বিহার ও বঙ্গদেশে তুর্কি-বিজয়:

বিহার ও বঙ্গদেশের ওপর তুর্কি শাসন প্রতিষ্ঠার কৃতিত্ব প্রাপ্য মহম্মদ ঘুরির আর এক দক্ষ সেনাপতি ইখতিয়ারউদ্দিন-মহম্মদ-বিন্-বখতিয়ার খলজির। মহম্মদ ঘুরি বখতিয়ারকে বারাণসীর পার্শ্ববর্তী কিছু অঞ্চলের শাসনভার দিয়েছিলেন। কিন্তু বতিয়ার ছিলেন উচ্চাকাঙ্ক্ষী। তাই সময় সুযোগমতো তিনি বিহারের অসংরক্ষিত অঞ্চলসমূহে মাঝে মাঝে হানা দিতে থাকেন। এইভাবে তিনি বিহারের প্রখ্যাত বৌদ্ধবিহার নালন্দা ও বিক্রমশীলা আক্রমণ, লুণ্ঠন ও ধ্বংস করেন। উদ্যানপুরে তিনি একটি দুর্গও নির্মাণ করেন। বিহারে সাফল্যলাভের পর তাঁর দৃষ্টি যায় বঙ্গদেশের দিকে। বঙ্গদেশের প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য এবং সমৃদ্ধ বহিবাণিজ্যের কথা বখতিয়ারের অজানা ছিল না। তাই রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে বাংলার ধনসম্পদ লাভ করে নিজের রাজকোষকে শক্তিশালী করার উদ্দেশ্যে তিনি বঙ্গদেশ আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন।

মিনহাজউদ্দিনের ‘তবকাৎ-ই-নাসিরী’ গ্রন্থ থেকে বতিয়ার কর্তৃক নদিয়া বিজয়ের বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায়। তবে মিন্হাজ এই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন না। ঘটনার প্রায় ৫০ বছর পরে লোকশ্রুতির ভিত্তিতে তিনি এই বিবরণ রচনা করেন (আনুমানিক ১২৫০ খ্রিস্টাব্দের পরে) এরও একশো বছর পরে আর এক ঐতিহাসিক ইসামী ‘ফুতুহ-উস্-সালাতিন’ গ্রন্থে এই প্রসঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা করেছেন। এই গ্রন্থদ্বয় থেকে জানা যায় যে, তখন বঙ্গদেশের শাসক ছিলেন সেনবংশীয় লক্ষ্মণসেন। তিনি ছিলেন বয়সের ভারে ক্লান্ত এবং জ্যোতিষশাস্ত্রে গভীরভাবে বিশ্বাসী। শাস্ত্রকারগণ বিধান দিয়েছিলেন যে, তাঁর রাজ্য শীঘ্রই তুর্কিদের দ্বারা আক্রান্ত হবে এবং তিনি ক্ষমতাচ্যুত হবেন। এমতাবস্থায় ইখতিয়ারউদ্দিন অশ্ববিক্রেতার ছদ্মবেশে মাত্র ১৭ জন (মতান্তরে ১৮ জন) সশস্ত্র অনুচরসহ নদিয়া আক্রমণ করেন (আনুমানিক ১২০৪-১২০৫ খ্রিস্টাব্দে)। তাঁর বাকি অনুচরেরা ছিল কিছুটা দূরে। যাই হোক্, তুর্কি আক্রমণের মুহূর্তে লক্ষ্মণসেন মধ্যাহ্নভোজনে রত ছিলেন। ঘটনার আকস্মিকতায় বিহ্বল লক্ষ্মণসেন নাকি জ্যোতিষীর গণনাকে অভ্রান্ত মনে করে কোনোরূপ প্রতিরোধ ছাড়াই নগ্নপদে প্রাসাদের পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে নৌকাযোগে পালিয়ে যান। বখতিয়ার খলজি বিনাবাধায় নদিয়া দখল করেন। ইতিমধ্যে বাকি তুর্কি সেনারাও নগরীতে প্রবেশ করে অবাধ লুণ্ঠন শুরু করে। বঙ্গদেশ দখল করার পর বখতিয়ার খলজি লখনৌতে রাজধানী সরিয়ে এনে বাংলা শাসন করতে থাকেন। লক্ষ্মণসেন দক্ষিণবঙ্গের সোনারগাঁতে গিয়ে কোনোক্রমে নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করেন।

বখতিয়ার খলজি মাত্র ১৭ জন সৈন্যসহ নদিয়া দখল করেছিলেন কি না, কিংবা লক্ষ্মণসেন কাপুরুষের মতো অষ্টাদশ তুর্কি-সৈন্যের ভয়ে রাজধানী অরক্ষিত রেখে পলায়ন করেছিলেন কিনা— ইতিহাসের বিতর্কিত বিষয় হিসেবেই থেকে গেছে। কারণ এ ব্যাপারে মিনহাজউদ্দিন ও ইসামীর বিবরণ থেকে উল্লিখিত বক্তব্য দুটিকেই সঠিক মনে হয়। এর ওপর ভিত্তি করে কবিবর নবীনচন্দ্র সেনও লক্ষ্মণসেনকে দোষী সাব্যস্ত করে লিখেছেন : “সপ্তদশ অশ্বারোহী যবনের ডরে…… ‘সোনার বাংলা রাজ্য দিলা বিসর্জন।” শিল্পী সুরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় তৎকালীন একটি প্রখ্যাত চিত্রে লক্ষ্মণসেনের কলঙ্কজনক পলায়ন-কাহিনি অঙ্কন করেছেন। তবে ঘটনাপরম্পরা ও যুক্তিতর্কের বিশ্লেষণ করলে নতুন তথ্যের সন্ধান পাওয়াও অসম্ভব নয়। ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার ও ড. নীহাররঞ্জন রায় মনে করেন, মুসলমান ঐতিহাসিকদের রচনার ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্তে আসা যায় না যে, মাত্র সতেরো-আঠারো জন সৈন্য নিয়ে ইতিয়ারউদ্দিন বাংলা জয় করেছিলেন কিংবা রাজা লক্ষ্মণসেন নিতান্তই কাপুরুষ ছিলেন। মিনহাজ নিজেই লক্ষ্মণসেনকে “আর্যাবর্তের রাজাগণের মধ্যে প্রধান” বা “হিন্দুস্তানের রায় (রাজা)-গণের মধ্যে খলিফাস্থানীয়” বলে প্রশংসা করেছেন। গৌড়, কামরূপ, কলিঙ্গ, প্রয়াগ, কাশী প্রভৃতি অঞ্চলে লক্ষ্মণ সেনের শৌর্যের পরিচয় আগেই পাওয়া গেছে। এখন প্রশ্ন হল তিনি বিনাপ্রতিরোধে এত কমসংখ্যক তুর্কির ভয়ে পালিয়ে গেলেন কেন? প্রথমেই বলা যায়, সতেরো বা আঠারো জন তুর্কি সৈন্য কর্তৃক আক্রান্ত হবার তত্ত্বটাই সঠিক নয়। ইতিয়ারউদ্দিন যখন নদিয়া প্রাসাদের সিংহদুয়ারে উপস্থিত হন, তখন তাঁর পাশে এই সামান্যসংখ্যক অনুচর হয়তো ছিল ; তবে তাঁর মূল বাহিনী তখন নগরীর সীমান্তে উপস্থিত হয়ে গিয়েছিল। কারণ প্রাসাদরক্ষীদের কোলাহলের সঙ্গে সঙ্গেই নগরীর জনগণের কোলাহলও শ্রুত হচ্ছিল। পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝতে পেরেই সম্ভবত লক্ষ্মণসেন পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তা ছাড়া তুর্কিবাহিনী তাদের নেতাসহ অশ্ববিক্রেতার ছদ্মবেশে নগরীতে প্রবেশ করেছিল। তখন এদেশে উন্নতমানের ঘোড়া ছিল না। তাই বিদেশি অশ্ববিক্রেতাদের বিনা বাধায় নগরীতে প্রবেশের ঢালাও অনুমতি দেওয়া ছিল। এক্ষেত্রে ইখতিয়ারউদ্দিন চাতুরির দ্বারা রাজ্যজয় করেছিলেন, – যুদ্ধ দ্বারা নয়।

এতদ্‌সত্ত্বেও লক্ষ্মণ সেনের দায়িত্বকে অস্বীকার করা যায় না। উত্তর ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলসহ পূর্ব ভারতের বিহার পর্যন্ত তুর্কি-আধিপত্য প্রসারিত হওয়া সত্ত্বেও লক্ষ্মণ সেন বঙ্গদেশের সীমান্ত সুরক্ষা করার ব্যবস্থা না করে অযোগ্যতা ও অপদার্থতার পরিচয় দিয়েছেন। তা ছাড়া শত্রুর আক্রমণের মুখে, তা যতই আকস্মিক বা প্রবল হোক্, নিজের রাজ্য ও জনগণকে সম্পূর্ণ অরক্ষিত রেখে পালিয়ে যাওয়া আর যাই হোক্, বীরত্ব বা মহত্বের দৃষ্টান্ত হতে পারে না। যাই হোক্, মহম্মদ ঘুরির অনুমতিক্রমে ইখতিয়ারউদ্দিন স্বাধীনভাবে বাংলা শাসন করতে শুরু করেন। তবে তাঁর শাসনকাল স্থায়ী হতে পারেনি। কারণ তিনি নির্বোধের মতো তিব্বত ও চিন অভিযানের কর্মসূচি গ্রহণ করে চরম অপদস্থ হন। এই অভিযানে বহু তুর্কি-সৈন্য তাঁর একগুঁয়েমির জন্য প্রাণ দিতে বাধ্য হয়। এমতাবস্থায় তাঁরই অধীনস্থ জনৈক আমির ক্রোধবশত ঘুমন্ত অবস্থায় ইখতিয়ারকে হত্যা করেন।

কুতুবউদ্দিন আইবক ও ইখতিয়ারউদ্দিন যখন ভারতে তুর্কি অধিকারকে সুসংহত ও সম্প্রসারিত করার কাজে ব্যস্ত, তখন মহম্মদ ঘুরি মধ্য-এশিয়ায় তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী খারিজম শাহের আক্রমণের মুখোমুখি হন। ১২০৩ খ্রিস্টাব্দে গিয়াসউদ্দিনের মৃত্যুর পর তিনি সমগ্র ঘুর সাম্রাজ্যের অধীশ্বর হন, কিন্তু ওই বছরেই খারিজম শাসকের হাতে দারুণভাবে পরাজিত হন। পারস্যের খারিজম শাহ্ সরকারের এই সাফল্য মহম্মদ ঘুরিকে ভারতীয় সাম্রাজ্য সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে। অতঃপর তিনি ভারতীয় তুর্কি সাম্রাজ্যকে দৃঢ় ভিত্তিদানের গুরুত্ব উপলব্ধি করেন। মধ্য এশিয়ার ঘুরির পরাজয়ে ভারতে তাঁর শত্রুদের কেউ কেউ বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। পাঞ্জাবের যুদ্ধপ্রিয় খোকর উপজাতি তুর্কিদের ওপর আক্রমণ চালাতে থাকে। এমতাবস্থায় মহম্মদ ঘুরি ১২০৬ খ্রিস্টাব্দে ভারতে আসেন এবং বিদ্রোহী খোক্করদের দমন করেন। কারও কারও মতে, খোক্করদের ষড়যন্ত্রে তিনি ঝিলামের তীরে প্রার্থনা করার সময় নিহত হন। অন্য মতে, গোঁড়া শিয়া-সম্প্রদায়ের জনৈক আততায়ী তাঁকে হত্যা করে।