প্রবন্ধকে মূলত দুটি শ্রেণিতে বিভাজিত করা যায়—বস্তুনিষ্ঠ প্রবন্ধ বা বিষয়গৌরবী প্রবন্ধ ও ব্যক্তিনিষ্ঠ বা আত্মগৌরবী প্রবন্ধ।
যে গদ্য রচনায় একটি সুনির্দিষ্ট সীমারেখায় আদি, মধ্য অন্ত সমন্বিত চিন্তা শৃঙ্খলিত রূপ প্রকাশ পায় তাকে বস্তুনিষ্ঠ বা বিষয়গৌরবী বা তন্ময় বা আনুষ্ঠানিক বা Formal বা Informative Essay বলে।
বিষয়বস্তুর গাম্ভীর্যকে লেখকের ব্যক্তিগত ভাবরসে স্নিগ্ধ করে সরলভাবে যা পরিবেশন করা হয়, তাকে ব্যক্তিনিষ্ঠ বা আত্মগৌরবী প্রবন্ধ বলে।
উপরিউক্ত সংজ্ঞানুসারে বিষয়গৌরবী ও আত্মগৌরবী প্রবন্ধের কতকগুলি প্রভেদ লক্ষ করা যায়।
(ক) বিষয়গৌরবী প্রবন্ধে যুক্তনিষ্ঠা ও ভাবনার নির্দিষ্ট শৃঙ্খলা থাকবে কিন্তু আত্মগৌরবী প্রবন্ধে যুক্তি ও মননশীলতার পরিবর্তে লেখকের হৃদয়াবেগেরই প্রাধান্য থাকবে।
(খ) বিষয়গৌরবী প্রাবন্ধিক পাঠকের কাছে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। তাই প্রাবন্ধিকের সঙ্গে পাঠকের অন্তত কিছুটা দূরত্ব থেকে থাকে। কিন্তু ব্যক্তিনিষ্ঠ প্রবন্ধের পাঠকের সঙ্গে প্রাবন্ধিকের হৃদয়ের সংযোগ ঘটে, ফলে উভয়ের সম্পর্ক এখানে নৈকট্যের।
(গ) বস্তুনিষ্ঠ প্রবন্ধে প্রাবন্ধিকের ভূমিকা গুরুত্ব। এখানে তিনি পাঠকের অজ্ঞানতার অন্ধকার দূর করেন। তাঁর জ্ঞানের আলো বিতরণ করে। কিন্তু ব্যক্তিনিষ্ঠ প্রবন্ধে ভালোবাসার সম্পর্কে প্রাবন্ধিকের ও পাঠক মুক্ত। তাই অন্যের হৃদয়ের আলোকে পাঠক নিজেকে রসের জগতে নূতন করে আবিষ্কার করে।
(ঘ) বস্তুনিষ্ঠ প্রবন্ধ যুক্তি, তর্ক ও তথ্যের ভাণ্ডার—তাই আমরা তাকে শ্রদ্ধা করি, কিন্তু, ব্যক্তিনিষ্ঠ প্রবন্ধে যুক্তি ও তত্ত্ব একেবারে অধীকৃত না হলেও হৃদয়ের সম্পর্কের জন্য আমরা ভালোবাসি।
(ঙ) বস্তুনিষ্ঠ প্রবন্ধ যেন আত্মপ্রচারে উন্মুখ, কিন্তু ব্যক্তিনিষ্ঠ প্রবন্ধে রয়েছে আত্মনিবেদনের আকুলতা।
(চ) বস্তুনিষ্ঠ প্রাবন্ধিক যখন সোচ্চার, প্রচারমুখী ব্যক্তিগত প্রাবন্ধিক তখন নিরুচ্চার আত্মমগ্ন, গীতিকবির মতো নিবেদনে বিনম্র।
সর্বোপরি, সমালোচক শ্রীশচন্দ্র দাসের মন্তব্য উদ্ধৃত করে বলতে হয়—“বস্তুনিষ্ঠ প্রবন্ধ আমাদের বুদ্ধিকে তীক্ষ্ণতর, দৃষ্টিকে সমুজ্জল জ্ঞানের পরিধিকে প্রশস্ত করিয়া তোলে ও মন্ময় বা ব্যক্তিগত প্রবন্ধ জ্ঞানের বিষয়কে হাস্যরসমণ্ডিত পুষ্প পেলবতা দান করিয়া আমাদিগকে মুগ্ধ করে।”
একটি বস্তুনিষ্ঠ প্রবন্ধ হল—সত্যেন্দ্রনাথ বসুর ‘শিক্ষা ও বিজ্ঞান’।
একটি ব্যক্তিনিষ্ঠ প্রবন্ধ হল রবীন্দ্রনাথের ‘পঞ্চভূত’ গ্রন্থ।
বস্তুনিষ্ঠ প্রবন্ধের বৈশিষ্ট্য : বস্তুনিষ্ঠ প্রবন্ধের লক্ষণগুলি এমনভাবে সূত্রাকারে সাজানো যেতে পারে –
-
(ক) যুক্তিনিষ্ঠা ও ভাবনার নির্দিষ্ট শৃঙ্খলা থাকবে।
-
(খ) তত্ত্ব ও তথ্যের লক্ষণীয় প্রাধান্য থাকবে।
-
(গ) প্রাবন্ধিকের ব্যক্তিগত আবেগ অনুভবের পরিবর্তে বস্তুনিষ্ঠা ও মননের গুরুত্ব প্রাধান্য পাবে।
-
(ঘ) প্রাবন্ধিক বৈজ্ঞানিক তথা বিশ্লেষণী দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দেবেন।
-
(ঙ) প্রবন্ধের বিষয় সম্পর্কে প্রবন্ধকারের থাকবে নিঃস্পৃহতা, নিরপেক্ষতা ও আনুষ্ঠানিক মেজাজ।
-
(চ) ভাষা ব্যবহার সতর্কর্তা ও সংযম, গম্ভীর ভাষার মাধ্যমে প্রবন্ধের বক্তব্য প্রকাশিত হবে।
-
(ছ) প্রবন্ধের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে প্রবন্ধকার শিক্ষক বা পরামর্শ দাতার ভূমিকা পালন করবেন।
ব্যক্তিনিষ্ঠ প্রবন্ধের বৈশিষ্ট্য : ব্যক্তিনিষ্ঠ প্রবন্ধের লক্ষণগুলি সূত্রাকারে এমনভাবে নির্ণয় করতে হয়।
-
(ক) যুক্তি ও মননশীলতার পরিবর্তে লেখকের হৃদয়াবেগেরই প্রাধান্য থাকবে।
-
(খ) এর বিষয়বস্তু লেখকের কল্পনা তথা ভাবরসে জারিত হয়ে পাঠকের হৃদয়কে স্পর্শ করে।
-
(গ) সরস, মর্মস্পর্শী, আত্মগত ভঙ্গিতে পাঠককে কাছে টেনে নেন প্রাবন্ধিক।
-
(ঘ) বস্তুনিষ্ঠ প্রবন্ধকারের মতো মন্ময় প্রাবন্ধিক উদ্দেশ্য তাড়িত নন, বরং আত্মমগ্ন ও কিছুটা রহস্যময়।
-
(ঙ) ভাব প্রধান প্রবন্ধ মূলত ব্যক্তিগত নৈর্ব্যক্তিক নয়।
-
(চ) আবেগ ও কল্পনার প্রোজ্জ্বলতায় এ প্রবন্ধ লেখকের ব্যক্তিত্বের দর্পণ।
-
(ছ) ভাষার ব্যবহারে প্রবন্ধকার অনেক বেশি স্বাধীনতা পান এবং পাঠকের সঙ্গে আন্তরিক বিনিময় গড়ে তোলেন।
Leave a comment