কাজি নজরুল ইসলাম তাঁর ‘বিদ্রোহী’ কবিতার মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যে এক তীব্র আলোড়ন উপস্থিত করেন। একদিকে এই কবিতা পড়ে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের মতো প্রতিভা কবিকে স্বাগত জানান, আপামর জনসাধারণ নজরুলকে তাদের প্রাণের কবি হিসাবে বরণ করে নেন। অন্যদিকে কবি ব্রিটিশ সরকারের ক্রোধ-দৃষ্টিতে পড়েন, সজনীকান্ত দাসের নেতৃত্বে তাঁর বিরোধী এক কবি-সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হয় যারা ব্যঙ্গে, বিদ্রূপে কবিকে অস্থির করে তোলেন।

কবি ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় যে বিদ্রোেহ উপস্থিত করেছেন এবং ‘আমি’ বলে যে শক্তিকে মূর্ত করে তুলেছেন তার প্রকৃতি সম্বন্ধে বিরোধী ব্যাখ্যাই কবিতাটি সম্পর্কে এই মিশ্র প্রতিক্রিয়ার কারণ। সুতরাং প্রথমেই কবি ‘আমি’ বলতে কী বলতে চেয়েছেন তা বোঝবার চেষ্টা করা দরকার।

‘আমি’ বলতে প্রাথমিকভাবে কবি নিশ্চয়ই তাঁর ব্যক্তিগত পরিচয়ই তুলে ধরতে চাইছেন, কিন্তু এই পরিচয়কে কবির প্রাত্যহিক জীবনের ধূলি-মলিন পরিচয় ভাবলে অবিচার করা হবে। প্রত্যেক আত্মসচেতন ব্যক্তির মধ্যে থকে দুটি সত্তা—একটি তার প্রতিদিনের পরিচয় বহন করে, আর একটি তার বিরাটত্বের পরিচয়বাহী। প্রাত্যহিক সত্তার থাকে অহংকার, বৃহত্তম সত্তার থাকে অহংবোধ । রবীন্দ্রনাথ এই দুটি সত্তাকেই বোঝাতেই চেয়েছেন ‘ক্ষুদ্র-আমি’ ও ‘বিরাট আমি’ বলে। দর্শনের ভাষায় বলা যায় এই ‘বিরাট-আমি’ মানুষের এক ধরনের ‘ego’ বা আত্মব্যক্তিত্ব । এই অহংবোধ মানুষের মধ্যে অকস্মাৎ জাগ্রত হয়ে তাকে এক বিরাট মানসিক শক্তি দান করে। রবীন্দ্রনাথ নিজেও একদিন এই শক্তিতে উদ্বুদ্ধ হয়ে ‘প্রভাত সংগীতের’ কবিতাগুলি রচনা করেন। নজরুল ইসলাম মনের মধ্যে সেই শক্তির প্রেরণাতেই উদ্বুদ্ধ হয়েছেন এবং নিজের সেই বৃহত্তর সত্তাকে প্রকাশ করেছেন ‘আমি’ হিসাবে।

কিন্তু ‘আমি’ বলতে শুধুই ব্যক্তিগতভাবে কবিকে মনে করা ঠিক হবে না—এ ‘আমি’ কোনো বিশেষ ‘আমি’ নয়, এর পরিচয় আরও বিস্তৃত। কবি এখানে নতুন যুগের মানুষের চিত্তজাগরণের অগ্রদূত, তিনি শুধু নিজের মুক্তিই অনুভব করেননি—তাঁর মনে প্রাণে জেগেছে নিপীড়িত মানুষদের মুক্তির স্বপ্নে উদ্বুদ্ধ করার নেশা। কবি কেবলমাত্র নিজে স্বাধীন, একথা উচ্চারণ করেননি, তিনি সদ্য জাগ্রত মানুষের অগ্রণী ভূমিকা নিয়ে তাদেরও চিত্তজাগরণের মন্ত্রপাঠ করিয়েছেন। কবিতার প্রথমেই তিনি ওই সব জাগ্রত চেতনায় মানুষকে আহ্বান করে বলেছেন—

“বল বীর

চির উন্নত মম শির।”

সুতরাং এর পর ‘আমি’ হিসাবে যে কথা তিনি বলতে চেয়েছেন সে আমি কেবল কবি হতে পারেন না—সে আমি আসলে মুক্তি পাগল প্রতিটি মানুষ। কবির সংকল্প প্রকৃতপক্ষে প্রত্যেকটি মানুষেরই সংকল্প। সুতরাং আমি বলতে শুধুমাত্র কবি নিজে নন, তিনি যাদের উদ্দেশ্যে আহ্বান জানিয়েছেন তাদেরও বোঝানো হয়েছে।

কবি এখানে যে বিদ্রোহের কথা শুনিয়েছেন তার সঠিক প্রকৃতি বোঝা সহজ নয়, কারণ কবি সমগ্র কবিতাতেই উচ্ছ্বসিত। কখনো তিনি ধ্বংসের কথা বলেছেন, কখনো বলেছেন ত্রাস সঞ্চারের কথা, কখনো পৌরাণিক ঋষির সঙ্গে নিজের তুলনা করেছেন, কখনো বা অন্তরের অন্তঃস্থলে হয়েছেন রোমাতি। বিচ্ছিন্নভাবে চিন্তা করলে বলা যায়, কবির বিদ্রোহ ঘন ঘন দিক পরিবর্তন করেছে–কখনো তিনি দৈব-প্রভাব ক্ষুণ্ণ করতে চেষ্টা করেন, কখনো তিনি পৃথিবীর সমস্ত নিয়মকানুন ধ্বংস করার চেষ্টা করেন, কখনো সৃষ্টিকেই করতে চান ধূলিসাৎ, আবার কখনো তাঁর বিদ্রোহ পৃথিবীর ক্ষত্রিয় জাতির প্রতি, রণদুর্মদ শক্তির প্রতি, যে-কোনো অত্যাচারী প্রভুত্বের প্রতি। কবির এই বিদ্রোহকে বিচ্ছিন্নভাবে না দেখে এক কথায় প্রকাশ করতে গেলে বলতে হবে, তাঁর এই বিদ্রোহ মানুষের যে কোনো ধরনের পরাধীনতার বিরুদ্ধে। মানুষকে সর্বক্ষেত্রে স্বাধীন করবার জন্যই তাঁর এই উদার আহ্বান। মানুষের পরাধীনতা শুধু রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নয়–নৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয়, সব ক্ষেত্রেই তার বশ্যতা এবং অবসাদ থাকতে পারে; সেই সর্বক্ষেত্রের অবসাদ ও অধীনতা দূর করার জন্যই কবি বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন। তাই ক্ষত্রিয়কে নির্মূল করার কথাও যেমন কবি বলেন, তেমনি একথা বলতেও তাঁর বাঁধে না—

“আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান্ বুকে এঁকে দেবো পদ-চিহ্ন।”

সুতরাং কবির এই বিদ্রোহকে অবসন্ন ও পরাধীন মানুষকে সর্বক্ষেত্রে উন্নত চিত্ত স্বাধীন করার এক বলিষ্ঠ আহ্বান মনে করা যেতে পারে।

কবির বিদ্রোহের প্রকৃতি সঠিকভাবে বুঝতে পারলে বিদ্রোহের লক্ষ্যবস্তু কে, সে কথা বোঝাও কঠিন হবে না। মানুষকে যেসব শক্তি অবদমিত করে রেখেছে, উৎপীড়নের চাপে তার স্বাধীন সত্তা বিকাশের পথ রুদ্ধ করেছে—তারই বিরুদ্ধে কবির বিদ্রোহ। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ব্রিটিশ সরকার ভারতবর্ষের মানুষের স্বাধীনতা গুঁড়িয়ে দিয়েছে উৎপীড়নের চাপে, তাই কবি সগর্বে বলেছেন—

“যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না, 

অত্যাচারীর খড়্গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না-

বিদ্রোহী রণ-ক্লস্ত

আমি সেই দিন হব শাস্ত।”

কিন্তু মানুষের অধীনতা শুধু রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নয়, ধর্মীয় অত্যাচারও মানুষের চিত্তকে অবসাদগ্রস্ত করে রাখে, তাই কবি দেবতার বিরুদ্ধে তাঁর বিদ্রোহের কথা ঘোষণা করেছেন, বলেছেন তিনি বিশ্ব-বিধাত্রীর বিদ্রোহী সূত-গোলক ভেদ করে তাঁর উন্নত শির মহাকাশের ওপরে গিয়ে পৌঁছবে।

এই পৃথিবীতে সামাজিক সংস্কারও পদে পদে মানুষকে শৃঙ্খলিত করছে। তাই কুসংস্কারের অন্ধতায় ভরা এই পৃথিবীর বিরুদ্ধেও তাঁর বিদ্রোহ। তিনি বলেন— 

“আমি দাবানল দাহ, দাহন করিব বিশ্ব।”

অন্যত্র তিনি বলেছেন—

“আমি উপাড়ি’ ফেলিব অধীন বিশ্ব অবহেলে নব সৃষ্টির মহানন্দে।”

লক্ষণীয়, তিনি বিদ্রোহ করবেন শুধু ধ্বংস করতে নয়, তাকে শুদ্ধ করতেও। পৃথিবীকে তিনি দহন করতে চান শুধু ধ্বংসের কারণে নয়, তাকে অগ্নিশুদ্ধ করার কারণে, পৃথিবীকে উৎপাটিত করতে চান নবসৃষ্টির জন্যই। এখানেই কবির বিদ্রোহের সার্থকতা।