ধনবিজ্ঞানের একটি প্রাথমিক সিদ্ধান্ত এই পরিকল্পনার মধ্যে নিহিত আছে। বিনিময়ের হারের সঙ্গে আর্থিক প্রগতির সম্পর্ক অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। বিনিয়োগের পরিমাণ যত উন্নত হবে তত কোনো দেশের প্রগতির হারও উন্নত হবে। বিনিয়োগের হার বেশি বলেই চিন-জাপান-সোভিয়েত ইউনিয়নের আর্থিক প্রগতি উন্নততর, বিনিয়োগের অঙ্ক কম বলেই আমাদের অর্থনৈতিক প্রগতির হার কম। কিন্তু এর পরের কথা হচ্ছে, বিনিয়োগ দিয়ে যদি ব্যায়ের নির্বাচনী দিকটা যথাযথ না হয়, তাহলে যদি তা ইস্পাত-যন্ত্রপাতি-সড়ক বন্দর-বিদ্যুৎ-সেচনে ব্যয়িত হয়, নিত্য প্রয়োজনীয় চাহিদা মিটিয়ে যদি তা নিঃশেষ হয়, তাহলে প্রগতি ক্ষুণ্ন হয়। এ ব্যাপারে সোভিয়েত পরিকল্পনা একটা নতুন সূত্র এনে দিয়েছিল। বিনিয়োগের হার যত ইচ্ছা বাড়িয়ে যাও উৎপাদন-উপকরণ-ক্রিয়ার্থে নিয়োগ করো। কিন্তু ভোগ্যপণ্য কিনে বিনিয়োগ নষ্ট কোরো না। প্রথম দিকে অশনে-বসনে যথেচ্ছ ব্যয় না করে, তা প্রয়োজনীয় উৎপাদন বৃদ্ধিতে ব্যয় করো, তাহলে আখেরে লাভ হবে। সোভিয়েত ইউনিয়নের এই আদর্শের হয় তো সমসমায়িক কারণও ছিল, কিন্তু বিনিয়োগ সম্পর্কে এই কৃচ্ছতা করে শিল্প-উৎপাদনে ফল পেলে ও কৃষিক্ষেত্রে তারাও ও ভুল করেছিল। কৃষি বিনিয়োগ নিয়ে বিশেষ মনোযোগ দেয়নি। কৃষিকর্মের মোড় ফেরাবার জন্য প্রধানত জোর দেওয়া হয়েছিল বিদ্যুৎ সরবরাহ ও ট্রাক্টর নির্মাণের ওপর। কিন্তু রাষ্ট্র সার তৈরি বা উন্নত বীজ শস্য সংগ্রহে অবহেলা করেছে। এর ফলে কৃষি উৎপাদন কমেছে। এর থেকে শিক্ষা নিয়েছে চিন। চিনের সঙ্গে ভারতবর্ষের অবস্থার সাদৃশ্য আছে যথেষ্ট।

বিনিয়োগের ও প্রগতির তত্ত্ব আমাদের দেশের কৃষি ব্যবস্থায় বিশাল প্রভাব ফেলেছে। লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি বৈজ্ঞানিক, তথ্য সন্ধানীর ও সাহিত্যকের। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি সম্বন্ধে লেখক প্রথমেই বলেছেন “অনুভূতি এবং অভিজ্ঞতা মিলিয়ে বিজ্ঞান।” বিনিয়োগের ব্যাপারে সোভিয়েত রাশিয়ার ব্যাপক প্রগতিকে লেখক সাধুবাদ জানিয়েছেন। আর ভারতের সে ব্যাপারে নিকৃষ্টতম। প্রধানত ভারত সম্পর্কে লেখকের নির্মোহ দৃষ্টি ভারতের আর্থিক প্রগতির ধীর গতিকে সাহায্য করেছে, এ বিষয়েও মন্তব্য দ্বিধাহীন। তবে লেখকের যুক্তিবাদী মন দিয়ে বিচার করে দেখেছেন, বিনিয়োগের কত অংশ ইস্পাত যন্ত্রপাতি সড়ক, বন্দর, বিদ্যুৎ সেচনে ব্যয়িত হবে, কত অংশ নিত্যকার তাৎক্ষণিক চাহিদার ইন্ধন মেটাতে ব্যয়িত হবে, তা নিয়ে সে সৃষ্ট অঙ্ক আছে তা থেকে শিক্ষা নিতে হবে।

লেখক লিখেছেন “বিনিয়োগের পরিমাণ বেশি বলেই পূর্ব ইউরোপ, চিনে-জাপানে জাতীয় উপার্জন, বৃদ্ধির হার উপলগতি।” জাতীয় আয় যত ঊর্ধ্বগতি হয়, ততই দেশের আর্থিক প্রগতি সূচিত হয়। ভারতবর্ষে বিনিয়োগের হার কম বলে এখানে “প্রগতির বেগ স্তিমিত”। ভারতবর্ষে আর্থিক পরিকল্পনা ১৯৫১ সাল থেকে শুরু হয়েছে। কিন্তু এই বারো তেরো বছরে কৃষির ব্যাপারে ভারতীয়রা তেমন অগ্রসর হতে পারেনি। গত দু-তিন বছরে কৃষি উৎপাদন আদৌ বাড়েনি। ১৯৫১ সালের তুলনায় কৃষি উৎপাদন হয়তো শতকরা তিরিশ ভাগ বেড়েছে। কিন্তু ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপে তার উপযোগিতা খুব একটা আশা ব্যঞ্জক নয়। কৃষি প্রণালীর উৎকর্ষ নয়, কেবলমাত্র অবাদি জমির পরিমাণ হারিয়ে শস্য ভাণ্ডার বাড়ানো হয়েছে। স্বাধীনতার পর ভারতে খাদ্যশস্যের ঘাটতি ছিল চাহিদার শতকরা পাঁচ ভাগ পরিমাণ। তারপর অনেক আন্দোলন হয়েছে। তবে লেখক বলেছেন লোকে যদি ভোগ্য সামগ্রী ক্রয় করে বিনিয়োগের একটা অংশ ব্যয় করে তবে তা ভ্রান্ত পথ হবে। সোভিয়েত রাশিয়া অন্তত ওইদিক থেকে একটা নতুন পথ দেখিয়েছে। “প্রথম দিকে কৃচ্ছসাধন করো, অন্তিমে অপরূপ ফল পাবে।” দেশবাসীর এই কষ্ট স্বীকার থেকেই উৎপাদনের জোয়ার আসে এবং যন্ত্রপাতি থেকে আরও যন্ত্রপাতি বা উৎপাদন উপকরণ কিনে দেশের কর্তৃপক্ষ যথেষ্ট ভবিষ্যৎ দৃষ্টির পরিচয় দিয়েছেন। লেখক সে এই দিকটাকে গুরুত্বপূর্ণ সহকারে তুলে ধরেছেন তাতে তার বৈজ্ঞানিক ও যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি প্রমাণিত।

লেখক সোভিয়েত, চিন ও ভারতের তুলনামূলক আলোচনা করেছেন। তাঁর দৃষ্টির মূল লক্ষ্য ভারতের কৃষিব্যবস্থা ও আর্থিক প্রগতি। ১৯৫১ সাল থেকে বারো তেরো বছরে কৃষি উৎপাদন তেমন বাড়েনি। জনসংখ্যা যথেষ্ট বেড়েছে। তাই লেখকের আলোচনায় সাধারণ হিসেব দিয়ে ভারতের আর্থিক অগ্রগতির শোচনীয়তা দেখিয়েছেন। এক্ষেত্রে লেখকের দৃষ্টিভঙ্গিতে বিজ্ঞান ও অনুভূতি দুইই আছে। লেখক কৃষিসম্পদের গুরুত্বকে স্বীকার করেছেন গভীরভাবে, এক্ষেত্রে তাঁর প্রকাশভঙ্গি সাহিত্য ধর্মী। “সোনার কাঠি রুপোর কাঠি সব কিছুই তাই কৃষিসম্পদ। এই সোনার কাঠি রূপোর কাঠি এখনো সেহেতু ধরা ছোয়ার বাইরে। আমাদের পরিকল্পনার ব্যর্থতা সর্বত্র এক অপ্রচ্ছন্ন শৈবাল্যের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পাচ্ছে। এই নৈরাশ্যকে লেখক উৎকণ্ঠা বলে বর্ণনা করেছেন এবং এক্ষেত্রে লেখক ইতিবাচক বিশ্লেষণ করেছেন। “উদ্বেগ থেকে প্রশ্নের উৎস, আত্মবিশ্লেষণের আরম্ভ।” লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি সমালোচনামূলক ও ইতিবাচক। তিনি স্বীকার করেছেন যে বারো-তোরো বছরে তিন হাজারকোটি টাকা কৃষি সম্প্রসারণে বিনিয়োগ করা হয়েছে। এই বিনিয়োগের আর্থিক পরিমাণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এসেছে অকৃষিজীবীদের কাছ থেকে। “কৃষকদের ওপর করের শাস্তি দেওয়া হয়নি। এই ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি সমস্যাকে বুঝতে সাহায্য করেছে। লেখক যুক্তিসংগত ভাবে একথা বুঝিয়েছেন যে রাষ্ট্র কর্তৃক সেচের জল বাড়াবার, উন্নত কৃষিপ্রণালী শেখাবার, শস্যের উচিত মূল্য বজায় রাখবার, উন্নত বাজশস্য এবং উৎকৃষ্ট সার পৌঁছবার নানা ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবু কৃষিতে ব্যাপ্তি আসছে না কেন? এ প্রশ্নের ও লেখক সঠিক উত্তর দিয়েছেন। সন্দেহ না হয়েই পারে না আমাদের সমস্ত ব্যবস্থায় কোথাও একটা মস্ত ফাঁকি থেকে যাচ্ছে। গ্রামোন্নয়নের গঠন প্রণালীতে কোনো অবহেলা প্রবেশ করেছে।” এই সত্য সন্ধান লেখকের গবেষক মনের ফলশ্রুতি।

তবে বলা যায় সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ ভুল করেছিল কৃষির জন্য প্রয়োজানাযুগ বিনিয়োগ হিসাবে। কৃষিকর্মের মোড় ফেরাতে তারা ট্রাকটর শিল্পে এবং তৈরিতে জোর দিয়েছিল। বিদ্যুৎ সরবরাহে নজর দিয়েছিল, ট্রাকটর শিল্পে ব্যয় করেছিল প্রচুর সে তুলনায় ভারতে তার সিকিভাগও করা হয়নি। মূলত তাদের ফাঁকির পরিমাণ বেশি থাকার জন্য এবং আর্থিক শক্তি দুর্বল থাকার জন্য। তবে জাপান, চিন প্রভৃতি দেশের বিনিয়োগের ফলে সাফল্যের রাস্তা দেখে পরবর্তীকালে ভারত কিছু জ্ঞান সঞ্চয় করেছিল এবং সে জ্ঞান কৃষিকাজ ছাড়াও অন্যান্য কাজে প্রয়োগ ঘটিয়েছিল।