প্রশ্নঃ বিবর্তনবাদ কী? এ প্রসঙ্গে হার্বাট স্পেন্সারের যান্ত্রিক বিবর্তনবাদ ব্যাখ্যা কর।

অথবা, বিবর্তনবাদ বলতে কী বুঝ? এ প্রসঙ্গে হার্বাট স্পেন্সারের যান্ত্রিক বিবর্তনবাদ আলােচনা কর।

ভূমিকাঃ জগৎ উৎপত্তির ইতিহাস আলােচনা করে দেখা যায় যে, বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক চিন্তার শ্রেষ্ঠ ফসল হিসেবে বিবর্তনবাদই একটি অধিকতর গ্রহণযােগ্য মতবাদ হিসেবে স্থান লাভ করেছে। বিবর্তনবাদের প্রকৃতি অর্থাৎ জগতের এই বিবর্তন প্রক্রিয়া কি উদ্দেশ্য দ্বারা পরিচালিত নাকি লক্ষ্যহীন স্বতঃস্ফূর্তভাবে জগতের বিবর্তন ঘটছে এ নিয়ে দর্শনে বিভিন্ন মতের সৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে যান্ত্রিক মতবাদ তথা যান্ত্রিক বিবর্তনবাদ অন্যতম।

বিবর্তনবাদের সংজ্ঞাঃ যা অপ্রকাশিত ও প্রচ্ছন্ন তার প্রকাশ ও সুশৃঙ্খল রূপকে বিবর্তন বলে। যা অপ্রকাশিত ও প্ৰচ্ছন তা দীর্ঘদিন ধরে ধীরে ও সুশৃঙ্খল ক্রমপরিবর্তনের মাধ্যমে প্রকাশিত ও প্রকট হয়। বিবর্তনবাদাদের মতে, এ জগতের প্রতিটি বস্তু সরল ও সাধারণ অবস্থা থেকে ক্রমপরিবর্তমানের মাধ্যমে জটিল থেকে জটিলতর অবস্থার মধ্যদিয়ে বর্তমান অবস্থায় এসে উপনীত হয়েছে। বর্তমান জগতের প্রতিটি বস্তই ক্রমপরিবর্তন বা বিবর্তনের ফলে। প্রতিটি বস্তুরই রয়েছে দীর্ঘ ক্রমবিবর্তনের ইতিহাস। পরিবর্তনই হলাে বিবর্তনের মূলকথা। তবে এই বিবর্তন বিশৃঙ্খলা নয় বরং শৃঙ্খলাপূর্ণ। সুতরাং বলা যায়, “যখন কোনাে বস্ত শৃঙ্খলাপূর্ণ পরিবর্তনের মাধ্যমে একটি সহজ সরল অবস্থা থেকে জটিল অবস্থায় এসে উপনীত হয় তখন তাকে বিবর্তন বলে। ধারাবাহিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে অব্যক্ত অস্ফুট শক্তির ব্যক্ত ও পরিস্ফুট হওয়ার নামই বিবর্তন।

প্রামান্য সংজ্ঞাঃ অধ্যাপক এ.মতিন তার, ‘An outline of philosophy’ গ্রন্থে বলেন, “বিবর্তনবাদ অনুসারে জগত এবং জাগতিক যাবতীয় বস্তুর ধারাবাহিক পরিবর্তনের ফল।

বিবর্তনবাদীদের মতানুসারে, “বিবর্তন মানে সরল থেকে যৌগিক, বিশৃঙ্খল থেকে সুশৃঙ্খল, অনুন্নত থেকে উন্নত এবং বিষমতাত্ত্বিক থেকে সমতাত্ত্বিক অবস্থার ক্রমিক বিকাশ বা উত্তরণ।

বস্তুত বলা যায় যে, যা অব্যক্ত বা অপ্রকাশিত যার ধীর পরিবর্তিতনের মাধ্যমে তার ক্রমবিকাশকেই বলা হয় বিবর্তন।

হার্বাট স্পেন্সরের যান্ত্রিক বিবর্তনবাদঃ হার্বাট স্পেন্সারের যান্ত্রিক বিবর্তনবাদ জানার পূর্বে আমাদের জানা দরকার যান্ত্রিক বিবর্তনবাদটা আসলে কী?

যান্ত্রিক বিবর্তনবাদঃ যে মতবাদ অনুসারে জগতের বিবর্তন প্রক্রিয়া প্রাকৃতিক নিয়মে জড় পদার্থের দ্বারা যন্ত্রের মত এগিয়ে চলছে এবং যার গতি-প্রকৃতি ও অভিযাত্রার পেছনে কোনাে লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য নেই তাকে যান্ত্রিক বিবর্তনবাদ বলে। যান্ত্রিক বিবর্তনবাদ যান্ত্রিক কার্যকারণ নিয়মের ওপর প্রতিষ্ঠিত। যান্ত্রিক বিবর্তনবাদীরা জড়, গতি, শক্তিপ্রকৃতি দ্বারা জাগতিক বস্তুর ক্রমবিবর্তন ব্যাখ্যা করে। তাদের মতে জড়ই জগতের আদি উপাদান। এ জড় পরমাণুর গতিশক্তি হলাে আকর্ষণ ও বিকর্ষণ গতিশক্তি। এ আকর্ষণ ও বিকর্ষণ শক্তির ফলে জড় পরমাণুসমূহ পরস্পর মিলিত হয় ও পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়। এভাবে যােজন বিয়ােজনের মাধ্যমে জাগতিক সমুদয় বস্তুর প্রাণ ও মনের সৃষ্টি হয়েছে। এই প্রাণ ও মন জড়ের জটিলতম রূপ। এ জগতের সবকিছু যান্ত্রিক নিয়মের অধীন। দার্শনিক এম্পিডক্লিস ডেমােক্রিটস, টিন্ডল, হাক্সালি, ল্যাপলাস, স্পেন্সার প্রমূখ যান্ত্রিক বিবর্তনবাদের একনিষ্ঠ সমর্থক। নিম্নে হার্বাট স্পেন্সারের যান্ত্রিক বিবর্তনবাদ সম্পর্কে আলােচনা করা হলাে-

(১) ঐক্যবিধান, পৃথকীকরণ ও নিয়মানুগত্যঃ হার্বাট স্পেনসার বিবর্তনের পেছনে ঐক্যবিধান পৃথকীকরণ ও নিয়মানুগত্য এই তিনটি মূলনীতিকে স্বীকার করে। এ মতবাদ অনুসারে ঐক্যবিধান নিয়মের ফলে পৃথিবীতে জীবকোষ ও প্রাণের উদ্ভব সম্ভব হয়েছে। সৃষ্টি হয়েছে গােটা নক্ষত্র জগতের। পৃথকীকরণ নিয়মের ফলে জীবকোষের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের এবংনক্ষত্র জগত থেকে কিছু বিচ্ছিন্ন অংশ খসে পড়ে সষ্টি হয়েছে তারকারাজীসহ বিভিন্ন গ্রহ-উপগ্রহের। আর নিয়ন্ত্রণ বা নিয়মানুগত্য প্রক্রিয়ার ফলে বিশ্বজগত একটি নিয়মের রাজতের মধ্যদিয়ে চলে এবং জড়জগত ও জীবজগতের অগ্রগতি একটি অর্নিদিষ্ট বা অসংবদ্ধ অবস্থা থেকে একটা নির্দিষ্ট বা সুসংবদ্ধ অবস্থার দিকে পরিচালিত হয়।

(২) জড়, গতি, ও শক্তিঃ হার্বাট স্পেন্সর জড়, গতি ও শক্তিকে এক অজ্ঞাত শক্তির প্রকাশ বলে ধরে নিয়ে তা থেকেই বিশ্বজগতের আলােচনা শুরু করেন। প্রাথমিক অবস্থায় এ জড়, গতি ও শক্তি ছিল অসংবদ্ধ এবং নীহারিকাপুঞ্জ ছিল বিশৃংখল। ঐক্য বিধান নিয়মের ফলে এই অসংবদ্ধ নিহারিকা পুঞ্জ বা ঝুলন্ত গ্যাস বা বিক্ষিপ্ত মেঘের ধূলিকণা থেকে। সৃষ্টি হলাে সূর্যসহ গোটা নক্ষত্র জগতের। নক্ষত্ৰজগত সৃষ্টির পর তাদের ঘনীভূত সত্তা থেকে হঠাৎ করে পৃথকীকরণ নিয়ম। অনুযায়ী কিছু কিছু অংশ খসে পড়ে। এ বিচ্ছিন্ন অংশগুলােই এখন বিভিন্ন গ্রহ-উপগ্রহ নামে পরিচিত।

(২) প্রাণের আবির্ভাবঃ আমাদের এ পৃথিবী গ্রহটার জন্মের পর বহুবছর কেটে গেছে। এ সময়ের মধ্যে প্রথমে তার উপরিভাগ, ঘনীভূত হয়েছে তারপর আস্তে আস্তে তাতে আবির্ভাব ঘটেছে বাতাস, পানি, নদীনালা ইত্যাদির। আর সর্বশেষে আক্সিজেন, হাইড্রোজেন ইত্যাদি রাসায়নিক দ্রব্যের ঐক্যবিধানের ও সংমিশ্রণের ফলে পৃথিবীতে জীবকোষ ও প্রাণের অস্তিত্ব সম্ভব হয়েছে। এ জীবকোষে পৃথকীকরণ নিয়মের মাধ্যমে জীবকোষের মাঝে সৃষ্টি হয়েছে বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গের এবং এর ফলে সম্ভব হয়েছে পৃথিবীতে পূর্ণাঙ্গ প্রাণির অস্তিত্ব লাভ।

সমাজ বিবর্তনঃ হার্বাট স্পেন্সার মানব সমাজ বিবর্তনের ব্যাখ্যাও দিয়েছেন যান্ত্রিকভাবে। ঐক্যবিধান ও পৃথকীকরণ নীতি এখানেও কাজ করছে একই নিয়মে, ঐক্যবিধান নীতির ফলে মানুষ সমাজ গড়ে তুলেছে। আবার পৃথকীকরণ নিয়মের অনুসরণ করে সে সমাজকে ভেঙ্গে কাজের শ্রেণিবিভাগ অনুযায়ী গড়ে তুলেছে বিভিন্ন গােষ্ঠী ও জাতি।

সমালােচনাঃ জড়বাদ ও নিসর্গবাদের ওপর ভিত্তি করে প্রদত্ত হওয়াই যান্ত্রিক বিবর্তনবাদের মধ্যে জড়বাদী ভ্রান্তিসমূহ ক্রিয়শীল। নিম্নে এ মতবাদের ত্রুটিসমূহ উল্লেখ করা হলাে-

প্রথমতঃ যান্ত্রিক বিবর্তনবাদ প্রাণ ও মনের যে ভাষ্য প্রদান করে তা মেনে নিলে ইচ্ছার স্বাধীনতা, নৈতিকতা বা বংশবৃদ্ধি ক্ষমতা ইত্যাদি বৈশিষ্ট্য অর্থহীন হয়ে পড়ে।

দ্বিতীয়তঃ যান্ত্রিক বিবর্তনবাদ কার্যকরণভিত্তিক মতবাদ। কিন্তু সাম্প্রতিক হাইজেনবার্গের “পদার্থের অনিশ্চয়তা নীতি” কিংবা “কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যা” কার্যকরণ নিয়মকে ভ্রান্ত প্রমাণ করেছে।

তৃতীয়তঃ স্পেনাসারের মতে, জড় শক্তি যান্ত্রিক শক্তিতে ক্রিয়া করে জগত সৃষ্টি করেছে। কিন্তু কীভাবে একটি অন্ধ যান্ত্রিক প্রক্রিয়া নিখুঁতভাবে এ সুন্দর বৈচিত্র্যময় জগত সৃষ্টি করতে পারে তার কোনাে সদুত্তর স্পেন্সারের বিবর্তনবাদে নেই।

চতুর্থতঃ যান্ত্রিক বিবর্তনবাদীরা মনে করেন জড় থেকে প্রাণের উদ্ভব হয়েছে। কিন্তু কীভাবে তা হয়েছে তার সন্তোষজনক ব্যাখ্যা তারা দিতে পারেনি।

পঞ্চমতঃ হার্বাট স্পেন্সার জড়, গতি ও শক্তিকে এক অজ্ঞেয় পরমসত্তার বিভিন্ন প্রকাশ বলে ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু পরমসত্তা যদি অজ্ঞেয় হয় তবে জড়, গতি, শক্তি যে পরম সত্তার বিভিন্ন প্রকাশ তা তিনি কীভাবে জানলেন?

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায়, বিবর্তন বা বিবর্তন প্রক্রিয়ার যান্ত্রিক ব্যাখ্যা বিভিন্নভাবে সামালােচিত হলেও জগতের উৎপত্তি সম্পর্কে যান্ত্রিক বিবর্তনবাদ একটি গুরুত্বপূর্ণ মতবাদ। মূলত যান্ত্রিক বিবর্তনবাদ জগতের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশে একটি বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা প্রদান করে, যা বর্তমান আধুনিক বিজ্ঞানের সাথে অনেকাংশে সামঞ্জস্যপূর্ণ।