‘বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ’ প্রহসনের ভিত্তিতে সমাজ বাস্তবতা আছে কিনা সে প্রসঙ্গে মতভেদ আছে। কিন্তু সমকালীন সমাজ ইতিহাসে এর বাস্তবতা অভ্রান্ত বলে প্রমাণিত হয়েছে। যোগীন্দ্রনাথ বসু লিখেছেন- “কেবল ইংরাজী শিক্ষিত, নব্য সম্প্রদায়েরই অনাচারে হিন্দু সমাজ-ক্ষতিগ্রস্ত হয় নাই, চরিত্রহীন বকধর্মী প্রাচীন সম্প্রদায়ের কুব্যবহারে তদপেক্ষা শতগুণ অধিক ক্ষতিগ্রস্ত হইয়াছে। মধুসূদনের সময় এই শ্রেণীর কতকগুলি লোকের কলিকাতায় ও তাহার নিকটবর্তী পল্লীসমাজে বিশেষ প্রতিপত্তি ছিল। বাহিরে মালা যপ কিন্তু গোপনে পরস্বাপহরণ, সামাজিক প্রতিপত্তির জন্য দেব মন্দির প্রতিষ্ঠা কিন্তু গোপনে বারাঙ্গনা প্রতিপালন তাহাদিগের অনেকের নিত্য ব্রত ছিল। বাইরে হিন্দু ধর্মানুমোদিত ক্রিয়াকর্মের অনুষ্ঠান করিলেও ইহাদিগের চরিত্র ও ব্যবহার হিন্দু শাস্ত্র সমূহকে উপহাস মাত্র করিত। ইয়ং বেঙ্গলদিগের উপর ইহাদিগের মর্মান্তিক বিদ্বেষ ছিল; কিন্তু ইয়ং বেঙ্গলগণ যে সকল পাপ কল্পনা করিতেও পারিতেন না, ইহারা তাহাতে লিপ্ত থাকিতে সংকুচিত হইতেন না। মধুসূদনের দ্বিতীয় প্রহসন ‘বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ’ এই শ্রেণীর লোকদিগকে লক্ষ্য করিয়া লিখিতে হইয়াছিল।”
‘বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ’ গ্রহসনে সমকালীন বাংলায় গ্রামজীবনের একটি ব্যঙ্গাত্মক চিত্র আঁকা হয়েছে। পল্লীসমাজের গভীর ক্ষতের উপরে নাট্যকার আলোকপাত করতে সচেষ্ট হয়েছেন।
জমিদারী প্রথার নিষ্ঠুর স্বার্থপরতা এবং প্রজাশোষণের একটি সাধারণ পটভূমিতে এই প্রহসনের কাহিনীটি সৃষ্ট। ভক্তপ্রসাদ গ্রামের জমিদার। চরম নিষ্ঠুরতা করে সে প্রজাদের নিকট থেকে প্রাপ্ত খাজনা আদায় করে। গরীব চাষীরা যখন অনাবৃষ্টির আক্রমণে পর্যুদস্ত তখনও খাজনার পাই পয়সাটি গুনে নিতে ভক্তপ্রসাদের দ্বিধা হয় না। [‘ভক্ত। তোদের ফসল হৌক আর না হৌক তাতে আমার কি বয়ে গেল।] জমাদারের লাঠি তার স্বার্থরক্ষার জন্য নিয়োজিত। হানিফের মত গরীব চাষী শুধু নির্যাতিত হয় না, দেবোত্তর সম্পত্তিতে পর্যন্ত তার লোভের হাত প্রসারিত। “যে কিঞ্চিত ব্রহ্মত্র ভূমি ছিল তাতো আপনার বাগানের মধ্যে পড়াতে বাজেয়াপ্ত হয়ে গিয়েছে।”
জমিদারের অর্থনৈতিক শোষণই বহু অঞ্চলে প্রজা সাধারণের একমাত্র বিপদের যেমন কারণ হত তেমনই অর্থ, প্রভুত্ব ও ক্ষমতার বলে তার লাম্পট্য গ্রামবাসীদের সর্বদা সন্ত্রস্ত করে। জমিদার ভক্তপ্রসাদের লাম্পট্যকে কেন্দ্র করেই এই প্রহসনের কাহিনী রচিত। হানিফের স্ত্রী ফতেমাকে ভোগ করবার চেষ্টা নিয়েই এই গল্প। কিন্তু এটি একমাত্র ঘটনা নয়। ভক্তপ্রসাদের ভোগের উচ্ছিষ্ট হয়ে বহু কুলবালাকে বারাঙ্গনার জীবন বহন করতে হয়েছে। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে বিবাহিতা ও কুমারীর প্রতি, তার কন্যা ও দৌহিত্রীর বয়সী মেয়েদের দিকে তার লালসা-পঙ্কিল কলুষিত হাত সর্বদা প্রসারিত ছিল।
উনিশ শতকে কলকাতাকে কেন্দ্র করে নব্য-ইংরাজী শিক্ষায় কেউ কেউ যখন বাঙালীর জীবনতটে আঘাত করতে লাগলো তখন এই জাতীয় অর্থপিশাচ, লম্পট, ধনী ও ক্ষমতাবান জমিদার শ্রেণির একটি নূতন রূপ আত্মপ্রকাশ করল। ইউরোপীয় শিক্ষা ও চিন্তার সঙ্গে সঙ্গে জীবনের সর্বক্ষেত্রে যে পরিবর্তনের বাতাস প্রবাহিত হল তাকে বিদেশী ম্লেচ্ছাচারের অনুকরণ বলে এরা আর্তনাদ করে উঠলেন। সনাতন ধর্ম রক্ষার ধ্বজাধারী রূপে তাঁরাই নিজেদের জাহির করে বেড়াতে লাগলেন। এই উচ্চবিত্ত শ্রেণী নবীনের বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিরোধ তৈরি করলেন। সর্ববিধ রক্ষণশীলতা মধ্যযুগীয় অন্ধবিশ্বাস এবং যুক্তিবিরোধী কদর্যতা জাতীয় ঐতিহ্যের নামে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা হতে লাগলো। সনাতন হিন্দুধর্মের এই রক্ষকেরা ব্যক্তিগত জীবনের চরম উচ্ছৃঙ্খলতা, পাপাচার ও কামুকতার পরিচয় দিতে দ্বিধা করল না। ভক্তপ্রসাদের চরিত্রকে অবলম্বন করে সমাজব্যাধির এই কেন্দ্রেই আঘাত করতে চাইলেন মধুসূদন।
‘বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ’ প্রহসনে সামাজিক সাধারণ চিত্রের প্রত্যক্ষতা শিল্পরূপ প্রকাশিত হওয়ার কারণ প্রথমত, মুখ্য চরিত্রের ব্যক্তিলক্ষণ বেশ তীব্রভাবে আত্মপ্রকাশ করেছে, এবং দ্বিতীয়ত, বিভিন্ন সমাজ চিত্রের স্থানে এই পূর্ণাঙ্গ গল্প গঠিত হয়েছে।
“‘বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ’ সমাজ সমস্যার ভিত্তিতে জন্ম নিয়েছে, কিন্তু সামাজিক ব্যঙ্গ হয়ে উঠলেও এর সাহিত্যিক উৎকর্ষে বাধা কোথাও নেই। সমাজ সমস্যাকে আত্মসাৎ করে গল্প গঠিত হয়েছে, চরিত্র সৃষ্ট হয়েছে। চরিত্রহীন এক বৃদ্ধ জমিদারের একদিনের লাম্পট্যের কাহিনীতে ব্যাপক সমাজ সত্যের ছায়া পড়েছে।”
Leave a comment