতধর্মিতা তাঁর রচনার প্রধান গুণ। সারা বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ছাড়া অপর কোনো কবির কাব্যেই এমন সুর চেতনার সন্ধান পাওয়া যায় না। গোবিন্দদাসের কবিতার সংগীতরস স্থির চিত্রকে গতিময় করে তুলেছে এবং ভাসমান তরঙ্গোদ্বেলতা পাঠক চিত্তে আঘাত করে রসনিষ্পত্তিতে সাহায্য করেছে। উদাহরণ:

১. প্রেম-আকুল গোপ গোকুল

কুলজ-কামিনি-কন্ত।

কুসুম-রঞ্জন মঞ্জু-বঞ্জুল কুঞ্জ-মন্দিরে সন্ত॥ (পদ-১৩)

গোবিন্দদাস খাঁটি অর্থে লিরিক কবি নন এবং কাব্যবস্তু হতে আর্টিস্টের দূরত্ব বজায় রাখার ক্ষমতা তাঁর ছিল। কাব্যের মধ্যে তাঁর অবতারণ ঘটেনি। তিনি অন্যের বেদনাকে তার লীলা ও রসকে প্রকাশ করেছেন এবং তা শেষ পর্যন্ত অপরের রসে গিয়েছে। গোবিন্দদাস ভক্ত কবি হলেও কৃষ্ণলীলার সাথে নিজেকে মিশিয়ে ফেলা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি; রাধার বেদনার মধ্যে নিজ বেদনা ঢেলে দিতে পারেননি। তাঁর ভক্তি যত বেড়েছে- সাধনাস্ত রে উন্নীত হয়েছেন- ততই ঐ রূপমুগ্ধতা এবং কৃষ্ণেন্দ্রিয় প্রীতি ইচ্ছা প্রবল হয়ে তাঁর রূপসাধনাকে সম্পূর্ণতার দিকে এগিয়ে দিয়েছে। অর্থময় চিত্রাত্মক শব্দ সম্ভারের সাহায্যে তিনি রাধা ও কৃষ্ণ উভয়ের রূপাঙ্কন করেছেন। দৃষ্টান্ত:

১. নন্দ-নন্দন চন্দ-চন্দন

গন্ধ-নিন্দিত-অঙ্গ।

জলদ-সুন্দর কম্বু-কন্ধর

নিন্দি সিন্ধুর-ভঙ্গ ॥ (পদ-১৩)

এভাবে গোবিন্দদাস সচেতন শিল্পীর মতো আর্টিস্টের দূরত্ব বজায় রেখে রাধাকৃষ্ণের প্রেমচিত্র ও রূপ বৈচিত্র্য অঙ্কন করেছেন।

ছন্দের ধ্বনিস্পন্দ এবং যতি বিন্যাসে গোবিন্দদাস যে চমৎকারিত্ব দেখিয়েছেন সমগ্র বৈষ্ণব পদাবলীতে আর কোনো কবিই ততটা প্রতিভার পরিচয় দিতে পারেননি। ব্রজবুলি পদে তিনি মাত্রাবৃত্ত বা কলাবৃত্ত ছন্দ অনুসরণ, অনুকরণ করেছেন। আর বাংলা পদে অক্ষরবৃত্ত পয়ার-ত্রিপদী ব্যবহার করেছেন। যেমন-

পাদাকুলক: ৪|8 || 8|8

মন্দির | বাহির | কঠিন | কপাট।

চলইতে | শঙ্কিল | পঙ্কিল | বাটা ॥ (পদ-১৪৮)

পয়ার চর্চরী: ৩ঃ৪ | ৩ঃ৪ | ৩ঃ৪ | ৩

নন্দঃ নন্দন | চন্দঃ চন্দন || গন্ধঃ নিন্দিত | অঙ্গ

জলদঃ সুন্দর | কম্বুঃকন্ধর || নিন্দিঃসিন্ধুর | ভঙ্গ (পদ-১৩)

পরিশেষে বলা যায় যে, গোবিন্দদাস ছিলেন বিদগ্ধ ও সুপণ্ডিত কবি। পদ রচনায় তিনি বিদ্যাপতি ও জয়দেবকে অনুসরণ করেছেন। তাঁর পদে ভাবাবেগের উত্তাপের অভাব থাকলেও কাব্যের রূপসম্পূর্ণতায় তা পূর্ণ হয়েছে। অর্থাৎ গোবিন্দদাস রূপদক্ষ সচেতন শিল্পীর মতো যথাদৃষ্ট রূপকে ও ভাষার তুলিকায় রাধাকৃষ্ণের প্রেমকথা ব্যক্ত করেছেন।