ওভিদের ‘The Heroides এর অনুসরণে মাইকেল মধুসূদন বীরাঙ্গনা কাব্য রচনা করেছিলেন বলে ওভিদের কিছু দোষ বীরাঙ্গনা কাব্যে বর্তে ছিল’- সমালোচকের এই মতের ব্যাখ্যা করো।
“বীরাঙ্গনা কাব্যের বিশেষত তারা পত্রিকা সমাজ সংস্কারের পরিপন্থী”- সমালোচকের এই মতের পক্ষে বিপক্ষে আলোচনা করো।
মাইকেল মধুসূদন দত্ত বাংলা কাব্যে যুগাত্তর সৃষ্টি করেছিলেন অমিত্রাক্ষর ছন্দ প্রচলন করে। ছন্দ প্রবর্তন করে সেই ছন্দে বীররসের সঙ্গে করুণ ও শৃঙ্গাররসের কবিতাও যে রচনা করা যায় তার প্রমাণ দিয়েছেন ‘বীরাঙ্গনা কাব্য’ রচনা করে। বীরাঙ্গনা কাব্যে একাধারে কোমলতা ও কাঠিন্যের সম্মেলন লক্ষ করা যায়।
যুগন্ধর কবি মধুসূদন এই কাব্যের মধ্যে দিয়ে কাব্যে সাহিত্যে নবত্ব এনে দিয়েছিলেন। পত্রাকারেও যে কাব্য রচনা করা যায় তা বীরাঙ্গনা কাব্য থেকেই বোঝা যায়। আবার সাহিত্যে মানবতাবাদ, বিশেষ করে সমাজে কোন নারীরাও যে একটি স্বতন্ত্র সত্তা আছে তারা যে কেবল পুরুষের ভোগ্যপণ্য বা সন্তান উৎপাদনযন্ত্র নয়, তারাও মানুষ এই ভাবনার দ্যোতনায় ‘বীরাঙ্গনা কাব্য’ দ্যোতিত। সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এই গ্রন্থ সম্বন্ধে বলেছেন— “মেঘনাদবধের পর বীরাঙ্গনা কাব্যের স্বচ্ছন্দপ্রবাহ আমাদিগকে মুগ্ধ করে। ইহার সর্বত্রই একটি সঙ্গীতধ্বনি ঝঙ্কৃত হইয়া কাব্যখানিকে পরম উপাদেয় করিয়া তুলিয়াছে। কবিত্ব শক্তির দিক দিয়া বিচার করিলে মধুসূদনের ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ উৎকৃষ্ট; কিন্তু ভাষার লালিত্যে ও ছন্দের পারিপাট্যে মধুকবির বীরাঙ্গনা সর্বশ্রেষ্ঠ রচনা”।
মধুসুদনের অকুণ্ঠ স্বীকৃতি সাপেক্ষে জানতে পারা যায় যে তিনি রোমক কবি ওভিদের ‘The Heroides’-এর আদর্শে প্রাণিত হয়ে বীরাঙ্গনা কাব্য রচনা শুরু করেছিলেন। তাঁর ইচ্ছে ছিল ওভিদের বীরগাথার মতোই একুশটি পত্রিকা যোগে বীরাঙ্গনা কাব্যের প্রকাশ করা। কিন্তু সময়াভাবে মাত্র এগারোটি পত্র যোগে বীরাঙ্গনা কাব্য প্রকাশ করতে বাধ্য হয়েছিলেন।
রোমক কবি ওভিদের ‘The Heroides’ বা বীরগাথা যেমন পত্রাকারে লিখিত। পৌরাণিক নায়িকারা তাদের নায়ক বা প্রেমাস্পদের কাছে তাদের মনের অভিলাষ ব্যক্ত করে পত্র লিখে পাঠিয়েছেন, মধুসূদনের বীরাঙ্গনা কাব্যও তেমনি পৌরাণিক নায়িকা কর্তৃক তাঁদের প্রিয় বা পতির উদ্দেশ্যে লিখিত পত্র। কেউ প্রকাশ করেছে অন্তরের অবরুদ্ধ প্রেম, কেউ উৎকণ্ঠা, আশংকা, কেউ পাঠিয়েছেন প্রত্যাখ্যান বার্তা, কেউবা জানিয়েছেন ক্ষুব্ধ হৃদয়ের অনুযোগ। সব মিলিয়ে বিষয় বৈচিত্র্যে প্রতিটি পত্রই স্বতন্ত্র।
বীরাঙ্গনা কাব্যের নায়িকা নির্বাচন করতেও দেখা যায় কবি মধুসূদন ওভিদের আদর্শকে অনুসরণ করেছেন। ফলে উভয় কাব্যের (The Heriodes এবং বীরাঙ্গনা কাব্য) নায়িকাগণই পৌরাণিক নারী চরিত্র। পুরাণ, মহাকাব্য ও প্রাচীন কাব্য থেকে চয়িত নারীগণ সকলেই সমগুণ বিভূষিত নয়। কেউ কেউ যেমন পতি পরায়ণা সাধ্বী, কেউ তেমনি কলঙ্কিনী নায়িকা—কলঙ্কিনী প্রেমিকা। কোন কোন পত্রে প্রকাশিত হয়েছে অভিমানী সতীর হৃদয়োচ্ছ্বাস, পুত্রহীনার শোকপূর্ণ ক্ষুব্ধ অনুযোগ, ক্ষত্রিয় রমণীর ধর্মরক্ষার আর্জি। উভয় কাব্যেই প্রেমিকা হৃদয়ের রহস্য পরিজ্ঞানে অসামান্য নৈপুণ্য, উদ্দাম কল্পনার যেমন প্রকাশ পেয়েছে, তেমনি কোথাও কোথাও সমাজনীতি, সামাজিক অনুশাসনের প্রতি অবজ্ঞাও করা হয়েছে। সমাজ বিগর্হিত প্রেমের উচ্ছ্বাস কোথাও কোথাও সমাজে সমালোচনার কারণ হয়েছে। সমালোচকদের ধারণা ওভিদের হিরোইদেস-এর আদর্শে রচিত হবার জন্যেই সম্ভবত বীরাঙ্গনা কাব্যের ওপর ওভিদের কাব্যের দোষগুণাদি সক্রামিত হয়েছে।
যদিও শিল্পতত্ত্বের বিচারে সমাজকে অবজ্ঞা করে যে প্রেমের আদর্শ বীরাঙ্গনা তারার পত্রিকায় লক্ষ্য করা যায়। তাতে অবৈধ প্রেমের কারণে মধুসূদন নিন্দিত হলেও, শিল্প সৃষ্টির বিচারে বাংলা সাহিত্যে এটি একটি স্মরণ সুন্দর সৃষ্টি রূপে অভিনন্দিত।
সমালোচকদের দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে দেখা যায় ওভিদকে আদর্শ করার ফলে মধুসূদন এক নিন্দনীয় ভ্রমে পতিত হয়েছেন। ‘The Heroides’-এর অনেকগুলি পত্রিকা যেমন অত্যন্ত কলুষিত প্রেমের চিত্র অবলম্বনে কল্পিত কবি মধুসূদনের বীরাঙ্গনা কাব্যও সেই রকম সমাজ আদর্শ বিরোধী কলুষিত প্রেম কল্পনায় কোথাও কোথাও দুষ্ট হয়েছে। ওভিদ একদিকে যেমন সাধ্বীকুল-গৌরব পেনিলোপের (Penelope) এবং পতিপ্রাণা লাওডামিয়ার (Laodamia) পবিত্র প্রেম বর্ণনা করেছেন তেমনি আবার সহোদর ভ্রাতার প্রতি অনুরাগিণী কেনেচের (Canace) এবং সপত্নী পুত্রের প্রেমে মুগ্ধা ফিড্রার (Phaedra) সম্পর্ক বিরুদ্ধ প্রেমাসক্তি বর্ণনা করেছেন। কবি মধুসূদন এই অপবিত্র আদর্শে সঞ্জাত হয়ে বীরাঙ্গনা কাব্যের ঊর্বশী, শূর্পণখা ও তারার প্রেম পত্রিকা রচনায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। যদিও এই তিন নায়িকার স্বভাব চরিত্র যার যে রূপ তিনি কল্পনা করেছিলেন, তারই যথোপযুক্ত উপাদান দিয়ে নৈপুণ্যের সঙ্গে তা চিত্রিত করতে সমর্থ হয়েছিলেন। সে দিক থেকে তাঁর কবিত্ব শক্তি প্রশংসা দাবী করতে পারে। তবু এখানে রুচির একটা প্রশ্ন থেকেই যায়। এই রুচির প্রশ্নে মধুসূদন সমসাময়িক সমালোচকদের মধ্যে কেউ কেউ একে কবি মধুসূদনের কদর্য রুচির পরিচায়ক রূপে মন্তব্য করেছেন। প্রকৃত পক্ষে এই তিন নায়িকার মধ্যে উর্বশী হলেন স্বর্গের বীরাঙ্গনা, শূর্পণখা অনার্য বাল্য বিধবা ও রাক্ষসরাজের ভগ্নী। ফলে তাদের প্রেম কামনা স্বাভাবিক ও সামাজিক না হতেও পারে কিন্তু দেবগুরু বৃহস্পতির পত্নী তারার সমাজ-বহির্ভূত প্রেমাসক্তির প্রতি কোন রূপ সমর্থন থাকতে পারে না। কারণ প্রথমত তারা ঋষি-পত্নী। তার কাছে স্ত্রীর সাধ্বী আচরণই প্রার্থিত বা কাঙ্ক্ষিত এবং দ্বিতীয়ত তিনি কামনা করেছেন তাঁর স্বামীর শিষ্য পুত্রতুল্য সোমকে। সোম বা চন্দ্রের পক্ষে গুরুপত্নী গমন। যেমন নিন্দনীয় কাজ, গুরুপত্নীর পক্ষেও স্বামীর শিষ্যকে কামনা করা তেমনি অসামাজিক। পৌরাণিক উপাখ্যানে যদিও দেখা যায়, চন্দ্র তাঁর গুরুপত্নী তারার প্রতি গমন করলে তারা, চন্দ্রকে প্রেম নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেন এবং অবেশেষে কৃত অপকর্মের জন্য চন্দ্রকে অভিশাপ দেন। কিন্তু মধুসুদনের তারা স্বেচ্ছায় চন্দ্রের প্রেমাকাঙ্ক্ষিণী। ওভিদের কাব্যে সপত্নী পুত্রের প্রেমাসক্ত ফিড্রা যেমন বলেছিলেন—
“No blame will you receive, but praise instead
Safe at my side and even in my bed
Only make haste and straight our union seal
Ere you, like me, be broken on love’s wheel.”
মধুসুদনের তারা তেমনি বলেছেন, “কর আসি কলঙ্কিনী কিঙ্করী তারাতে তারা নাথ”।
পৌরাণিক তারা ছিলেন সম্পূর্ণ নিরপরাধা। তিনি সতী সাধ্বী ঋষি-পত্নী। মধুসূদন সেই তারাকে ‘পরপুরুষ’ আসক্তা অবৈধ প্রেমী রূপে অঙ্কিত করে যে শিল্প সৃষ্টি করেছেন সামাজিক বিচার বোধে তা নিন্দনীয়, দোষণীয়, রুচি বহির্ভূত হলেও শৈল্পিক দৃষ্টিতে তা প্রশংসনীয়। বস্তুত সমাজ রুচি ও সংস্কার দিয়ে কোন শিল্পকে পরিমাপ কিম্বা মূল্যায়ন করা সমীচীন নয়। সমাজজীবনে যা ঘটে থাকে তাকেই শিল্পে রূপ দেওয়ার চেষ্টায় তারা চরিত্র গড়ে উঠেছে। প্রকৃতপক্ষে অবদমিত নারী মনের যে অদম্য আবেগ, মধুসূদন তাকে শিল্পে রূপ দান করে বাংলা সাহিত্যে যেমন নতুনত্ব এনে দিয়েছেন তেমনি, নারীকে যোগ্য মর্যাদা দিয়ে সাহিত্যে মানবতাবাদের সূচনা করে দিয়েছেন। তারই প্রবহমানতায় পরবর্তী সাহিত্যসাধকের হাতে নারী আপন অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছে, আপন অধিকার, মর্যাদা লাভ করার ইচ্ছা নারীর মনে তরঙ্গিত হয়েছে। প্রকৃত প্রস্তাবে মধুসূদনের বীরাঙ্গনা কাব্যে সামাজিক দোষ কিছু থাকলেও, কাব্য বিচারের ক্ষেত্রে তা শিল্প সৃষ্টির সার্থক রূপায়ণ হিসাবে পরিগণিত।
Leave a comment