এটি মধুসূদনের ‘বীরাঙ্গনা’ কাব্যের একেবারে শেষতম পত্র অর্থাৎ একাদশ সংখ্যক পত্র। এ পত্রের কাহিনি মধুসূদন গ্রহণ করেছেন কাশীরাম দাসের মহাভারত থেকে। আর মহাভারতে এ কাহিনি গৃহীত হয়েছিল ‘জৈমিনি ভারত’ থেকে এই পৌরাণিক আখ্যানগুলি থেকে জানতে পারি জনা ছিলেন মাহেশ্বরী পুরীর অধীশ্বর নীলধ্বজের স্ত্রী। তিনি ছিলেন অত্যন্ত গঙ্গভক্ত । গঙ্গার কৃপায় শিবের এক উপাসক জনার গর্ভে পুত্ররূপে জন্মলাভ করেন, তাঁর নাম প্রবীর। পাণ্ডবদের অশ্বমেধের ঘোড়া মাহেশ্বরী পুরীতে এসে হাজির হলে প্রবীর তাকে আটকে দেন। রাজা নীলধ্বজল ছেলেকে ওই ঘোড়া ছেড়ে দিতে বলেন। কিন্তু যুবরাজের পক্ষে এ কাজ ক্ষাত্র্যধর্মোচিত নয় বলে জনা পুত্রকে যুদ্ধে উৎসাহ দেন এবং অশ্বমেধ যজ্ঞের নিয়মানুযায়ী অর্জুনের সাথে প্রবীর-এর যুদ্ধ বাধে। এই যুদ্ধে শ্রীকৃষ্মের সহায়তায় অনেক কৌশল প্রয়োগের দ্বারা পাণ্ডবরা জয়লাভ করেন। প্রবীর নিহত হন অর্জুনের হাতে। যুদ্ধের পরে অগ্নিদেবের পরামর্শে কৃষ্ণভক্ত নীলধ্বজ অর্জুনের সঙ্গে সন্ধি স্থাপন করেন। পুত্রহন্তার সাথে স্বামীর এরূপ আচরণে পুত্রশোকে শোকাতুরা জনা অত্যন্ত কাতর হয়ে পড়েন ও মনের যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে রাজাকে এই পত্রখানি লেখেন।

পুরাণ কাহিনি থেকে পত্র রচনার যোগ্য মুহূর্তটি কবি নির্বাচন করেছেন। ‘বীরাঙ্গনা’ -র প্রত্যেক নায়িকাই একটি চূড়ান্ত মুহূর্ত বা Claimax-এ পৌঁছে তাদের মনের ‘বাঁধন ভেঙে ফেলেছে তার নিজের সমস্ত চাওয়া-পাওয়ার কথা উজাড় করে পত্রগুলি লিখেছে। জনার জীবনে সেই চূড়ান্ত মুহূর্তের আবির্ভাব প্রবীরের মৃত্যুর পর প্রবীরের মৃত্যু এ পত্রের পটভূমি রচনা করলেও মৃত্যুর জন্যে এই পত্র নয়, বরং বলা চলে বীর পুত্রের ক্ষাত্রোচিত মৃত্যুতে তিনি গর্বিতা। এ পত্র আসলে লেখা হয়েছে সস্তান প্রবীরের মৃত্যু পরবর্তী স্বামীর যে ভূমিকা তাকে কেন্দ্র করে বীর হওয়া সত্ত্বেও স্বামীর ক্লীবত্বে ব্যতিক্রমী ভূমিকার দাসানুদাসের মনোভাব পুত্রাহস্তারকের প্রতি ক্রোধে প্রজ্জ্বলিত না হয়ে উঠে অথবা শত্রুরক্তে হস্ত রঞ্জিত না করতে চেয়ে সেই হাতেই কৃষ্ণার্জুনের পদসেবা তিনি কিছুতেই মানতে পারেননি। ক্ষত্রিয় রমণীর অভিমান, জননীর শূন্যক্রোড়-এর বেদনা ও রাজমহিষী রূপে তার যে অস্তিত্ব তা তাঁকে প্রবল ভাবে স্বামীর এই কৃতকর্মের প্রতি প্রতিবাদে মুখর করে তুলেছে। তাই নিজের মনের সমস্ত আবেগ ক্ষোভ, যন্ত্রণা প্রকাশের জন্য জনা বেছে নেন পত্র মাধ্যম। মধুসূদন রোমক কবি ওভিদের কাছ থেকে পত্রকাব্যের যথাযথ আঙ্গিকটি আত্তীকরণ করে সেই আঙ্গিককে নবপুরাণ সৃষ্টির কাজে আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে যথাসম্ভব নিজের মতো করে ব্যবহার করলেন।

জনার পত্র প্রত্যক্ষত প্রেমপত্র নয়। অন্যান্য পত্রের মতো এ পত্রে নায়ক নায়িকার প্রেমসম্পর্ক সরাসরি উপস্থিত নয়। নীলধ্বজ ও জনা রাজা ও রাজমহর্ষী তারা পরস্পর স্বামী-স্ত্রী, একজন আরেকজনের খুব কাছের মানুষ। অন্যায় যুদ্ধে পুত্রের মৃত্যুকে আজ তাদের হৃদয়ের পারস্পরিক প্রণয়বন্ধন লেগেছে ব্যবধানের ছোঁয়া। পত্রে জনা স্বামীর সাথে তার সেই দুরত্বটুকুকে বজায় রেখেই নিজের মনসঞ্জাত ক্ষোভ, অভিমান, অভিযোগ সব আপনার মতো করে প্রকাশ করেছেন। তেমন বাইরের দিক থেকে পত্রকাব্যটির উপস্থাপন ভঙ্গির দশরথের প্রতি কৈকয়ী পত্রের কিছু মিল আছে। উভয়েরই উৎসমূলে আছে সন্তানের প্রতি বাৎসল্য এবং পত্ররচনার হেতু হিসেবে উভয় ক্ষেত্রেই সক্রিয় থেকেছে স্বামীর দৌবল্য বা অবিচার। তবে সুরের তাত্তম্য বিচারে জনার পত্রটি অনেক বেশি আকর্ষণীয়।

অনুযোগ পর্যায়ের এই পত্রটিতে বাৎসল্য ও নারীর বীর্যবর্তী ভূমিকা—উভয়ের, আশ্চর্য সমন্বয় ঘটেছে। কৈকেয়ী-র তুলনায় জনার ঘোষণা অনেক বেশি দৃপ্ত ও বীরোচিত। পত্রটি শুরু হয়েছে ভাণ জাতীয় নাটকীয় সংলাপ-এর মধ্য দিয়ে। মাহেশ্বরী পুরীতে আজ যে রণবাদ্যের গর্জন শোনা যাচ্ছে চারিদিকে সে সাজো সাজো রব উঠেছে—তার কারণ জনার অজ্ঞাত নয়। কিন্তু সমস্ত জানবার পরেও স্বামীর অনুচিত ব্যবহারে নীলধ্বজের প্রতি জনার শ্লেষাত্মক প্রশ্ন—‘সাজিছ কি নররাজ, বুঝিতে সদলে—/প্রবীর পুত্রের মৃত্যু প্রতিবিধিৎসিতে,—/ নিবাইতে এ শোকাগ্নি ফাল্গুনির লোহে? এই ভাণের মধ্যে দিয়ে পাঠকের সঙ্গে জনাও নিজেকে একই তলে অধিষ্ঠান করিয়েছেন। এই জাতীয় শ্লেষাত্মক প্রশ্নবাক্যের মধ্যে দিয়ে পাঠক মনেও শুরু থেকেই একটি তীব্র কৌতুহল জন্মানোর ক্ষেত্রটি প্রস্তুত হয়েছে আর পাশাপাশি পুত্রহস্তার অর্জুনের সঙ্গে রাজা নীলধ্বজা যে অপমানজনক সন্ধি স্থাপন করেছেন তার প্রতি জনার তীব্র গ্লানি বর্ষিত হয়েছে। প্রথম স্তবকের ২০টি পঙক্তি মোট তিনটি প্রশ্ন চিহ্নের ব্যবহারে জন্য তার স্বামীকে সরাসরি বিদ্রূপবাণে বিদ্ধ করেছেন, আর সংযত অথচ আবেগের উত্তাপ থাকায় সংলাপগুলিও হয়েছে দীর্ঘ। আর মূল বিষয়টি অবগত হওয়া সত্ত্বেও তা না জানার যে ভাণটি শুরুতে প্রকাশ পেয়েছে তাতে প্রথম থেকেই পাঠককে মূল বক্তব্য ও মূল ঘটনার প্রতি আগ্রহী হতে হয়, তার প্রকৃত সত্যের উন্মাচন বিলম্বিত হবার ফলে নাটকীয় উৎকণ্ঠার ক্রমশ বৃদ্ধি পায়। এইভাবে পত্রাকাব্যের মধ্যে নাটকীয়তা সৃষ্টির ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছেন কবি। এছাড়াও, পত্রের শুরুতে একদিকে যুদ্ধ পরিবেশ-এর মধ্যে দিয়ে পত্রে সঞ্চারিত হয়েছে বীররস। অশ্ব, গড়, উদ্ভাব প্রতিবিধিৎসিতে-র মতো শব্দ রাজপতাকা, রণবাদ্য, সৈন্যসমাহার যার দ্যোতক; অন্যদিকে মাইকেল এখানে দক্ষতা দেখিয়েছেন। প্রতিহিংসার ঘোষণাও প্রতিবিধান এই দুইয়ের সমন্বয়ে গড়া শব্দটি।

২য় স্তবকে এসে প্রথম স্তবকের সেই উৎকণ্ঠা কিছুটা নিবৃত্ত হয়। প্রথমে স্তবকের যে বিদ্রূপাত্মক প্রশ্ন থেকে সম্পূর্ণ এক বিপরীত অভিজ্ঞতায় পৌঁছাই আমরা ২য় স্তবকে এসে,—‘বসেছি পুত্রহা রিপু মিত্রোত্তম এবে! সেবিছে যতনে তুমি অতিথি রতনে। জ্ঞাত সত্যকে কৌশলে প্রচ্ছন্ন রাখবার এই ভঙ্গি জনার ইচ্ছাকৃত তবে এই খেদোক্তির মধ্যে দিয়ে পাঠককে মূল সত্যকে দিকে নিয়ে গেলেন কবি। জানিয়ে দিলেন স্বামীর প্রতি ক্ষোভের কারণটি ২য় স্তবকটি মাত্র পাঁচটি চরণ নিয়ে গঠিত। তবে এই স্তবকে ‘হায় পাগলিনী জনা!’ অংশটি লক্ষ্য করবার মতো। ‘হায়’ শব্দটি প্রবল খেদসূচক, জনা নিজের উদ্দেশ্যে ‘পাগলিনী’ শব্দটি ব্যবহার করছে। পুত্রের মৃত্যু শোক যে কোনো মা-য়েরই পক্ষেই তার ওপর পুত্রহস্তার প্রতি স্বামীর কোনোপ্রকার প্রতিনিধান না দেখিয়ে যদি তাকে প্রফুল্লচিত্তে সাদরে অভ্যর্থনা করে অতিথিরূপে বরণ করতে উদ্যত হয় তবে সেই অপমান মানি স্ত্রীর পক্ষে কতটা দুঃসহ হতে পারে তার সার্থক প্রকাশ ঘটেছে ‘পাগলিনী’ শব্দটির মধ্যে। তীব্র শোকাতুরা জননীর প্রতি স্বামীর সাহচর্যের পরিবর্তে এ যেন এক নিদারুণ অবিচার।

জনার আত্মমর্যাদা বোধ অত্যন্ত প্রখর, তাই স্বামীর এরূপ ব্যবহারে তিনি লজ্জাবোধ করেন—’কি লজ্জা! দুঃখের কথা, হায়, কব কারে?’ স্বামীকে তার কর্তব্য জ্ঞান সম্পর্কে সচেতন করাবার একটি মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে, তৃতীয় স্তবকে। ঊনবিংশ শতকের নারীজাগৃতির পটভূমিতে দাঁড়িয়ে এই মনোভাব পোষণ অবশ্যই একজন আধুনিকা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধে উদ্দীপ্ত নারীরই পক্ষেই সম্ভব। গোটা মধ্যযুগ ধরে আবহমান ধারা চলে আসছিল তাতে মনে করা হত অন্ধভাবে অনুসরণেই পত্নীজীবনের সার্থকতা—তাতেই সতীত্বের পরাকাষ্ঠা। কিন্তু ১ম শতকীয় নবজাগরণের প্রেক্ষাপটে মধুসূদন এই প্রচলিত ধ্যান ধারণার যথাসম্ভব বদল ঘটালেন। বুঝিয়ে দিলেন স্বামীর যোগ্য সহধর্মিণী হিসেবে তাঁর কতব্যকর্মের ভালো মন্দ উভয়দিকের সমালোচনা করবার অধিকার স্ত্রীর আছে। স্বামীকে তার সঠিক পথে চালিত করা ও পরামর্শ দেবার অধিকার যে স্ত্রীর থাকা উচিত, এই বোধের প্রতিষ্ঠা প্রাক আধুনিক যুগে সম্ভব ছিল না। কিন্তু বীরাঙ্গনা কাব্যের পৌরাণিক নায়িকার মধ্যে দিয়ে মধুসূদন এই বৈপ্লবিক প্রয়াস সম্ভব করেছিলেন। তাই জনাকে বলতে শুনি,

“রে দারুণবিধি, রাজা, আঁধারিলা আজি- 

রাজ্য, হরি পুত্রধনে, হরিলা কি তিনি 

জ্ঞান তব ? তা না হলে, কহ মোরে কেন 

এ পাষাণ্ড ‘পাণ্ডরথী পার্থ তব পুরে 

অতিথি ? কেমনে তুমি তুমি হায়, মিত্র ভাবে 

পরশ কর, যাহা প্রবীরের লোহে 

লোহিত ? ক্ষত্রিয় ধৰ্ম্ম এই কি নৃমণি ?”

তৃতীয় স্তবকে ১৬টি মোট ৯টি প্রশ্নচিহ্ন ব্যবহৃত হয়েছে, মোট ১১বার ‘কি’, ‘কেমন’–এই জাতীয় প্রশ্নবোধক সর্বনাম পদের ব্যবহার নীলধ্বজের প্রতি প্রশ্নগুলি অনেক বেশি তেজদৃপ্ত হয়েছে। পাগলিনী জনা চোখের সামনে মাহেশ্বরী পুরীর যে রাজসভা চিত্র প্রত্যক্ষ করছেন তার প্রতি তাঁর ধিক্কার আরও বেশি তীব্র ও তীক্ষ্ণ হয়েছে এই ‘কি, কেন, কেমনে’ এই শব্দগুলির প্রয়োগে।

চতুর্থ স্তবকে এসে জনা সরাসরি জানাচ্ছেন স্বামীর এই কৃতকর্ম সম্পূর্ণ অনুচিত, ধিক্কারযোগ্য, ভ্রান্ত—‘একি ভ্রান্তি তব ?’ স্বামীর কাপুরুষতার প্রতি জনার প্রতিবাদের পাশাপাশি এই স্তবকে রয়েছে পত্রটির আরও একটি ব্যতিক্রমী দিক। অর্জুনকে নারায়ণ জ্ঞানে পুজো করার ঘটনা জনা মেনে নিতে পারেননি, কারণ অর্জুন, ‘স্বৈরিণী’, কুন্তীর পুত্র–কুম্ভীর গর্ভে ইন্দ্রের ঔরসে তার জন্ম। জনা সেই ভোজবালাকে ‘কুলটা’, অর্জুনকে ‘জারজ’ সম্ভান বলে তিরস্কার করেছেন। মহাভারতের কথক দ্বৈপায়নও জনার আক্রমণ থেকে রেহাই পাননি। অন্যদিকে দ্রৌপদী হলেন পঞ্চপাণ্ডবের সঙ্গসুখ লাভে ধন্যা, ‘রথীকুলপতি’ পার্থের ক্ষাত্রবীর্য সম্পর্কেও সন্দিহান প্রবীর জননী। কারণ তিনি ব্রাহ্মণ বেশে দ্রৌপদীকে লাভ করেন, কৃষ্ণের দাক্ষিণ্যে খাণ্ডব দহন করেন আর কর্ণকেবিনাশ করার মধ্যেও তাঁর কৃতিত্ব কিছু নেই। জনার আক্ষেপ এখানেই—এহেন পাণ্ডবকেই মহারাজ তোষণ করছেন। চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ স্তবক জুড়ে এভাবেই প্রচলিত মতের বিরুদ্ধাচরণ করে ভিন্নতর যুক্তি স্থাপন করেছেন জনা। শুধু তাই-ই নয়, মহাভারতের একাধিক সংগ্রামে প্রতিপদে ছলনার আভাস দেখেছেন প্রবীর জননী—এ দেখা কেবল জনার দেখা নয়, আসলে কবি মধুসূদনের চোখেই মহাভারতের কাহিনির এরূপ অভিনব ও প্রচলিত স্রোতের বিরুদ্ধ দৃশ্যায়ন ঘটেছে। আর একেবারেই এ পত্রিকার জনা চরিত্রটি মহাভারত থেকে উঠে এলেও স্বরূপে তিনি মাইকেলের মানসপ্রতিমা। গোটা পত্রে একদিকে জনার মাতৃবেশ ও অন্যদিকে আত্মমর্যাবোধে উদ্দীপ্ত এক সহধর্মিণীবেশের যথার্থ সমন্বয় ঘটেছে।

৭ম স্তবকে প্রকাশ পেয়েছে মাইকেলের অমোঘ বিধি চেতনা। হোমারের ইলিয়াড বা সফোক্লিসের nemesis বা নিয়তি চেতনাও এর উপজীব্য জনা সেই নিয়তিরই বশীভূত। তাই এত কিছুর পরেও তিনি বলছেন—

“কিন্তু বৃথা এ গঞ্জনা। গুরুজন তুমি ;

পড়িব বিষমপাপে গঞ্জিলে তোমারে।

কুলনারী আমি, নাথ, বিধির বিধানে

পরাধীনা! নাহি শক্তি মিটাই স্ববলে

এ পোড়া মনের বাঞ্ছা!”

সমস্ত ঘটনার জন্য নিজের ভাগ্যকেই দোষ দিয়েছেন জনা, আর এভাবেই তিনি সমাপ্তি অংশে এসে অর্জন করেছেন ট্রাজিক নায়িকার অশ্রদীপ্ত বিভব।

একেবারে শেষ দিকে যে জনাকে পাই তিনি এক পরিপূর্ণা মাতা, পুত্রশোকে শোকাতুরা, পাগলিনী। কবি তাকে তুলনা করছেন ‘মণিহারা ফণীর’ সাথে। শিরে তার অগ্নিজ্বালা তিনি পরম ভাগ্যহীনা। সতীত্বের প্রশ্ন জনার কলহমূলক বক্তব্য চরিত্রটির মাহাত্ম্যকে কিছুটা ম্লান করলেও পরিশেষে আত্মমর্যাদা রক্ষার্থে যেভাবে সে আত্মবিনাশের সিদ্ধান্ত বেছে নিয়েছে ও নীলধ্বজের প্রতি নতি স্বীকার অস্বীকার করেছে, তাতে চরিত্রটি বিস্ময়কর মহিমায় মহিমান্বিত হয়ে উঠেছে—

“ক্ষত্রাকুল বালা আমি ; ক্ষুত্রকলবধূ/কেমনে এ অপমান সব ধৈর্য ধরি ?/ছাড়িব এ পোড়া প্রাণ জাহ্নবীর জলে;/দেখিব বিস্মৃতি যদি কৃতান্ত নগরে লভি অন্ত্যে।”

—এই গৌরববোধ ও প্রবল আত্মমর্যাদাবোধে মণ্ডিত হয়ে জনা পাঠকের কাছে ভাবেও ভাবনায় বক্তব্য ও ভূমিকায় ‘বীরাঙ্গনা’ নামেরই উপযুক্ত হয়ে উঠেছে। আর এক্ষেত্রে তার আত্মমর্যাদাবোধকে অক্ষুণ্ণ রাখবার জন্য যে প্রকারণিক সৌকর্যের মধ্যে দিয়ে কবি অগ্রসর হয়েছেন, তাতে সৃষ্টি ও স্রষ্টা উভয়ের মহিমাই ভাস্বর হয়ে উঠেছে।

পত্রটিকে নাটকীয় একোপ্তির সুন্দরব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। একোক্তিগুলি উত্তর প্রত্যুত্তের প্রত্যাশা থেকে মুক্ত, দীর্ঘ সংলাপধর্মী কখনও কখনও নাটকীয় তীব্রতা সৃষ্টির জন্য একোকিন্তুর অবিমিশ্র ছাঁচে ভেঙে ফেলে সংযোজনের মাত্রাকে বাস্তবের সীমা ছাড়িয়ে দূরনির্দেশক করে তুলেছেন। স্বাভাবিক সংযোজনের ক্ষেত্রে সঙ্কোচিত চরিত্রগুলি এমনভাবে নায়িকার সামনে উপস্থিত থাকে, যাতে মনে হয় তারা নায়িকার সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংলাপে মগ্ন। কিন্তু এক্ষেত্রে অনুপস্থিত চরিত্রকে লক্ষ্য করে নায়িকা এমন ভক্তি প্রয়োগ করেছেন, যার ফলে মনে হয় সেই চরিত্রটিও যেন নায়িকার সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংলাপে অংশগ্রহণকারী। এই কৌশলটিই জনার পত্রে বহুমাত্রিক আকারে প্রযুক্ত হয়েছে। এখানে জনার পাত্র রচনা নীলধ্বজকে উদ্দেশ্য করে, কিন্তু অপ্রধান চরিত্ররূপে পাই মৃতপুত্র প্রবীর ও নিয়তি বা বিধির উপস্থিতি। চতুর্থ স্তবকে একপক্ষ আশ্রিত (নায়িকা আশ্রিত) সংলাপে পাই বিমূর্ত অদৃষ্ট-এর উপস্থিতি। আর অষ্টম স্তবকে রয়েছে মৃতপুত্র প্রবীর-এর উপস্থিতি। প্রত্যক্ষ সংলাপের ক্ষেত্রে এই সমস্ত চরিত্র একই অনুভুমিক তলে অবস্থান করলেও। অপ্রত্যক্ষ, নায়িকাশ্রিত সংলাপের ক্ষেত্রে চরিত্রগুলি বহুতলিক হয়ে উঠেছে। ৩টি দৃষ্টান্ত থেকে ব্যাপারটি স্পষ্ট হতে পারে—

১. ….কি না তুমি জানরাজা? কি কব তোমারে ? জানিয়া শুনিয়া তবে কি ছলনে ভুল আত্মশ্লাযা, মহারথি? – (জনা—→নীলধ্বজ) (ষষ্ঠ স্তবক)

২. ….রে দারুণ বিধি,/ একি লীলাখেলা তোর, বুঝিব কেমনে ?/ একমাত্র পুত্র দিয়া নিলি পুনঃ তারে অকালে ?’ –(জনা→ বিমর্ত বিধি) (চতুর্থ স্তবক) 

৩. ‘হা প্রবীর! এই হেতু ধরিনু কি তোরে,/দশ মাস দশদিন নানা যত্নসয়ে, এ উদরে ?…..হায় পুত্র! শোধিলি কিরে তুই এইরূপে মাতৃধার?

(১), (২) ও (৩)-এর মধ্যে পার্থক্য সহজেই বোঝা যায়। (১) এ সংযোজিত চরিত্র নীলধ্বজ ও নায়িকা জনার প্রত্যক্ষ সংযোগ রয়েছে। কিন্তু (২) ও (৩)-এ নায়িকা জনা সংলাপের উপস্থাপনার মধ্যে দিয় অদৃশ্য বিমূর্ত বিধি ও মৃতপুত্র প্রবীর—এই দুই দূরায়ত উদ্দিষ্টের সঙ্গে যুক্ত হতে চেয়েছেন।

দ্বিতীয় ও নবম স্তবকের সংলাপে সংযোজনের সম্পূর্ণ একটি বিপ্রতীপ কৌশল খুঁজে পাই। কবি এক্ষেত্রে অতিরিক্ত কোনো চরিত্র বা দূরায়ত উদ্দিষ্ট ব্যবহার না করে একেবারে বীপরীত প্রক্রিয়া নায়িকা কথক সত্তাকে দ্বিখণ্ডিত করে প্রকাশ করেন। এভাবে প্রকাশ পায় নায়িকার split personality বা দ্বৈত সত্তা। এক্ষেত্রে পত্রলেখিকা নিজেই নিজেকে সম্বোধন করে, ফলে নায়িকার অহং রূপ বর্ণিত হয় প্রথম পুরুষে, ক্রিয়াবিভক্তিতেও লক্ষ্য করা যায় প্রথম পুরুষের চিহ্ন। যেমন—

১. ‘হায়, পাগলিনী জনা! তব সভামাঝে/নাচিছে নর্তকী আজি’ (২য় স্তবক)– এখানে জনা নিজেই নিজেকে পাগলিনী বলে সম্বোধন করছে। 

২. ‘কেন বৃথা, পোড়া আঁখি, বরাবিস্ আজি বারিধারা ?……/ কেন বা জলিলমন ?/….পাণ্ডবের শরে খণ্ড, শিরোমণি তোর, বিবরে লুকায়ে কাঁদি দেশে, মর, অরে, মণিহারা ফণি!– এক্ষেত্রে নায়িকা জনা যেন পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে দ্বৈতরূপে বিভাজিত করে নিজেকে উদ্দিষ্ট রূপে দাঁড় করিয়ে নিজেই নিজের অপর সত্তাকে প্রশ্ন করেছেন, আর নিজের প্রতি ‘অবোধ’, ‘মণিহারা ফণি’ এই জাতীয় নেতিবাচক অভিধা প্রয়োগ করেছেন।

একই চরিত্রকে একাধিক বিশেষণে চিহ্নিত করবার রীতিটিকে বলা হয় ‘সমসূচক প্রয়োগ’। নায়ক চরিত্রের বিবিধ সত্তার প্রকাশের জন্য, কাব্যে নাটকীয়তার মাত্রা ও বৈচিত্র্য বাড়াতে এই প্রক্রিয়া অবলম্বন করা হয়। তাছাড়া, এর ভেতর দিয়ে নায়িকার মনস্তাত্ত্বিক স্বরূপ প্রতিফলিত হয়। এই রীতিটি ‘বীরাঙ্গনা’ ‘নররাজ’, ‘মহাবাহু’ ‘প্রভু’ ইত্যাদি শ্রেষ্ঠত্বজ্ঞাপক বিশেষণ প্রয়োগে জনা তার বক্তব্য শুরু করলেও পরে তাকেই আবার নীলধ্বজের উদ্দেশ্যে হতজ্ঞান্ ‘আত্ম শ্লাঘা মহারথি’, ‘নতশির’ এই জাতীয় হীনতাসূচক সম্ভাষণ প্রয়োগ দেখা যায়। তাছাড়াও, ষষ্ঠ স্তবকে একই পঙক্তিতে ‘রাজা শিরোমণি’ ও ‘নতশির’ ; ‘ভীরুতা’ ও ‘বলবাহু’ এই জাতীয় পরস্পর বিরোধী শব্দের প্রয়োগে কবি নীলধ্বজ এর বিবিধ সত্তাকে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন।

“চণ্ডালের পদধূলি ব্রাহ্মণের ভালে? 

কুরঙ্গীর অশ্রুবারি নিবায় কি কভু

দাবানলে? কোকিলের কাকলী-লহরী

উচ্চনাঙ্গী প্রভঞ্জনে নীরবয়ে কবে ?”

–এই অংশটিতে শুধু মাইকেলের চারুবাকশিল্প নয়, পাই তার কাব্যপ্রতিভার সারাৎসার কবি এখানে বিভিন্ন বিষম ধাতু ও শব্দকে একই আধারে মিলিয়ে দেবার প্রতিভার চূড়ান্ত স্বাক্ষর রেখেছেন।

‘বীরাঙ্গনা’ কাব্যের অন্যান্য পত্রিকার মতোই এ পত্রাটিকেও ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে পাই মেয়েলি ভাষার নিজস্ব টোন। যেমন—“আঃ মরি, কি সতী! শাশুড়ীর যোগ্য বধূ। (নীলবীজে প্রতিজনা)

এছাড়াও, সমগ্র পত্রটিতে তৎসম শব্দের প্রাচুর্যে ধ্বনিতরঙ্গের সৃষ্টি হয়েছে। তাছাড়া এপত্রে সর্বত্রই মধুসূদনের সদা জাগ্রত নীতিবোধ তাঁর প্রতিভাকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। ন্যায় ও ধর্মবোধের দ্বারা উদ্দীপিত ধ্রুপদী মহাকাব্যধর্মিতার সঙ্গে লিরিক প্রবণতা তথা রোমান্টিক তার মাধুর্য্য মিশে গেছে। দুইয়ের মিলনে মিশ্রণে এভাবেই কবি গড়েছেন নতুন যুগের এক কবিতার ভাষা। আর প্রযুক্ত ছন্দ যে তার সহযোগী এ কথা বলার অপেক্ষাই রাখে না। প্রাচ্য কবিতার সঙ্গে পাশ্চাত্য কবিতার এখানে এক অপূর্ব সমন্বয় সাধিত হয়েছে।