আধুনিক যুগের কবিদের মধ্যে কবি বুদ্ধদেব বসুকে সচেতন শিল্পীদের তালিকায় প্রথমেই স্থান দিতে হয়। তিনি মনের আবেগে যেমন কবিতা রচনা করেছেন, তেমনি তাঁর কবিতাকে সাজিয়েছেন যত্নসহকারে। ভাব ও আবেগের মধ্যে যেমন থাকবে পারস্পর্য্য সংযম, তেমনি কবিতার প্রকাশে থাকবে শৃঙ্খলার লাবণ্য। হিউমের কথায়, “…Images in verse are not mere decoration, but the very essence of an instituitive language.” বিষয়টিকে একটু অন্য ভাষায় প্রকাশ করে হ্যারিয়েট মনরোকে এজরা পাউণ্ড চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন, “Poetry must be as well as written prose. Its language must be a fine language, departing in no way from speech save by a highterned intensity (i.e.) simplicity”। কবি বুদ্ধদেব বসুর কবিতার আঙ্গিক প্রকরণের বিচারে এই মন্তব্যগুলি বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য।
বুদ্ধদেব বসু তাঁর আত্মজীবনীতে ভাষা ব্যবহারের স্বাচ্ছন্দ্য সম্পর্কে লিখেছেন, “আমার আদর্শ ছিলো পাউণ্ডের (এজরা পাউণ্ড) ইমেজিস্ট ম্যানিফেস্টো। আধুনিক যুগে পদ্য কিভাবে লিখতে হবে তার কয়েকটা নিয়ম বেঁধে দিতেও আমি দ্বিধা করিনি, ‘সনে’, ‘ছিনু’, ‘মম’, ‘তব’ প্রভৃতি কাব্যিক শব্দকে ছেঁটে ফেলতে হবে। আকাশকে ‘গগন’ বা সূর্যকে ‘তপন’ বলা কখনই চলবে না, সাধু ভাষায় ক্রিয়াপদগুলিকে উপড়ে ফেলা চাই, একমাত্রার মিল সসম্মানে স্বীকার্য।” অন্যত্র তিনি তাঁর কবিতার ভাষা সম্পর্কে লিখেছেন, “আমাকে বলতে হবে ঘোষণার বদলে ছবির সাহায্যে, যা বলতে চাচ্ছি তার বদলে অন্য কিছু বলতে হবে হয়তো, আসল কথাটা লুকানো থাকবে অথচ থাকবে না। আর এর জন্য চাই এমন ভাষা যা নির্ভার অথচ অগভীর নয়, যা গম্ভীর সংস্কৃতের পাশে ছিপছিপে কথা, বুলিকে মানিয়ে নিতে পারে, ভালো মানুষের মত চেহারা নিয়েও যা ভিতরে ভিতরে কুটিল।” [কবিতার কথা]
বুদ্ধদেব বসুর কবিতায় দেখি তারই প্রতিশ্রুত ভাষারীতির আয়োজন—তাঁরই নিজস্ব বাক্-প্রতিমা। বুদ্ধদেব চেয়েছেন কবিতায় গদ্য ও পদ্যের বিভেদ ঘুচিয়ে দেবার জন্য। এই উদ্দেশ্যে তিনি তাঁর কবিতায় আনতে চেয়েছেন প্রাত্যহিক বাকুরীতির সংলগ্নতা—কিন্তু কোনক্রমেই তার সংগীতধর্মিতা ক্ষুণ্ণ না করে। এজন্য তিনি তাঁর কবিতার ছন্দোরীতিতে পথপ্রদর্শক করে নিয়েছেন রবীন্দ্রনাথের মিলহীন ‘বলাকা’র ছন্দ মুক্তক ছন্দ। ভাবের গতি হবে অবাধ, ভাষার কাঠামো হবে বন্ধনহীন। তারপর কবিও অভীষ্ট যাত্রাপথে রবীন্দ্রনাথের ‘পুনশ্চ’-এর গদ্যছন্দ তাঁকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল। কবি তাঁর শেষদিকের কাব্য ও কবিতার Free verse-এর ছন্দ-কাঠামোকে সাবলীল ও স্বচ্ছন্দভাবে প্রয়োগ করতে চেয়েছেন। তিনি মনে করেছেন, আধুনিক কবিতার অভিষ্ট বাক্রীতি বা বাকছন্দের স্পন্দন আনা যায়। কথ্যরীতি ও কাব্যরীতির মিশ্রণের মধ্য দিয়েই তিনি তাঁর কাব্যছন্দকে মুক্তি দিয়েছেন। এতে কেবল ছন্দোমুক্তি ঘটেনি—আলংকারিক সৌন্দর্য ও শিল্প-প্রকরণের নৈপুণ্য চাতুর্য ব্যতিরেকেই নিষ্পন্ন হয়েছে। কবির প্রথমদিকের কাব্যগুলিতে শব্দপ্রয়োগে ইন্দ্রিয়ানুভূতির তীব্রতা বেশী মাত্রায় দেখা গিয়েছিল; কিন্তু শেষের দিকের কাব্যে তা তীব্রতা অপেক্ষা গভীরতার দিকটিকে প্রসারিত করেছে। শীতের প্রার্থনা ও বসন্তের উত্তর’ কাব্য পর্যন্ত কবি শব্দের জোয়ারে নিজে ভেসেছেন মাঝে মাঝে জোয়ারের ফেনিল আবর্ত সৃষ্টি করেছেন—আর পাঠককে ভাসিয়েছেন তার সঙ্গীত মাধুরীর স্পন্দনে। ‘যে আঁধার আলোর অধিক’ কাব্য থেকে বুদ্ধদেবের ভাষা নমনীয়তা-কমনীয়তা গুণে পরিণত ও পূর্ণায়ত হয়ে উঠেছে। একেবারে শেষদিকের কাব্যগুলি হয়ে উঠেছে ইঙ্গিতময় ও সঙ্কেতময়— এজরা পাউণ্ডের ভাষায় যাকে বলা যায়, “In the sequence of musical phrase, not in the sequence of metronome.”
বুদ্ধদেব বসু তার ‘কবিতার কথা’ গ্রন্থে আধুনিক বাংলা কবিতার শিল্পপ্রকরণ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। নিজের কবিতার শিল্প সম্পর্কেও তিনি আলোচনা করেছেন—অন্য কবিদের প্রসঙ্গে নিজেকে তুলনা করে অনেক স্পষ্ট করে তুলেছেন। কবি বুদ্ধদেবের কবিতার প্রকরণ বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে তাঁর সমসাময়িক কবিদের সঙ্গে তার তুলনার কথা মনে আসে। জীবনানন্দ কবিতা রচনায় ভাষাকে সাজিয়েছেন চিত্রের উপযোগী করে, সুধীন্দ্রনাথ ও বিষ্ণু দে বুদ্ধিদীপ্ত করে ভাষাকে সাজিয়েছেন মননের গভীরতা আনার জন্য; আর বুদ্ধদেব বসু ভাষাকে সাজিয়েছেন ভাবের প্রবাহে সুরময়তা ও গতিছন্দময়তা আনার জন্য। বুদ্ধদেবের কবিতায় তাই একটা অস্পষ্ট সঙ্গীতধ্বনি শোনা যায়; সেই সঙ্গে আছে নাটকীয়তার আবেগ ও প্রাণোচ্ছলতা কোন কোন সমালোচক মনে করেছেন যে বুদ্ধদের তাঁর কবিতার শিল্প-প্রকরণে প্রি-র্যাফেলাইট কবিদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। তাঁর “বন্দীর বন্দনা”র পেছনে যেমন ছিল হাক্সলি ও লরেন্সের প্রভাব, ‘পৃথিবীর পথে’র পেছনে নরওয়েজীর সাহিত্য, তেমনি ‘কঙ্কাবতী’র পশ্চাতে ছিল রসেটি, মরিস ও সুইনবার্নের স্বপ্ন ও সুর।” এছাড়া তিনি অনুবাদ কর্মের মধ্য দিয়ে বোদলেয়ার, রিলকে, হোল্ডারলেন প্রভৃতির কবিতাসামগ্রীকে বাঙালী কাব্যরসিকের নিকট পরিচিত করেছেন; সেই সঙ্গে তাদের ভাষারীতি ও শিল্প-প্রকরণকেও।
তথাপি বলতে হয়, বুদ্ধদেব তাঁর নিজের সৃষ্টিশক্তির প্রেরণায় সকলের প্রভাবকে আত্মস্থ করে নিয়ে নিজের শিল্প-প্রকরণ গড়ে তুলেছেন। বুদ্ধদেবের কবিতা তাঁর নিজেরই কবিতা— তাঁর কবিতার ভাষা তাঁর নিজেরই আবিষ্কার। কবি স্বয়ং তার কবিতায় আত্ম-আবিষ্কারের প্রসঙ্গে বলেছেন, “নিজের মনের গভীরে নামতে হয় কবিকে। পৌঁছতে হয় মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে সেই গহনে, যেখানে পাথর কাদা আবর্জনার স্তূপের ফাঁকে ফাঁকে স্তরে স্তরে সঞ্চিত হয়ে আছে হাতের স্পর্শে, হাতুড়ির আঘাতে “রূপান্তরিত হবার প্রতীক্ষা নিয়ে।” কবিতার ভাষা প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘জীবন মায়ায় এক হয়ে যায় ভালোবাসা আর ভাষা’। এই ভাষার সাধনায় বুদ্ধদেব আজীবন পরিশ্রম করেছেন। কখনো রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে, কখনো সত্যেন্দ্রনাথ-মোহিতলালকে ঘিরে তাঁর ভাষা সাধনার যজ্ঞবেদী রচিত হয়েছে; আবার কখনো পাশ্চাত্ত্য কবিদের শব্দভাবনায় তন্ময় হয়ে বাক্-প্রতিমা গড়ে তুলেছেন।
বুদ্ধদেব বসুর কবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্য তার লিরিক প্রবণতা। আধুনিক কবিতার মধ্যে যে গতিপ্রাণতা সেখানে গীতির সুর বা হিপ্লোলটাই বড়ো কথা নয়; সেখানে বিষয়ের আত্মতা প্রধান হয়ে উঠেছে। জীবন ও জগৎকে আপন সৃষ্টির জগতে মনের দ্যুতিতে উদ্ভাসিত করে তাকে নতুন সৃষ্টির আলোকে উজ্জ্বল করে তুলেছেন আধুনিক কবিগণ। ফলে আধুনিক কবিদের হাতে এদেশে কিংবা বিদেশে—’লিরিক’ কথাটির অর্থ তাৎপর্যের যে কিছুটা পরিবর্তন ঘটেছে। এতে কোন সন্দেহ নেই। বুদ্ধদেব বসুর হাতে তাই আধুনিক কবিতা নতুন গীতিকবিতার তাৎপর্যে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে। সমাজের পরিবর্তিত মূল্যবোধের চেতনার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়ে নতুন লিরিক প্রবণতার জন্ম দিলেন। তাঁরা কেবল সুন্দরের অনুধ্যানে নিমগ্ন হতে চাননি—সুন্দরের সঙ্গে কুৎসিতকে, আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে লাভ-লোভকে স্বাধীনতার সঙ্গে ব্যভিচারকে মিলিয়ে দিলেন। বুদ্ধদেবের কবিতায় তার সার্থক প্রকাশ ঘটেছে।
‘বাসনার বক্ষোমাঝে কেঁদে মরে ক্ষুধিত যৌবন,
দুর্দম বেদনা তার স্ফুটনের আগ্রহে অধীর।
রক্তের আরক্তলাজে লক্ষবর্ষ-উপবাসী শৃঙ্গার কামনা
রমণী-রমণ-রণে পরাজয়-ভিক্ষা মাগে নিতি।’
এ কেবল ভোগ-শৃঙ্গারের কবিতা নয়—কবির হৃদয়ের আকৃতির সুর-মূর্ছনা। বুদ্ধদেবের সর্বাধিক নৈপুণ্য চিত্রকল্প সৃষ্টিতে। কবিতার কায়ার সঙ্গে ছবি যেন মিশে আছে। কখনো কবি ছবি আঁকেন, কখনো বা ফটোগ্রাফে ছবি তুলে তাকে বাঁধিয়ে রাখেন।
বুদ্ধদেবের কবিতার অপর এক বৈশিষ্ট্য নাটকীয়তার চরমক্ষণ সৃষ্টি। তাঁর অধিকাংশ কবিতায় ভাবের আবেগ পরম্পরাক্রমে ঊর্ধ্বগ্রামে উঠতে উঠতে সেই নাটকীয় মুহূর্তটি সৃষ্টি করে। বস্তুর মূর্তি শিল্পীর হৃদয়ে। এমনভাবে গাঁথা হয়ে যায়, যাতে ভাবের ছবি ভাস্কর্যের শিল্পরূপ পায়; অথচ সংগীতের হিল্লোলধ্বনি অবারিত গতিতে প্রবাহিত হতে থাকে। সেই সকল ক্ষেত্রে লরেন্স কিংবা হিলোরি বেলকের কথা স্মরণে আসে।
ক্রোচে তাঁর Essence of Aesthetic গ্রন্থে রোমান্টিসিজমের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে লিখেছেন, “Romanticism asks of art, above all, the spontaneous and violent effusion of the affections of love, and hate, of anguish and joy, of despair and elation; and is willingly satisfied and pleased with vaporous and indeterminate images, broken and allusive in style, with vague suggestions, with approximate phrases, with powerful and confused sketches.” বুদ্ধদেবের কবিতায় এই sketch-গুলি স্বপ্রতিষ্ঠ হয়ে রোমান্টিক আবহ সৃষ্টি করেছে। তাঁর কবিতায় যেন তাঁরই কথা শুনি—
‘মোর আপনারে আমি নবজন্ম করিয়াছি দান।’
Leave a comment