প্রশ্নঃ জ্ঞানবিদ্যা কী? জ্ঞানের উৎপত্তিবিষয়ক মতবাদগুলাের মধ্য থেকে বুদ্ধিবাদ ও অভিজ্ঞতাবাদের তুলনামূলক আলােচনা কর।

অথবা, বুদ্ধিবাদ ও অভিজ্ঞতাবাদ কী? বুদ্ধিবাদ ও অভিজ্ঞতাবাদের মধ্যে পার্থক্যগুলাে দেখাও।

ভূমিকাঃ দর্শন একটি ব্যাপক বিষয়। আর আধুনিক দর্শন মূলত জ্ঞানবিদ্যার ওপর নির্ভরশীল। জ্ঞানবিদ্যার তিনটি মৌলিক প্রশ্ন রয়েছে। যথাঃ জ্ঞানের উৎস, স্বরূপ ও পরিণতি। এগুলাের মধ্যে জ্ঞানের উৎপত্তি-সম্পৰ্কীয় সমস্যাটি জ্ঞানবিদ্যার একটি প্রধান সমস্যা আর এ সমস্যার সমাধানে বিভিন্ন দার্শনিক যেসব মতামত পেশ করেন, সেগুলাের মধ্যে অন্যতম হলাে বুদ্ধিবাদ ও অভিজ্ঞতাবাদ। এগুলাে জ্ঞানবিদ্যার দু’টি শাখা।

শব্দগত অর্থে জ্ঞানবিদ্যাঃ ইংরেজি ‘Epistemology’ শব্দটি গ্রিক শব্দ ‘Episteme’ ও ‘Logos’ থেকে এসেছে। ‘Episteme’ শব্দের বাংলা অর্থ হলাে জ্ঞান। আর ‘Logos’ শব্দের বাংলা অর্থ বিজ্ঞান বা বিদ্যা। সুতরাং উৎপত্তিগত দিক থেকে ‘Epistemology’ শব্দটির অর্থ হলাে জ্ঞানতত্ত্ব বা জ্ঞানবিদ্যা।

বুদ্ধিবাদঃ যে জ্ঞানতাত্ত্বিক মতবাদ অনুসারে বুদ্ধিই হলাে যথার্থ জ্ঞানের একমাত্র উৎস এবং সার্বিক, যথার্থ ও শুদ্ধ সত্তার জ্ঞান একমাত্র বুদ্ধির সাহায্যেই পাওয়া যায় তাকে বুদ্ধিবাদ বলে। বুদ্ধিবাদীদের মতে, আশা সক্রিয়। বুদ্ধি হলাে আত্মার স্বাভাবিক গুণ। মন নিজের আত্মার ধারণা থেকে সক্রিয়ভাবে জ্ঞান উৎপন্ন করে। বুদ্ধি আবার বিচারশক্তির সাহায্যে নিশ্চিত বা যথার্থ জ্ঞানকে অনিশ্চিত ও অযথার্থ জ্ঞান থেকে আলাদা করতে পারে। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জ্ঞান অসম্পূর্ণ এবং ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে পরিবর্তন হয়। কিন্তু প্রকৃত জ্ঞান শাশ্বত, ইন্দ্রিয় আমাদের যথার্থ ও শ্বাশ্বত জ্ঞান দিতে পারে না।

অভিজ্ঞতাবাদের পরিচয়ঃ অভিজ্ঞতাবাদ জ্ঞানের উৎপত্তি সংক্রান্ত এমন একটি মতবাদ, যা অভিজ্ঞতা বা ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষণকে জ্ঞানের একমাত্র উৎস বলে মনে করে। অভিজ্ঞতাবাদীদের মতানুসারে, সংবেদন ও অনুভূতি থেকে জ্ঞানের উৎপত্তি হয়। সংবেদনের মাধ্যমে আমরা বহির্জগতের জ্ঞান পাই। অনুভূতি বা অন্তর্দর্শনের মাধ্যমে আমরা নিজেদের মানসিক অবস্থাকে জানি। অভিজ্ঞতাবাসিরা আরাে বলেন, আমরা পঞ্চেন্দ্রিয়ের মাধ্যমে বস্তুর যে জ্ঞান পাই, তা বাস্তবে আমাদের অভিজ্ঞাতার বাইরে বস্তুর কোনাে অস্তিত্ব নেই। তারা এ জগতের বাইরে অন্য কোনাে জগতের অস্তিত্ব স্বীকার করেন না। অভিজ্ঞতাবাদ সম্পর্কে দার্শনিক Potrc তার গ্রন্থে বলেন Introduction to phylosophy, Knowledge comes neither fronrı sense for frcim season. We may say that it comes from experience.

বুদ্ধিবাদ ও অভিজ্ঞতাবাদের তুলনামূলক আলােচনাঃ নিম্নে বুদ্ধিবাদ ও অভিজ্ঞতাবাদের তুলনামূলক আলােচনা / পার্থক্য উপস্থাপন করা হলাে-

(১) উৎপত্তিগত দিক থেকেঃ বুদ্ধিবাদীদের মতে, জ্ঞানের উৎপত্তি হয় বুদ্ধি থেকে, অর্থাৎ বুদ্ধিই জ্ঞানের একমাত্র উৎস। কিন্তু অভিজ্ঞাতাবাদীদের মতে, বুদ্ধি নয় বরং ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতাই জ্ঞানের একমাত্র উৎস বা উৎপত্তিস্থল।

(২) স্বীকারগত দিক থেকেঃ বুদ্ধিবাদীরা সহজাত ধারণা স্বীকার করেন। তাদের মতে, আমাদের মনে সহজাত ধারণা নামক এক প্রকার বিশেষ ধারণা আছে, যা জন্মলগ্নেই ঈশ্বর আমাদের মনে গেঁথেছেন। কিন্তু অভিজ্ঞতাবাদী বা এরূপ কোনাে ধারণা স্বীকার করে না। তাদের মতে, সব ধারণাই আসে অভিজ্ঞতার পথ ধরে।

(৩) নিশ্চয়তার দিক থেকেঃ বুদ্ধিবাদীরা বলেন, জ্ঞানের মধ্যে আবশ্যিকতা, সর্বজনীনতা ও নিশ্চয়তা থাকবে। কিন্তু অভিজ্ঞতাবাদীদের মতে, জ্ঞান লাভই হলাে সম্ভাব্য।

(৪) নতুনত্বের দিক থেকেঃ বুদ্ধিবাদ জ্ঞানের নিশ্চয়তা ও আবশ্যকতা দেয়। কিন্তু নতুনত্ব দেয়া না। অপরদিকে, অভিজ্ঞতাবাদ জ্ঞানের নতুনত্ব দেয়, কিন্তু নিশ্চয়তা ও আবশ্যকতা দেয় না।

(৫) উপাদানের দিক থেকেঃ বুদ্ধিবাদ জ্ঞানের আকার দেয় কিন্তু উপাদান দিতে পারে না। পক্ষান্তরে, অভিজ্ঞতাবাদ জ্ঞানের উপাদান দেয় কিন্তু আকার দিতে পারে না।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, জ্ঞানের উৎপত্তি সম্পর্কীয় মতবাদ হিসাবে বুদ্ধিবাদ ও অভিজ্ঞতাবাদের মধ্যে আরাে বিষয়ে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। বুদ্ধিবাদ মনে করে, বুদ্ধিই জ্ঞানলাভের একমাত্র উপায়। আর অভিজ্ঞতাবাদীদের মতে বুদ্ধি নয় অভিজ্ঞতাই জ্ঞানলাভের একমাত্র উপয়। বুদ্ধিবাদের জ্ঞানের আকার আর অভিজ্ঞতাবাদের জ্ঞানের উপাদান। এই আকার ও উপাদানের সমন্বয় ব্যতীত জ্ঞান সম্ভব হয় না। সুতরাং বুদ্ধিবাদ ও অভিজ্ঞতাবাদ উভয় মতবাদের মধ্যে কিছু পার্থক্য থাকলেও জ্ঞানােৎপত্তির ক্ষেত্রে এদের ভূমিকা অনস্বীকার্য।