কোনো কোনো সমালোচকের মতে নজরুল ইসলাম তাঁর ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় সর্বত্র যে বিদ্রোহী শক্তির জয়গান করেছেন তার সঙ্গে কবিতার ষষ্ঠ স্তবক সঙ্গতি রক্ষা করতে পারেনি- এ সম্বন্ধে তোমার মতামত দাও।
“আমি অভিমানী চির-ক্ষুদ্ধ হিয়ার কাতরতা, ব্যথা সুনিবিড়
চিত চুম্বন-চোর কম্পন আমি থর-থর-থর প্রথম পরশ কুমারীর।
আমি গোপন প্রিয়ার চকিত চাহনি, ছল করে দেখা অনুখণ,
আমি চপল মেয়ের ভালোবাস তার কাঁকন চুড়ির কন-কন্।”
—এই পক্তিগুলিতে কবির বক্তব্য কী? কবির এই মনোভাব কী জাতীয়? কবিতার সমগ্র বিদ্রোহের সঙ্গে এর মিল আছে কি? না থাকলে এর সম্ভাব্য কারণ কী?
কবি নজরুল ইসলাম তাঁর ‘অগ্নিবীণা’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত ‘বিদ্রোহী’ নামক কবিতায় জনজাগরণের যে বিদ্রোহ স্ফুলিঙ্গ সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন, অগণিত মুগ্ধ পাঠক সেজন্য তাঁকে অবিচলিত শ্রদ্ধার আসনে রেখে দেবে। এই কবিতায় একদিকে তিনি তাঁর ধ্বংসের সুবিশাল শক্তির পরিচয় দিয়েছেন, অন্যদিকে রেখেছেন তাঁর শুভবোধের এবং মঙ্গলচিস্তার পরিচয়। কিন্তু এই দীর্ঘ কবিতার একটি স্তবকে কবির সুর আপাতভাবে একেবারেই স্বতন্ত্র মনে হয়, সেটি কবিতার ষষ্ঠ স্তবক।
কবি এই কবিতার অন্যত্র যে ক্বচিৎ কোথাও রোমান্টিক হয়ে পড়েন নি এমন নয়—কবি নিজেকে ‘নৃত্য-পাগল ছন্দের’ সঙ্গে তুলনা করেছেন, নিজের চঞ্চল চিত্তকে তিনি এইভাবে উপমিত করেছেন—
“আমি চল-চঞ্চল, ঠমকি’ ছমকি’
পথে যেতে যেতে চকিতে চমকি’
ফিং দিয়া দিই তিন দোল্ ।”
কিংবা নিজের উচ্ছলতা প্রসঙ্গে কবি বলেছেন—
“আমি উচ্ছুল জল ছল ছল,
চল-উর্মির হিন্দোলদ্যোল্।”
কিন্তু এই ষষ্ঠ স্তবকের মতো সামগ্রিকভাবে রোমান্টিক মনোভাব এই কবিতার অন্যত্র দেখা যায়নি। কবি এই স্তবকের সূচনায় বলেছেন, তিনি যেন কুমারী মেয়ের এলায়িত বেণী, যেন তিনি তরুণীর চোখে ক্রোধের অনল। কিন্তু ক্রোধের কবি যদি সত্যই ফোটাতে চাইতেন তবে কুমারী মেয়ের বেণীর চেয়ে যাজ্ঞসেনী দ্রৌপদীর অপমানিত মুক্ত-বেণীর কথাই কবি চিন্তা করতেন। সুতরাং এই স্তকের প্রথম পক্তি থেকেই কবি নিজের রোমান্টিক বৃত্তির পরিচয় দিয়েছেন। তার পরই তিনি বলেছেন, তিনি বয়ঃসন্ধিকালের মেয়ে অর্থাৎ ষোড়শীর হৃদয় মথিত উন্মত্ত প্রেম।
এর পরবর্তী কয়েকটি পঙ্ক্তিতে কবি দুঃখের আন্তরিক জ্বালার সঙ্গে নিজের অভিন্নতা কল্পনা করেছেন, কিন্তু সেখানেও তাঁর কল্পনা ও প্রকাশভঙ্গীতে রোমান্টিক মনোবৃত্তি চাপা পড়েনি। কবি নিজেকে উদাসী চিত্তের ঔদাস্যের সঙ্গে তুলনা করেছেন, বিধবার বুকের চাপা ক্রন্ধন-শ্বাসের সঙ্গে তুলনা করেছেন, হুতাশের মনের দহন-জ্বালার সঙ্গেও অভিন্নতা কল্পনা করেছেন নিজের। পথবাসী পথিকের গৃহ হারানোর যে জ্বালার কথা তিনি বলেছেন, বাভঙ্গীতে তার রোমান্টিক আকুতিই প্রবল হয়ে ওঠে, অপমানিতের মর্মবেদনাতেও ততটা জ্বালা ফোটাতে কবির যে উৎসাহ নেই—সেকথা সহজেই বোঝা যায়। কিন্তু শেষের চারটি পক্তিতে কবি চূড়ান্তভাবে রোমান্টিক। কবি এখানে অভিমানী মনের কাতরতার সঙ্গে নিজেকে তুলনা করলেও অভিমানের প্রকৃতি আমাদের কাছে রোমান্টিক বলেই মনে হয়। কবি পরক্ষণেই যেন ভাবপ্রবণতায় বিহ্বল হয়ে বলেন, তিনি কুমারী মেয়ের প্রথম স্পর্শ—যে স্পর্শে হৃদয় চুরি যায়, যে স্পর্শ পেলে তনুমন কম্পিত হয়ে ওঠে। তারপরই দু-জাতীয় প্রেমিকার সঙ্গে তুলনা করেছেন নিজের। ভীরু প্রেমিকা তার অন্তরের সুগভীর প্রেম আবরিত করতে চেয়ে গোপনে যে কটাক্ষ হানে, কবি সেই কটাক্ষ ; চঞ্চল মেয়ে তার ভালোবাসায় নিজেকে যেরকম উচ্ছ্বসিতভাবে প্রকাশ করে, কবি যেন সেই উচ্ছ্বাস।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠতে পারে, কবি তাঁর এই কবিতায় যে বিদ্রোহের সুর শুনিয়েছেন তার সঙ্গে এর সঙ্গতি আছে কিনা। স্থূল দৃষ্টিতে বিচার করলে এই স্তবকটি যে মূল কবিতার সঙ্গে অন্বিত নয় সেকথা অস্বীকার করবার উপায় নেই-কারণ দৃষ্টিভঙ্গিতেই পার্থক্য অতি স্পষ্ট। কবির উন্মত্ত তাণ্ডবের সঙ্গে এর মিল নেই, শাস্ত প্রজ্ঞার সঙ্গে এর সহমর্মিতা নেই–বিদ্রোহের সঙ্গেও এর যোগাযোগ অল্প, কারণ প্রেমের কোনো বৈপ্লবিক দিক কবি এখানে দেখাতে চাননি। কিন্তু সূক্ষভাবে বিচার করলে বলা যায়, এই স্তবকটিও কবিতার সঙ্গে সম্পর্কশূন্য নয়, কারণ কবি এই সমগ্র কবিতায় এই সত্যটিই প্রতিফলিত করেছেন যে তিনি উচ্ছ্বসিত। দীর্ঘ স্থবিরত্বের পর মানুষের প্রথম ঘুম ভাঙলে সে অহেতুক চঞ্চল হয়ে পড়ে—তার সে চাঞ্চল্যে অকারণ উচ্ছ্বাসও কম থাকে না। কবি নিজেই বলেছেন—
“আমি কভু প্রশান্ত-কভু অশাস্ত, দারুণ, স্বেচ্ছাচারী।”
এই উক্তির মধ্যে যে উচ্ছ্বাস আছে, সামগ্রিকভাবে সর্বত্রই সে উচ্ছ্বাস প্রতিফলিত। কবির সমস্ত কথাই প্রবল, সব সুরই উচ্চ গ্রামে বাঁধা। তিনি ধ্বংসের কথা বলেন তখন যেমন তাঁর উচ্ছ্বাস সীমাহীন—যখন তিনি স্রষ্ঠা, তখনকার উচ্ছ্বাসও কোনো বাধা মানে না। এই অনিয়ন্ত্রিত উচ্ছ্বাসেরই একটি দিক কবির এই ভাবপ্রবণতা। এই স্তবকে কবির বক্তব্য বিদ্রোহের সঙ্গে অম্বিত নয়, কিন্তু যে অনিয়ন্ত্রিত উচ্ছ্বাস তাঁর সমগ্র কবিতায় ছড়িয়ে আছে সেই উচ্ছ্বাসের সঙ্গে এর সংযোগ আছে। একটি আবেগতপ্ত কবিমন এখানেও প্রকাশিত হয়েছে।
তা সত্ত্বেও একথা স্বীকার করতে হবে যে, কবির এই স্তবকের বক্তব্য কিছুটা লক্ষ্যভ্রষ্ট। এর একটা সম্ভাব্য কারণও অনুমান করা যায়। কবি তাঁর এই ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি লিখবার প্রেরণা মোহিতলাল মজুমদারের ‘আমি’ নামক গদ্যরচনা থেকে পান বলে অনেকে মনে করে থাকেন। এই রচনাটিতেও মোহিতলাল নিজের প্রচণ্ড শক্তির কথা বর্ণনা করেছেন, কিন্তু সেই সঙ্গে একটি রোমান্টিক অংশও তিনি যুক্ত করেন, সেটি এই রকম— “আমিই মধুর–জননীর প্রথম চুম্বনের মত, তৃষিত বনভূমির উপর নববরষার পুষ্পকোমল ধারাস্পর্শের মত ; দিব্যমাল্যাম্বরধরা ব্রীড়া-পেপথুমতী বিবাহধুমারুণ লোচনশ্রী নববধূর পাণিপীড়নের মত, যমুনাপুলিনে বংশীধ্বনির মত, প্রণয়িনীর সরমসঙ্কোচের মত, কৈশোর ও যৌবনের বয়ঃসন্ধির মত।”
মোহিতলালের রচনার এই অংশ কবিকে প্রভাবিত করে থাকতে পারে বলে আমাদের মনে হয়।
Leave a comment