সাহিত্য একপ্রকার মানসক্রিয়া ; অতএব যেহেতু এটি ব্যক্তি-মনের সৃষ্টি, সেই কারণেই সাহিত্য দেশ-কাল-ব্যক্তি-নিরপেক্ষ হতে পারে না। কারণ, কালে কালে দেশে দেশে মানুষের মন কখনও জড় বা স্থিতিশীল থাকতে পারে না; বিশেষত নানা পারিপার্শ্বিক কারণে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও অন্যবিধ কারণে দেশ-কাল-ভেদে ব্যক্তিমানুষের মনেরও গঠনগত বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। তাই সাহিত্যের কোন সুনির্দিষ্ট মানদণ্ড পাওয়া সম্ভব নয়। দেশে দেশে কালে কালে মানদণ্ডের পরিবর্তনও ঘটে। কাজেই সাহিত্যের চরম বিচার কখনও সম্ভব নয়।
কিছুকাল আগে পর্যন্তও আমাদের দেশে ‘রসের বিচার’ তথা আর্টের হিসেবে সাহিত্যের মান নির্ধারিত হত। এক্ষণে অনেকেই ‘ঐতিহাসিক’ তথা বাস্তবতার দিক থেকেই সাহিত্যের মান বিচার করে থাকেন। তাতে আমরা দেখেছি, সাহিত্যেই শুধু জীবনের প্রতিফলন ঘটে না, জীবনেও প্রতিফলন ঘটে সাহিত্যের। ফলত একালের সাহিত্য অর্থাৎ আধুনিক সাহিত্য হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘জীবন-দর্শন’।
খুব সংক্ষেপে এই প্রসঙ্গে আধুনিকতার স্বরূপলক্ষণটিও বলে নেওয়া আবশ্যক। সাহিত্যে যখন ‘যুগধর্ম’ অর্থাৎ ‘পরিবেশের ছাপ’ পাওয়া যায়, তাকেই বলা যায় ‘আধুনিক সাহিত্য’। এই ছাপ পড়ে বিষয়বস্তু এবং প্রকাশ তথা রূপায়ণ—দুদিক থেকেই। বিষয়বস্তুর আবার দুটি দিক–এর কথাবস্তু এবং ভাববস্তু। কথাবস্তু এক থাকা সত্ত্বেও ভাববস্তুর বিচারে প্রাচীন কাহিনীও আধুনিকধর্মী হয়ে উঠতে পারে। যেমন, মহাভারতের কর্ণ-কুন্তী-কাহিনী এবং রবীন্দ্রনাথের ‘কর্ণ-কুন্তী-সংবাদ’—উভয়ের কথাবস্তু প্রায় অভিন্ন হওয়া সত্ত্বেও ভাববস্তুতে কত পার্থক্য। আবার ভিন্ন কথাবস্তুর মধ্যেও ভাবগত ঐক্য থাকা সম্ভব। এই ভাববস্তুই যখন প্রকাশ তথা রূপায়ণের মধ্য দিয়ে সত্য হয়ে ওঠে, তখনই সাহিত্যের যথার্থ মূল্য স্বীকৃত হয়। রূপকলা প্রকাশ পায় সাধারণত রীতি বা স্টাইল, আঙ্গিক বা টেকনিক ও অলঙ্কারাদির সাহায্যে। দেহ এবং মনের বিচিত্র লীলাতে যেমন জীবন, তেমনি ভাববস্তু এবং রুপকলা—উভয়ের যথাযোগ্য সমন্বয়েই প্রকৃত আধুনিক সাহিত্য সৃষ্টি হয়।
এখন প্রশ্ন, সাহিত্যে আধুনিকতা বলতে যে ভাববস্তুর কথা বলা হয়েছে, তার স্বরূপটা কী? মানুষ যখন থেকে বুঝতে শিখেছে যে সে প্রকৃতি থেকে স্বতন্ত্র, তখন তার মধ্যে মানবিক চেতনার যে স্ফুরণ দেখা যায়, তার ক্রমিক বিকাশের মধ্য দিয়েই মানুষের ক্রমোত্তরণ সাধিত হয়েছে, সেই সাহিত্যে মানবিক চেতনার এই স্ফুরণ যত বেশি অধিক প্রকটিত হয়েছে, সেই সাহিত্যকেই আমরা তত বেশি আধুনিক বলে মনে করতে পারি, যে কালেই সেই সাহিত্য রচিত হোক না কেন। মানুষের মর্যাদাবোধের পূর্ণ স্বীকৃতিই আধুনিকতার লক্ষ্য।
কালের বিচারে ভারতীয় সাহিত্য প্রাচীনতর বিবেচিত হলেও আধুনিক জীবনবোধের বিচারে অপেক্ষাকৃত পরবর্তী কালের হয়েও প্রাচীন গ্রীক সাহিত্য যে অগ্রবর্তী ছিল, সে-বিষয়ে সন্দেহের কোন কারণ নেই। লেখক আলোচ্য প্রবন্ধে প্রাচীন ভারতের রামায়ণ থেকেই সর্বপ্রাচীন দৃষ্টান্ত আহরণ করেছেন, যদিও ঋগ্বেদ-আদির রচনাকাল আরও অনেক পূর্ববর্তী। প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যে মানবিক চেতনার প্রকাশ ঘটলেও তা বড়ই অস্ফুট। মানুষ স্বীয় সত্তাকে প্রকৃতি থেকে স্বতন্ত্র বলে জেনেছে, কিন্তু প্রকৃতির নির্ভরশীলতা যেমন ত্যাগ করতে পারেনি, তেমনি নিজের ভাগ্যকে নিজের হাতে গড়ে নেবার মতো সাহসও সঞ্চয় করতে পারেনি। সব সময়ই নিজেকে অপর কোন অলৌকিক শক্তির হাতে তুলে দিয়ে নিজে তার ক্রীড়নক হয়ে রয়েছে। ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষা অবদমিত হয়েছে প্রবলতর কোন অদৃশ্য শক্তির ইঙ্গিতে। এই অদৃষ্ট নিয়তি দ্বারা নিয়ত তাড়িত হবার জন্যই প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যে মানবমূল্য যথার্থ স্বীকৃতির অবকাশ পায়নি। ক্বচিৎ কোন ঘটনা বিদ্যুৎ-দীপ্তির মতো আমাদের দৃষ্টিকে ঝাপসা করে দেয়, আবার বৃহত্তর তমসা এসে সমস্ত আচ্ছন্ন করে রাখে। এবার কয়েকটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা যেতে পারে—অবতার রামচন্দ্র এবং অবতার কৃয়কে আমরা মানবসত্তান-রূপে গ্রহণ করে যথার্থ মানুষের মর্যাদাকে তুলে ধরেছি। এমনকি রামচন্দ্র তাঁর পত্নী সীতাকে বিসর্জন দেবার পর যজ্ঞের প্রয়োজনে স্বর্ণসীতা নির্মাণ করিয়েছিলেন, কিন্তু দ্বিতীয়া স্ত্রী গ্রহণ করেননি, তখন তাঁর ব্যক্তিপ্রেমের জয়গান করি–বিশেষত যখন মনে হয়, তাঁর পিতা দশরথের সাতশত মহিষী ছিল। কিন্তু যখনই দেখি, শম্বুকের শিরশ্ছেদ ঘটিয়ে তার বেদপাঠের অধিকারে হস্তক্ষেপ করেছেন রামচন্দ্র এবং তিনি প্রজার ইচ্ছায়, রাজকর্তব্যানুরোধে স্বকীয় ব্যক্তিপ্রেম জলাঞ্জলি দিয়ে প্রাণপ্রিয়া পত্নী সীতাকে বিসর্জন দিয়েছেন, তখন আর তাঁর দিকে ক্ষমা-সুন্দর দৃষ্টিতে তাকাতে ইচ্ছা হয় না—এখানে মানুষের মর্যাদা অস্বীকৃত। পক্ষান্তরে প্রাচীন গ্রিক সাহিত্যেও মানুষ নিয়তিতাড়িত ছিল, কিন্তু কখনো তার হাতে আত্মসমর্পণ করেনি; তার বিরুদ্ধে লড়াই করে মানুষের মর্যাদাকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তাই প্রাচীন গ্রীক সাহিত্য অপেক্ষাকৃত আধুনিক। প্রাচীন চিনা সাহিত্যেও ইহজীবনই প্রাধান্য পাওয়াতে সেখানেও মানুষের মূল্য স্বীকৃত হয়েছিল।
মধ্যযুগে পৃথিবীর কোন দেশের সাহিত্যই প্রাচীন ঐতিহ্যের ধারাকে আর আধুনিকতার পথে এগিয়ে আনতে পারেনি, বরং সব দেশই আবার যেন পিছিয়ে পড়েছিল। বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগ একান্তভাবেই দেবতা ও ধর্মের মাহাত্ম্য প্রচারের যুগ। কোন কোন মঙ্গলকাব্যে মানুষের কাহিনী, সুখদুঃখ, জীবনযাত্রার কথা বিশ্বস্তভাবে বর্ণিত হলেও সেই মানুষও ছিল দেবতার কৃপানির্ভর—ইউরোপে, চীনদেশেও একই অবস্থা। তবে চতুর্দশ-পঞ্চদশ শতাব্দীর দিকে ইতালিতে বোকাচিও প্রভৃতির রচনায় যে রেনেসাঁসের লক্ষণ দেখা যায়, তার পূর্ণ পরিণত রূপ দেখা যায় পরবর্তী শতাব্দীতে, মধ্যযুগের সমাপ্তি ঘটে তখনই।
ইউরোপীয় রেনেসাঁসের মধ্য দিয়ে আধুনিকতার যে সূচনা, তখনই মানুষের মহিমাবোধের প্রথম উদ্বোধন ঘটে। তারপর ফরাসী বিদ্রোহ আধুনিকতার দ্বিতীয় পর্ব—’মানুষের অধিকারের স্বীকৃতিতে ব্যক্তিসত্তা ও গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা ঘটে। তারই প্রত্যক্ষ প্রভাবে বাংলা সাহিত্যে মধুসূদন-বঙ্কিমচন্দ্র-বিহারীলালের রচনায় সর্বপ্রথম পাওয়া যায় যথার্থ আধুনিকতার স্বাদ। বাংলা সাহিত্যে এই আধুনিকতার আবির্ভাব ও অগ্রগতি ঘটেছে দুর্দমনীয় বেগে। সমগ্র ইউরোপীয় সাহিত্য চারশ বছরে যতখানি এগিয়েছে, বাংলা ১৮৬০-১৯৪০-এই ৮০ বছরে সেই স্থানে এসে দাঁড়িয়েছে। মানুষের মূল্য ও ব্যক্তিত্বের মূল্য আমরা উদাত্তকণ্ঠে ঘোষণা করলেও যে মানুষের ‘বিপ্লবী নিয়তি’ আমাদের সাহিত্যে এখনও বাণীরূপ লাভ করেনি, তা অস্বীকার করা চলে না। ইউরোপের বহু সাহিত্যেও তার স্বাক্ষর এখনও ঝাপসা। কিন্তু তথাকার ইংরেজ-আদি অতি স্থির জাতির চেয়েও আমাদের বিপ্লবী ব্যাকুলতা অধিকতর উগ্র ও উত্তাল বলেই হয়তো তাদের পূর্বেই বাংলা সাহিত্যে বিপ্লবী জাগরণ দেখা দিতে পারে এবং তখনই আমরা পৌঁছুতে পারবো আধুনিকতার তৃতীয় স্তরে। তখনই সাহিত্যে মানুষ ও মানবসত্য প্রাধান্য লাভ করবে এবং এটিই আধুনিকতার মূল বাণী।
Leave a comment