বিপরীতমুখী স্বার্থের অস্তিত্বের জন্যই বিত্তবান এবং মেহনতী শ্রেণীগুলির মধ্যে শ্রেণী-সংগ্রাম অবিরাম লেগে থাকে। ‘কমিউনিস্ট ইশতেহারের’ প্রথম এবং প্রধান বক্তব্য হল, “আজ পর্যন্ত যত সমাজ দেখা গেছে তাদের সকলের ইতিহাস হল শ্রেণী-সংগ্রামের ইতিহাস।” এখানে কেবল শ্রেণীবিভক্ত সমাজসমূহের কথা বলা হয়েছে। ফ্রেডারিক এঙ্গেলস বলেছেন: “…all past history, with the exception of primitive conditions, was the history of class-struggles.” শ্রেণীবিভক্ত সকল সমাজ ব্যবস্থাতেই পরস্পর-বিরোধী শ্রেণীর দ্বন্দ্ব পরিলক্ষিত হয়। 

আদিম সাম্যবাদী সমাজ ব্যবস্থা:

আদিম সাম্যবাদী সমাজে ব্যক্তিগত সম্পত্তি ছিল না, তাই কোনরকম শ্রেণীভেদ বা শ্রেণীদ্বন্দ্ব ছিল না। আদিম সাম্যবাদী সমাজে সমাজই ছিল সমগ্র উৎপাদনের মালিক। এই উৎপাদন ছিল সামাজিক উৎপাদন। এই উৎপাদনে সকলের অধিকার ছিল। এবং এই অধিকার ছিল সমান। এই উৎপাদন-ব্যবস্থায় উৎপাদনের উপাদানসমূহের সঙ্গে সকলের এক ও অভিন্ন সম্পর্ক বর্তমান ছিল। এই সময় শোষক শ্রেণী বা শোষিত শ্রেণী বলে কিছু ছিল না। কিন্তু দাস-সমাজ থেকে শুরু করে পরবর্তী পর্যায়ের সকল সমাজই হল শ্রেণীবিভক্ত সমাজ। এই সকল সমাজব্যবস্থায় শ্রেণী-সংঘাত অনিবার্যভাবে অবিরত দেখা দিয়েছে। নতুন উৎপাদন শক্তির সৃষ্টি এবং নতুন উৎপাদন সম্পর্কের আবির্ভাবের পরিপ্রেক্ষিতে আদিম সাম্যবাদী সমাজের বিলুপ্তি ঘটে। তখন থেকেই সমাজ পরস্পর-বিরোধী দুটি শ্রেণীতে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এই দুটি শ্রেণী হল শোষক শ্রেণী ও শোষিত শ্রেণী।

দাস সমাজব্যবস্থা:

দাস-মালিক ও দাস এই দুটি শ্রেণীতে দাস-সমাজ বিভক্ত। দাস-সমাজের ইতিহাস হল শ্রেণী দুটির মধ্যে বিরামবিহীন শ্রেণী-সংগ্রামের ইতিহাস। এখানে দাস-মালিকরা উৎপাদন উপাদানের সঙ্গে ক্রীতদাসদেরও মালিক। দাস-সমাজব্যবস্থায় উৎপাদন উপাদানের সঙ্গে দাস-মালিকদের সম্পর্ক এবং দাসদের সম্পর্ক ছিল পৃথক ও বিপরীত প্রকৃতির। সমাজে উৎপাদনের উপাদানসমূহের উপর দাস-মালিকদের ব্যক্তিগত মালিকানা স্বীকৃত ছিল। তার ফলে এই সময় দাস ও দাস-মালিক এই দুটি শ্রেণীর মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক ছিল বিরোধিতার। মুষ্টিমেয় দাসমালিক দাসদের শ্রম শোষণ করে সম্পদশালী হয়ে উঠল এবং সমাজের বৃহত্তম অংশ দাসদের আর্থনীতিক অবস্থা হল দুর্বিষহ। এর ফলে স্বার্থের সংঘাত ক্রমশঃ তীব্রতর হতে লাগল। এইভাবে শ্রেণী-দ্বন্দ্ব ব্যাপক আকার ধারণ করল। এবং মালিক শ্রেণীর স্বার্থে সমাজের মধ্যে রাষ্ট্র শক্তির সৃষ্টি হল। এই সময় দাসদের উপর দাসমালিকদের শাসন-শোষণ অব্যাহত রাখার হাতিয়ার হিসাবে রাষ্ট্রের আবির্ভাব ঘটে। সুতরাং সমাজ-বিকাশের এই পর্যায়ে একটি শ্রেণীর উপর আর একটি শ্রেণীর শাসন-শোষণ কায়েম করার উদ্দেশ্যেই রাষ্ট্র-যন্ত্র সৃষ্টি করা হয়েছে। দাস-সমাজ ব্যবস্থায় দাস মালিকদের আর্থনীতিক ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা সংরক্ষণ করাই হল রাষ্ট্রের কাজ। প্রচলিত শ্রেণী-শোষণকে অব্যাহত রাখাই হল রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য। দাসদের শোষণ-মুক্তির সংগ্রামকে প্রতিহত করার জন্য এই রাষ্ট্রযন্ত্র সক্রিয় হয়েছে। রোমে স্পর্টাকাসের নেতৃত্বে দাস-বিদ্রোহকে নির্মমভাবে স্তব্ধ করা হয়েছে। দাসমালিকদের শোষণ-পীড়ন থেকে মুক্তির জন্য দাসদের মরণপণ সংগ্রামের বহু নজির মানবজাতির ইতিহাসে বর্তমান।

সামন্ত সমাজব্যবস্থা:

পরবর্তী স্তরের সামন্ত-সমাজ শোষক সামন্ত-প্রভু ও শোষিত ভূমিদাস এই দুটি শ্রেণীতে বিভক্ত। সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় ভূস্বামী ও ভূমিদাসরাই ছিল দুটি মুখ্য শ্রেণী। তবে এই সময় মধ্যবর্তী অনেক শ্রেণী ছিল। ভূমিদাস শ্রেণী দাসদের জায়গায় আবির্ভূত হল। দাস-সমাজের মত সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায়ও উৎপাদন-উপাদানের উপর ব্যক্তিগত মালিকানা স্বীকৃত ছিল। সামন্ত সমাজের উৎপাদন ব্যবস্থায় উৎপাদন-উপকরণের মালিক হল সামন্ত প্রভু। এই সামন্ত প্রভুরাই ভূমিদাসদের অবাধে শোষণ করেছে। সামন্ত প্রভুরা ভূমিদাস ও কৃষকদের শ্রমক্ষমতাকে শোষণ করেছে এবং নিজেদের সম্পদ-সামগ্রীর ভাণ্ডারকে ক্রমশঃ সমৃদ্ধ করেছে। ফলে এখানে এই দুই শ্রেণীর মধ্যে শ্রেণী-দ্বন্দ্ব অবশ্যম্ভাবী। তাই সামস্তযুগের ইতিহাস হল অসংখ্য কৃষক-বিদ্রোহের ইতিহাস। বস্তুত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের এই অধ্যায়ের ইতিহাসে কৃষক-বিদ্রোহের অসংখ্য নজির বর্তমান। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে চতুর্দশ শতাব্দীতে ফ্রান্স ও ইংল্যাণ্ডের কৃষক বিদ্রোহ এবং ষোড়শ শতাব্দীর জার্মানীর কৃষক বিদ্রোহ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

সামত্ত সমাজে নতুন নতুন যন্ত্রপাতি আবিষ্কৃত হয়। কলকারখানার বিকাশ ও বিস্তার ঘটে। ব্যবসা বাণিজ্য সম্প্রসারিত হয়। অর্থাৎ উৎপাদন শক্তি বিকশিত ও উন্নত হয়। তখন সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্কের সঙ্গে তার বিরোধ বাধে। বুর্জোয়ারা উন্নত উৎপাদন শক্তির বিকাশ সাধন এবং নতুন উৎপাদন সম্পর্ক সৃষ্টির ব্যাপারে উদ্যোগী হয়। তখন কলকারখানার মালিকদের সঙ্গে সামন্ত প্রভুদের সংঘাত অনিবার্য হয়ে পড়ে।

ধনতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা:

বর্তমান ধনতান্ত্রিক সমাজও শিল্পপতি ও শ্রমিকশ্রেণী বা বুর্জোয়া ও সর্বহারা এই দুটি শ্রেণীতে বিভক্ত। এখানে উৎপাদন উপাদানের মালিক শিল্পপতি-শ্রেণী নিজেদের শ্রেণীস্বার্থে শ্রমিক শ্রেণীকে শোষণ করে। এই পর্যায়ে শোষণের প্রকৃতি হল শ্রমিকশ্রেণীর দ্বারা সৃষ্ট উদ্ভুত্ত-মূল্য আত্মসাৎ করা। সেইজন্য এখানে পুঁজিপতি এবং সর্বহারা শ্রমিকশ্রেণীর মধ্যে শ্রেণী-সংগ্রাম দেখা দেয়। এখানে সমাজ বুর্জোয়া এবং মেহনতী শ্রেণী এই দুটি পরস্পরবিরোধী শ্রেণীতে বিভক্ত। বুর্জোয়াদের শোষণ যতই বলাহীন হয় শ্রমিক শ্রেণীর শোষণমুক্তির সংগ্রাম ততই কঠিনতর হয়। ক্রমে সংগঠিত সর্বহারা শ্রেণী রাষ্ট্রশক্তি দখল করার রাজনৈতিক সংগ্রামের সামিল হয়। এই রাজনৈতিক সংগ্রাম অবশেষে সশস্ত্র সংগ্রামে পরিণত হয়।

আর্থনীতিক, রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত শ্রেণীসংগ্রাম:

শ্রেণী-সংগ্রাম আর্থনীতিক, রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত হয়ে থাকে। আর্থনীতিক সংগ্রাম ব্যক্ত হয় মজুরী বৃদ্ধি, কাজের উন্নত পরিবেশ প্রভৃতির জন্য মিছিল, ধর্মঘট ইত্যাদির মাধ্যমে। তবে, লেনিনের মতানুসারে, আর্থনীতিক সংগ্রামকে প্রধান ও একমাত্র সংগ্রাম হিসাবে গণ্য করা ঠিক নয়। মার্কসের মতানুসারে শ্রেণী-সংগ্রাম মাত্রই হল রাজনৈতিক সংগ্রাম। তিনি বলেছেন: “Every class-struggle is a political struggle.” সর্বহারার সংগ্রামের প্রধান রূপ হল রাজনৈতিক সংগ্রাম। শ্রমিক শ্রেণী রাজনীতিক সংগ্রামের পথে বুর্জোয়া শ্রেণীর কাছ থেকে ক্ষমতা দখল করতে পারে। আবার মতাদর্শগত সংগ্রামও রাজনৈতিক সংগ্রামের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত। কারণ সর্বহারা শ্রেণীর কর্তব্য হল বৈপ্লবিক পরিস্থিতিতে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করা। এই সর্বহারা শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যে শ্ৰেণী-সচেতনতা সৃষ্টি, বুর্জোয়া মতাদর্শের বিরোধিতা, সংকীর্ণতা ও সংশোধনবাদিতা পরিহার এবং সর্বহারার বিশ্ব-দৃষ্টিবোধ সৃষ্টির জন্য মতাদর্শগত সংগ্রাম অপরিহার্য।

সর্বহারার একনায়কত্ব:

এই সংগ্রামের ফলে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার পতন ঘটে; সম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানা, শ্রেণীশোষণ প্রভৃতির অবসান হয় এবং সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়। সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্বের প্রতিষ্ঠাই হল শ্রেণী-সংগ্রামের চূড়ান্ত ও সার্থক পরিণতি। আগের শোষণমূলক রাষ্ট্রযন্ত্রের ধ্বংস সাধন এবং শ্রমিকশ্রেণীর নিজস্ব শ্রেণীহীন, শোষণহীন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন অপরিহার্য। শ্রেণী সংগ্রাম অবশ্যই সর্বহারার একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করবে’—মার্কস এই সত্যের নির্দেশ দিয়েছেন।

বুর্জোয়া ঐতিহাসিকরাও শ্রেণী-সংগ্রামের ঐতিহাসিক বিকাশ সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। শ্রেণী-সংগ্রামের ধারণা মার্কসের আবিষ্কার নয়। মার্কস নিজেই তা স্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন: “Long before me bourgeois historians had described the historical development of this class-struggle.” কিন্তু বুর্জোয়া তাত্ত্বিকরা এই সত্য স্বীকার করেন নি যে, ‘শ্রেণী-সংগ্রাম অবশ্যম্ভাবী রূপে সর্বহারার একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করবে।’

সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র-ব্যবস্থায় সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্বে সমাজতান্ত্রিক গঠনকার্য পরিচালিত হতে থাকে। এখানে উৎপাদন-উপকরণের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের বৈষম্য বিলুপ্ত হয়। উৎপাদন সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোন পরস্পর-বিরোধী শ্রেণী-স্বার্থ থাকে না। সম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানার অবসান ঘটায় মানুষের দ্বারা মানুষের শোষণেরও সমাপ্তি ঘটে। এইভাবে শ্রেণীভেদ, শ্রেণীশোষণ ও শ্রেণী-দ্বন্দ্বের অবসানের মাধ্যমে সাম্যবাদী সমাজের সৃষ্টি হয়। এই হল সমাজ বিপ্লব বা শ্রেণী-সংগ্রামের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।