দু-জাতের কবি আছেন। প্রথম শ্রেণিতে তাঁরা পড়েন, যাঁরা অনুকূল পরিবেশ পেলে বুদ্ধি ও আবেগের সুষ্ঠু সমাহারে কবিতা প্রতিকূল পারিপার্শ্বিকের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে তাদের প্রতিভার বিকাশ ও প্রকাশ সম্ভব করে তোলেন। বলাবাহুল্য কাজি নজরুল ইসলাম দ্বিতীয় শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। পশ্চিমবঙ্গের এক শ্রমজীবী পরিবারের অবহেলিত ও অর্ধশিক্ষিত সন্তান জীবিকার প্রয়োজনে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ কালে ইংরাজ সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন এবং হাবিলদারের পদে উন্নীত হয়েছিলেন। যুদ্ধ শেষে কর্মচ্যুত হয়ে বাংলায় ফিরে আসেন। তাঁরই কবিত্ব ধ্বনিত, প্রতিধ্বনিত হল শোষণ, পীড়ন ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সুর। স্বাধীনতার অদম্য স্পৃহা বিদেশি শাসকের পীড়নের মুখোমুখি দাঁড়িয়েও অদম্য এই কবির কণ্ঠে উচ্চারিত হল বিদ্রোহের নববাণী সময়টা ছিল 1921 সালের 27 নভেম্বর। প্রিন্স অব ওয়েলস (Prince of Wales) ভারতে এলেন। বিক্ষুদ্ধ ভারতীয়রা পালন করলেন ধর্মঘট, নজরুল লিখলেন—
লক্ষ্য যাদের উৎপীড়ন আর অত্যাচার
নর নায়ারণে হানে পদাঘাত
হেনেছে সত্য প্রত্যাশার
অত্যাচার ! অত্যাচার !
এর কিছু পূর্বে সাপ্তাহিক ‘বিজলী’ এবং ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকায় নজরুলের বিদ্রোহী কবিতাটা যুগপত প্রকাশিত হয়ে কবিকে খ্যাতির তুঙ্গ শীর্ষে তুলে দিয়েছিলেন। মানুষের হকের মধ্যে অবরুদ্ধ ক্ষোভ, আবেগ এবং বেদনা এই কবিতার মধ্যে যৌবন জলতরঙ্গের মতো উচ্ছ্বাসিত হয়ে উঠেছিল। সেখানে কবি একথা বলার স্পর্ধা দেখালেন—
‘আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দিই পদচিহ্ন।
নজরুলের মুখে এ কবিতাটির আবৃত্তি শুনে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। অভিনন্দিত করেছিলেন অজস্র সম্মানে।
নজরুলের কবিতায় সেদিন ধ্বনিত হয়ে উঠেছিল এমন এক বিদ্রোহের সুর, যার সমজাতীয় উচ্চারণ এর আগে কখনও শোনা যায়নি। সব রোমান্টিক কবিই সমাজ সংস্কার প্রথারীতি চিন্তা ভাবনার চেতনার জগৎ ছিন্ন ভিন্ন করে চিরকালের বিদ্রোহের কথা প্রকাশ করেন। ফরাসি বিপ্লবে রুশোর ভাবধারায় উজ্জীবিত সব দেশের কবিরাই এই বিপ্লবী চেতনা প্রকাশ করতে চেষ্টা করেছেন তাঁদের ভাষায়। রবীন্দ্রনাথও লিখেছেন—
আমি আগন্তুক
আমি জনগণেশের প্রচণ্ড কৌতুক
জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন—
“একদিন শুনেছ যে সুর পরানোতা।
তাই আমি আসিয়াছি
আমার মতন আর নাই কেউ।”
বস্তুত প্রত্যেক কবি যে অভিনব ‘আমি’কে প্রকাশ করতে চান সেই আমির এক বিচিত্র উৎসার ও উচ্ছ্বাস দেখা যায় নজরুলের বিদ্রোহীতে—
বল বীর
বল উন্নত মম শির
শির নেহার আমারি নত শির ঐ শিখর হিমাদ্রীর।
আকাশ পাতাল সাগর পর্বত নদী গিরি সব অগ্রাহ্য ও পদদলিত করে যে পরমানন্দে বাঞ্ঝার মতো ছুটে চলেছে সেই বিদ্রোহীর প্রতিমূর্তি দেখে কে না ভয় পায় ?—
আমি মহামারী আমি ভীতি ও ধরিত্রীর
শাসন প্রকাশ সংহার, আমি উম্মু চির অধীর।
প্রশ্ন জাগতে পারে—এই ‘আমি টা’ কে ? উত্তরে বলা যায় যে কবির অন্তোর্সারিত এক বিদ্রোহী সত্ত্বা, যা কবির সৃজনী কল্পনার মধ্যে জগতের যাবতীয় শাস্ত্র, পুরাণ, জ্ঞান-বিজ্ঞানের সর্ববিধ উপকরণের যোগে এক ভাব স্বরূপে সম্মুদ্ভাসিত। চির দুরন্ত, দুর্ধর্ষ, দুর্মর এই বিদ্রোহী সত্তা আপনাকে ছাড়া কাউকে কুর্নীশ করে না। মহাশক্তিশালীর এই সংহার মূর্তির মধ্যে কবি প্রেম ও করুণার এক অন্তঃলীলা প্রস্রবণ বহমান রেখেছেন। কারণ বিদ্রোহ তো জাতের কল্যাণের জন্য দুঃখ মোচনের জন্য। এই জন্যই কবির এক হাতে বাঁশের বাঁশরী অন্য হাতে রণতুর্য। ইন্দ্রানী সমাজের স্তরে সব পাপ ও জঞ্জাল ধ্বংস করে প্রচণ্ড আঘাতে মানুষের বেদনার অবসান ঘটাতে তিনি আবির্ভূত।
আমি পরশুরামের কঠোর কুঠার
নিঃক্ষত্রিয় করিব বিশ্ব, আনিব শান্তি শান্ত উদার।
আমি হল বলরাম স্কন্দে
আমি উপাড়ি ফেলিব বিশ্ব অবহেলে
নব সৃষ্টির মহানন্দে।
উৎপীড়ক শাসকদের ধ্বংস করে নব সৃষ্টির তোরণদ্বারে জগৎকে উপনীত করে আপন কাজ সমাধা করবেন।
মহা বিদ্রোহী রণক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত।
“যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না,
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণভূমে ধ্বনিবে না।
বস্তুত একথা নজরুলেরই, ‘আমার কৈফিয়ৎ’ কবিতায় তাই তো তিনি জানিয়েছেন—
প্রার্থনা যারা কেড়ে খায় তেত্রিশকোটী মুখের গ্রাস,
যেন লেখা হয় আমার রক্ত লেখায় তাদের সর্বনাশ৷৷
বিপ্লবের এই জয়ধ্বনি শোষণ ও বঞ্চনার অবসান কামনা এই কবিতাতেও প্রতিধ্বনিত হয়েছে।
বিদ্রোহী কবিতাটিতে নজরুলের প্রতিনিধি স্থানীয় কবিতা। তাঁর প্রথম কবিতা না হলেও তাঁর কাব্য সংকলনের সর্বাগ্রে এই কবিতাটিকে স্থান দিয়ে সংকলনের গুরুত্ব বুঝিয়ে দিয়েছেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষ থেকে দ্বিতীয় দশকের শেষ পর্যন্ত নজরুলের সৃষ্টিকাণ্ড এই কুড়ি পঁচিশ বছরে কবির মানসিকতার সুর বেশি উত্তরণ ঘটেনি। এই বিপ্লবী চেতনা, প্রকৃতি প্রেম মানবপ্রেমের আবর্তের মধ্যে তার কবিতা ও গান আবর্তিত হয়েছে। কবি ব্যক্তিত্বের এই নানামুখী অভিব্যক্তিগুলি অর্থাৎ মানবপ্রীতি সংস্কৃতি চেতনা, সুক্ষ্ম ইন্দ্রিয়ানুভূতি কাব্য ও পুরাণের অধিকার বিদ্রোহী কবিতার ভাব ভূমিতে সন্নিবিষ্ট। কবি যখন বলেন—
‘আমি অফিয়ামের বাঁশরী,
কিংবা আমি, অভিমানী চির ক্ষুব্ধ হিয়ার কাতরতা ব্যথা সুনীবিড়।
কিংবা, গোপন প্রিয়ার চকিত চাহনি, ছল করে দেখা অনুখন,
অথবা পথিক কবির গভীর, পাগলিনী বেনু বিনে গান গাওয়া।
তখন যে সৃষ্ট, স্বৰ্গীয় দূত, জিব্রাইলের আগুনের পাখা ঘাপটি ধরে সেই মহারুদ্রের দক্ষিণ মুখ আমরা দেখতে পাই এবং অনুভব করতে পারি কবির ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণ প্রকাশ এই কবিতার মধ্যে ঘটেছে।
বিদ্রোহী কবিতার ভাববস্তু স্বাভাবিকভাবেই যুক্তি অতিক্রমী। কেননা, এখানে বস্তুসত্য অপেক্ষা চৈতন্যের প্রকাশ লক্ষণীয়। শিল্প সত্য বস্তু সত্য অপেক্ষা অনেক ঊর্ধ্বে সমাসীন এবং সে জীবনের পরম সত্যের সুপ্রতিষ্ঠিত। বিদ্রোহী কবিতায় এই পরম সত্যের প্রকাশ। বিশ্বপ্রকৃতির সর্বত্রই এই যে নিজেকে উপস্থিত করা, ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী রূপে নিজেকে দাঁড় করানো একেও চৈতন্যের অবদান বলা চলে। অস্তিত্বের এই যে প্রবণতা ঘোষণা একে শিল্পীসত্ত্বার বহিঃপ্রকাশ রূপে অভিহিত করা যেতে পারে, বাংলা কবিতার ধারায় শিল্পীর এই যে পরসতা প্রকাশ তা বিদ্রোহী কবিতা ব্যতীত অন্যত্র দুর্লঘ্য। বিদ্রোহী যুক্তি, অতিক্রমী কবিতা হলেও পরাবাস্তব কবিতা নয়। এ কবিতাতে স্বাধীনতার কথাই মুখ্য নয়। এখানে অস্তঃচৈতন্যের মহোত্তম প্রকাশ। কবি পুরাণে ইতিহাসে, বর্তমানে ভবিষ্যতে, সর্বত্রই আপনাকে প্রতিষ্ঠিত ও প্রকাশিত করেছেন। বিদ্রোহী কবিতার সূচনা বর্তমানে, প্রস্থানে ভবিষ্যতে বর্তমান থেকে ভবিষ্যত পর্যন্ত প্রসারিত বিশাল পথের অনন্ত সম্ভাবনা যুক্তির পারম্মর্থে অগ্রসর না হলেও, একেবারে যুক্তি ছিন্নও নয়। এখানে আছে বিদ্রোহের গর্জনের সঙ্গে সুন্দরের বীণাধ্বনি। যিনি ঈশ্বরের বক্ষে পদাঘাত হানতে চান তিনিই আবার কুসুমের ন্যায় কোমল। যিনি নিজেকে বজ্র ও ঝঞ্ঝারূপে ঘোষণা করেন, তারই হৃদয় আবার কুমারীর প্রথম চুম্বনে কম্পিত। সমালোচক ধ্রুবকুমার মুখোপাধ্যায় যথার্থই বলেছেন “নজরুলের কাব্যদর্শই হল পুরাতনের ধ্বংস আর নতুনের উত্থান-কবিতায় তারই ছন্দোবদ্ধ রূপায়ণ। ধ্বংস দেখে কবি ভয় পান না। তিনি নিজেকে নটরাজ, সাইক্লোন ধ্বংস ইত্যাদি ঘোষণার পর গোপন প্রিয়ার চকিত চাহনি ও চঞ্চল মেয়ের ভালোবাসায় মদির হন। নজরুলের জীবনাদর্শ ও কাব্যদর্শ বিদ্রোহী কবিতায় নানা রূপকল্পে বিভাসিত।”
তাই বলতে হয়, বিদ্রোহী কবিতায় বহিঃপৃথিবী একই বৃত্তে প্রকাশিত। এখানে বক্তব্য, রূপককল্প, ছন্দ, অলংকার-এর মিনার আকাশ স্পর্শ করেছে তার ভিত্তি কিন্তু চিরচেনা মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষা, বেদনা নিরাশা স্বপ্ন সম্ভাবনার মধ্যে নিহিত। বিদ্রোহী কবিতার ‘অশনি’ সংকীর্ণতার বৃত্ত ভেঙে ক্রমশ এগিয়ে গেছে মহত্তম বোধের দিকে—সঙ্কীর্ণতা থেকে বিশালতায় ক্ষুদ্রতা থেকে মহোচ্চতায় অত্যাচার আর নিপীড়নের জগত থেকে মুক্ত স্বচ্ছ দুয়ার দিকে। কবির আমিত্ব বোধের উত্তরণ ঘটেছে আমার ভাবনায়। এক অর্থে ‘বিদ্রোহী’ আত্মবিবর্তিত কবিতা।
Leave a comment