দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (World War-II) পর পৃথিবীর সকল চিন্তাশীল মানুষ অনুভব করেছিলেন কলহের দ্বারা আন্তর্জাতিক বিরােধকে স্থায়ীভাবে দূর করা যাবে না। এই পারস্পরিক কলহ সৃষ্টিকারী সমস্যার স্থায়ী সমাধান কেবলমাত্র বােঝাপড়ার মাধ্যমেই হতে পারে। তাই গঠিত হল আন্তর্জাতিক সংস্থা (UNO)। শান্তিপূর্ণ পরিবেশ, পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সহনশীলতার মনােভাব নিয়ে নিজেদের আলােচনার মধ্য দিয়েই সবরকম সমস্যার সমাধান সম্ভব। বিশ্বশিক্ষা (Global Education) হল জীবনবিকাশের এমন এক চলমান প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক ও কৃষ্টিসম্পন্ন রাষ্ট্রগুলির অন্তর্গত প্রত্যেক মানুষ তার নিজস্ব চাহিদা সঠিকভাবে অনুভব করে, পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্য দিয়ে সামগ্রিক বিশ্বচাহিদা পূরণ করতে সক্ষম হয়।
বিশ্বশিক্ষার উদ্দেশ্যা
কমিশন ইতিপূর্বে বিশ্ব শিক্ষার চারটি স্তম্ভের যে ভিতের কথা বলেছিল, এই উদ্দেশ্যগুলি তারই পুনরাবৃত্তি শুধুমাত্র অন্যমাত্রায়। নিক্নে উদ্দেশ্যগুলি সম্পর্কে আলােকপাত করা হলㅡ
(১) বৈজ্ঞানিক মানবতাবােধ : শিক্ষার প্রথম উদ্দেশ্য হল বৈজ্ঞানিক মানবতাবােধ জাগ্রত করা, মানবীয় বৈশিষ্ট্যগুলিকে ধরে রাখা, মানবতা সম্পর্কে মানুষের মনে যে আদর্শ রয়েছে তাকে বজায় রাখা। বৈজ্ঞানিক মানবতাবাদের মূল বক্তব্য হলো প্রত্যেক মানুষ বস্তুজগৎ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করবে এবং সে তার জ্ঞানের দরুন সক্রিয়তাকে প্রাথমিকভাবে মানুষের সেবার কাজে ব্যবহার করবে। বৈজ্ঞানিক জ্ঞান সকল মানুষের জন্য আবশ্যিক। কমিশনের মতে, শিক্ষার উদ্দেশ্য যদি বৈজ্ঞানিক মানবতাবোধ বিকাশে সহায়তা করে, তাহলে বিভিন্ন রাষ্ট্রে যে ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলিত থাকুক না কেন, তা পৃথিবীব্যাপী পারস্পরিক সম্পর্ক স্থাপনে সহায়তা করবে।
(২) সৃজনধর্মীতা: প্রত্যেক মানুষের মধ্যে দু-ধরনের বিরােধী চাহিদা বর্তমান, যথাক্রমে নিরাপত্তার চাহিদা (Need for Security) ও দুঃসাহসিকতার চাহিদা (Need for Adventure)। প্রথম চাহিদা অনুযায়ী মানুষ আশ্রয় খোঁজে এবং দ্বিতীয় চাহিদা মেটাতে সে কিছু দুঃসাহসিক কাজ করে। এই সৃজনাত্মক ধর্মের জন্য মানুষ তার সক্রিয়তা প্রদর্শন করে যা ভুল বা ঠিক হতে পারে। আন্তর্জাতিক কমিশন-এর মতে, এই মনােবৈজ্ঞানিক নীতিকে অনুসরণ করে তাকে অগ্রমুখী করে তােলা একান্তভাবে প্রয়ােজন। যার ফলে শিক্ষার্থীদের সৃষ্টিধর্মিতা ও নিজস্ব চিন্তা ভাবনা বিকাশ লাভ করবে।
(৩) শ্রদ্ধা ও ভালােবাসা : কোনাে রাষ্ট্র যখন একটি শিক্ষাব্যবস্থার পরিকল্পনা রচনা করে তখন চায় এমন এক ব্যবস্থা যার মাধ্যমে দেশের ভবিষ্যৎ নাগরিক তাদের রাষ্ট্রীয় তথা সামাজিক জীবনের জন্য প্রস্তুত করা যাবে। শুধু প্রথাগত শিক্ষার মাধ্যমে ডিগ্রি অর্জন নয়, উন্নতি ঘটবে তখন, যখন তারা পারস্পরিক দ্বন্দ্বের কারণ উপলব্ধি করে তা নিবারণে সচেষ্ট হবে। তাই বিশ্বশিক্ষার একটি উদ্দেশ্য হল পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে বসবাসকারী মানুষকে তাদের নিজ নিজ বৈশিষ্ট্য, নিজ সুখ, আনন্দ উপলব্ধির মাধ্যমে শ্রদ্ধা ও ভালােবাসাপূর্ণ মানবতাবােধ জাগ্রত করা।
(৪) জীবনব্যাপী শিক্ষা : UNESCO (আন্তর্জাতিক শিক্ষা ও সংস্কৃতি উপসংস্থা)-এর মতে, জীবনব্যাপী শিক্ষা অপর একটি উদ্দেশ্য। শিক্ষা এমন একটি প্রক্রিয়া যা প্রত্যেক মানুষকে তার পরিপূর্ণ বিকাশে সহায়তা করে। শিক্ষালয়ে শিক্ষার্থীকে এমন কিছু জ্ঞান, বৌদ্ধিক ক্ষমতা, দক্ষতা অর্জনের সুযােগ দেওয়া হয়, যেগুলি লাভ করে শিক্ষার্থী একজন আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠে। বিশ্বশিক্ষার উদ্দেশ্য হবে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে তার জীবনকালব্যাপী নিজস্ব প্রতিষ্ঠা স্থাপনে সহায়তা করা।
এই সংক্ষিপ্ত আলােচনা থেকে দেখা যাচ্ছে, কমিশন বলেছে— শিক্ষার বিশ্বায়নের জন্য তার মূল চারটি উদ্দেশ্য থাকা উচিত— বৈজ্ঞানিক মানবতাবােধ, সৃজনধর্মিতা, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার প্রবণতা এবং জীবনব্যাপিতা। পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রগুলি তাদের নিজেদের চাহিদা ও সংহতির কথা চিন্তা করে, নিজস্ব শিক্ষাব্যবস্থার উদ্দেশ্যগুলি স্থির করলেও তাদের নির্বাচিত উদ্দেশ্যগুলির সঙ্গে উল্লিখিত চারটি উদ্দেশ্য থাকা একান্তভাবে বাঞ্ছনীয়। বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ হিসেবে শিক্ষাবিদ, বৈজ্ঞানিক, সাধারণ চিন্তাবিদ, রাজনীতিবিদ এবং প্রযুক্তিবিদ সকলেই যেমন জাতীয় শিক্ষার উদ্দেশ্য নির্ণয়ের ব্যাপারে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করবেন, তেমনি শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকদের এ ব্যাপারে সুযোগ দেওয়া উচিত। একবার সমন্বয়মূলক চিন্তার মাধ্যমে শিক্ষার উদ্দেশ্য স্থিরীকৃত হলে তা রাষ্ট্র তার নিজস্ব সীমিত ক্ষমতার মধ্যেও সফল করে তুলতে পারে।
Leave a comment