অথবা, বিদ্যাপতি ও জ্ঞানদাসের পদের তুলনামূলক আলোচনা কর

উত্তর: চৈতন্য পূর্ববর্তী শ্রেষ্ঠ কবি বিদ্যাপতি এবং চৈতন্য পরবর্তী প্রতিভাবান কবি জ্ঞানদাস মধ্যযুগের বৈষ্ণব সাহিত্যের স্মরণীয় কবি ব্যক্তিত্ব। কবিত্ব-উৎকর্ষের দিক দিয়ে উভয় কবিরই স্ব-স্ব যুগে শ্রেষ্ঠত্বের নিদর্শন রেখেছেন। আলোচ্য ক্ষেত্রে আমাদের আলোচনার বিষয় বিদ্যাপতি ও জ্ঞানদাসের ভাব, ভাষার সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য।

কাব্য তথা বৈষ্ণব কবিতা রচনায় বিদ্যাপতি পূর্বসূরি সংস্কৃত ও প্রাকৃত কবিদের অনুসরণ করেছেন। তাঁদের মধ্যে কালিদাস, ভর্তৃহরি, জয়দেব উল্লেখযোগ্য। অন্যদিকে, জ্ঞানদাস প্রথমে বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস এবং অন্যান্য দু’একজন পূর্বসূরিদের অনুসরণ করেছেন। কিন্তু ক্রমান্বয়ে যখন তাঁর কবিত্বের পূর্ণ বিকাশ ঘটেছে তখন বিশেষকরে চণ্ডীদাসের কাব্যাদর্শকে জ্ঞানদাস গ্রহণ করেছেন এবং স্বীয় মৌলিক প্রতিভা সংযোজনে তা সমৃদ্ধ করেছেন।

দেহ-প্রেম সর্বস্ব কবি হিসেবে বিদ্যাপতি উচ্চ শ্রেণির। তিনি দেহমুখী হয়েও প্রেম মনস্তত্ত্বকে মর্যাদা দিয়েছেন। প্রেমকে বিরহতন্ময়তার ভাব সম্মিলনের পবিত্রতায় উন্নীত করেছেন। রূপ, রীতি, ভাষা ও ছন্দে বিদ্যাপতি অনেক ব্যাপ্তি ও বৈচিত্র্য দেখিয়েছেন। বিচিত্র জ্ঞান ও রসশাস্ত্র তাঁর আয়ত্তে ছিল। কিন্তু জ্ঞান ও পাণ্ডিত্য সত্ত্বেও তাঁর পদাবলীর কাব্য সৌন্দর্য স্থূল বস্তুভারে আক্রান্ত হয়নি। জ্ঞানকে কবি বুদ্ধির দীপ্তিতে রূপান্তরিত করেছেন। তিনি ছিলেন মিথিলার রাজসভার সাথে যুক্ত। ফলে তীক্ষ্ণ রুচিবিলাস, শিথিল নীতিবোধ তথা অত্যধিক আদিরণ- প্রবণতা, বাচন বক্রতা, নাগর বৈদগ্ধ্য তাঁর কবি-ব্যক্তিত্বের অংশ হয়ে উঠেছিল।

পক্ষান্তরে, জ্ঞানদাস বৈষ্ণব পদ সাহিত্যে নতুন লিরিক অন্যদিকে, জ্ঞানদাসের কৃষ্ণের প্রেমানুভব আদৌ সার্থক হয়ে উঠেনি। জ্ঞানদাস কোনোকালেই কৃষ্ণের চোখ দিয়ে জগৎ সৌন্দর্য ও রাধার দেহকান্তি দেখেননি। রাধার দৃষ্টির আলোকই ছিল তাঁর কাম্যধন। তাঁর কৃষ্ণে বিদ্যাপতির ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য মিলবে না। প্রেমানুভূতির কবিরূপে আমাদের সামনে আবির্ভূত হয়েছেন। চণ্ডীদাসের মতো তিনি ছিলেন ভাবাকুল কবি। বৃন্দাবনের রাধাকৃষ্ণের প্রেমকথার মাধ্যমে কবি যেন নরনারীর শাশ্বত প্রেম বেদনার কথাই শোনাতে চেয়েছেন। এই ব্যক্তিক লিরিক- প্রেমানুভূতির ক্ষেত্রে জ্ঞানদাস দীর্ঘ চারশ শতাব্দীকালের ব্যবধান অতিক্রম করে, মধ্যযুগীয় বিশিষ্ট ধর্মগোষ্ঠীর সীমা অতিক্রম করে, বৈষ্ণব অবৈষ্ণব নির্বিশেষে সকলের সাথে একাত্ম হতে পেরেছেন।

বিদ্যাপতি বস্তুবিদ রূপতন্ময় কবি। রাধার বয়ঃসন্ধি বিষয়ে তিনি অনেক পদ লিখেছেন। দেহ ও মন উভয়ের পরিবর্তন এবং বিকাশ অপূর্ব কৌশলে চিত্রিত করেছেন। বয়ঃসন্ধির কবিতায় রাধার দৈহিক পরিবর্তনের সরস অলঙ্কৃত এবং সকৌতুক বর্ণনা দিয়ে লিখেছেন,

‘শৈশব যৌবন দরশন ভেল

দুই দল বলে দন্দ পরি গেল।

কবহু বান্ধএ কচ কবহু বিথারি

কবহু ঝাঁপএ অঙ্গ কবহু উঘারি।’ (পদ-৩৯)

জ্ঞানদাস ভাববিদ্ধ প্রাণতন্ময় কবি। তবে বয়ঃসন্ধির কবিতায় জ্ঞানদাস বিদ্যাপতির আদর্শে কয়েকটি পদ রচনা করেছেন। এক্ষেত্রে বিদ্যাপতির সাথে জ্ঞানদাসের পার্থক্য হলো বয়ঃসন্ধির পদটিতে জ্ঞানদাস উদ্বিগ্ন যৌবনা রাধাকে দেখে কৃষ্ণের রূপ মুগ্ধতার ছবি এঁকেছেন। পূর্বরাগ, বয়ঃসন্ধি ও কৃষ্ণ মিলনোৎসুক রাধার কয়েকটি পদে জ্ঞানদাস বিদ্যাপতিকে অনুসরণ করেছেন। তবে এসব ক্ষেত্রে বিদ্যাপতি যেখানে রাধার লীলাভঙ্গি অর্থাৎ অনুভাব চিত্রণের উপর জোর দিয়েছেন; সেক্ষেত্রে জ্ঞানদাস সূক্ষ্ম হৃদয়ানুভূতির প্রকাশ ঘটিয়েছেন। রতিকলার চিত্রণে জ্ঞানদাসের কবিত্ব ততটা পরিস্ফুট হয়নি।

বিদ্যাপতির রাধা এবং জ্ঞানদাসের রাধার মধ্যে কিছুটা স্বতন্ত্র পরিলক্ষিত হয়। বিদ্যাপতির রাধা লোকচক্ষুর আড়ালে রাতের অন্ধকারে অভিসারে যায়-

‘জামিনি ঘন আঁধিয়ার।

মনমথ হিয় উজিয়ার।।

বিখিনি বিথারল বাট।

প্রেমক আয়ুধে কাট’।। (পদ-১৪৫)

অন্যদিকে, জ্ঞানদাসের রাধা প্রেমে লোকলজ্জা ভুলেছে। আবেগ বিহ্বলতায় সে রাজপথে ছুটে এসে চাতকিনীর মতো দাঁড়িয়ে কৃষ্ণের চলে যাওয়া দেখছে। রাধা অন্ধকারে দুর্যোগে একা পথ চলতে পারে না বলে সাথে সখীরা রয়েছে। জ্ঞানদাসের এই অভিসারিকা রাধা বিদ্যাপতির তুলনায় নিষ্প্রভ-

‘কানু-অনুরাগে হৃদয় ভেল কাতর

রহই না পারই গেহ।

গুরু-দুরুজন-ভয় কিছু নাহি মানয়।।’ (পদ-১৫৬)

বিদ্যাপতির পদাবলীতে কৃষ্ণের একটি প্রত্যক্ষ স্পষ্ট ভূমিকা রয়েছে। রাজসভার পরিবেশে বর্ধিত, রুচি বৈদগ্ধ্য পরিপূর্ণ, নাগর চাতুর্যে উল্লসিত এবং রাজসিক ভোগ লালসায় উজ্জীবিত কৃষ্ণের দৃষ্টিতেই যেন কবি স্বয়ং রাধার রূপযৌবন দেখেছেন, তাঁর সৌন্দর্য উপভোগ করেছেন।

অন্যদিকে, জ্ঞানদাসের কৃষ্ণের প্রেমানুভব আদৌ সার্থক হয়ে উঠেনি। জ্ঞানদাস কোনোকালেই কৃষ্ণের চোখ দিয়ে জগৎ সৌন্দর্য ও রাধার দেহকান্তি দেখেননি। রাধার দৃষ্টির আলোকই ছিল তাঁর কাম্যধন। তাঁর কৃষ্ণে বিদ্যাপতির ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য মিলবে না।

জ্ঞানদাস বিশেষ সাফল্য অর্জন করেছেন পূর্বরাগ ও অনুরাগ- বিশেষকরে আক্ষেপানুরাগের পদে এবং এই উভয়বিধ পদেই রাধার অনুভূতি প্রকাশে। জগৎ এবং জীবনকে, প্রেমের অনুভূতিকে- তার বেদনা ও চিত্তচাঞ্চল্যকে কবি রাধার দৃষ্টিতেই দেখেছেন, কৃষ্ণের দৃষ্টিতে নয়। চণ্ডীদাসের রাধার মতো জ্ঞানদাসের রাধাও অনেকখানি আন্তরসত্তারই প্রতিফলন। আপন- সৃষ্ট রাধিকার সাথে কবি প্রায় একাকার হয়ে গিয়েছেন। তাই রাধারই বেদনায় কবির হৃদয়ের সবকটি তারে ঝংকার উঠেছে।

‘রূপের পাথারে আঁখি ডুবিয়া রহিল।

যৌবনের বনে মন হারাইয়া গেল।।

ঘরে যাইতে পথ মোর হইল অফুরাণ।

অন্তরে অন্তর কাঁদে কিবা করে প্রাণ।।’ (পদ-৬০)

এই রোমান্টিক ও লিরিকধর্মী মানবিক প্রেম অনুভূতিতে জ্ঞানদাস মধ্যযুগের বৈষ্ণব কবি হয়েও আমাদের একান্ত কাছে আসতে পেরেছেন। এখানেই অন্য বৈষ্ণব কবিদের থেকে তাঁর স্বাতন্ত্র্য।পক্ষান্তরে, বিদ্যাপতি কখনো রাধার বেদনার সাথে একাত্ম হয়ে পড়েননি । সুখে কিংবা দুঃখে- মিলনের আনন্দোল্লাসে কিংবা বিষয়ের আর্ত ক্রন্দনে, কোনো তত্ত্ব চিন্তার দ্বারা প্রভাবান্বিত হননি বিদ্যাপতি। বিদ্যাপতির রাধার বেদনা গভীর কিন্তু অন্তরের অতলে তলিয়ে যাওয়ার নয়, সংসার প্রকৃতিকে প্লাবিত করার মতো বিপুল। হৃদয়ের পাত্র উপচে চারপাশে জগৎ সংসার প্রকৃতিকে প্লাবিত করার মতো বিপুল।

প্রকৃতির শব্দ চিত্রের সাথে রাধার বিরহের আর্তিকে বিদ্যাপতি অসূচিভেদ্য নিপুণতায় ফুটিয়ে তুলেছেন,

‘এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর।

এ ভরা বাদর মাহ ভাদর

শূন্য মন্দির মোর ॥ (বিদ্যাপতি পদ-২৪৯)

কবি বর্ষা প্রকৃতির সাথে রাধার বিরহ আর্তিকে এক করে দেখেছেন অত্যন্ত নিপুণতায়। তবে শুধু বিরহ বেদনার প্রকাশেই। নয়, আনন্দ উল্লাস প্রকাশেও বহু ক্ষেত্রে অকৃত্রিম গভীরতা দেখেছেন কবি। বসন্ত প্রকৃতির সাথে মিলে রাধার আনন্দোচ্ছ্বাস চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে-

‘আজু মঝু গেহ গেহ করি মানল

আজু মজু দেহ ভেল দেহা।

আজু বিহি মোহে অনুকূল হোয়ল

টুটল সবহি সন্দেহ ॥ (পদ-২৮৪)

এখানে রোমান্টিক রহস্য ব্যাকুলতার সামান্য স্পর্শ ঘটলেও তা বিদ্যাপতির কবি স্বভাবের মূল বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠতে পারেনি, কাব্য সাধনার কোনো স্তরেই নয়।

মাথুর বিরহ পদে বিদ্যাপতির কাব্যে যে বুকফাটা আর্তনাদ দেখা যায় তা জ্ঞানদাসের কবিতায় নেই। মাথুরের দীর্ঘ বিরহেও জ্ঞানদাসের রাধার কন্ঠে অতি উচ্চ ও তীব্র আর্তনাদ জাগাতে পারেননি। বিদ্যাপতি আনন্দের কবি। অন্যদিকে জ্ঞানদাস দুঃখবাদী কবি। মিলনেও তাঁর দুঃখের বেদনা।

বিদ্যাপতির অলঙ্কার কেন্দ্রিক চিত্রণ পদ্ধতি অন্যরূপ মানস প্রবণতার দ্যোতক। রেখা-রঙ-আকৃতি সমন্বিত বস্তুবিশ্বের রূপ, ধ্বনি-সংগীত, স্পর্শাকৃতি, ইন্দ্রিয়-তৃপ্তিকর রূপ নির্মাণে বিদ্যাপতি অনন্য। দৃষ্টান্ত:

কুলিশ শত শত পাত-মোদিত

ময়ুর নাচত মাতিয়া।

মত্ত দাদুরী ডাকে ডাহুকী

ফাটি যাওত ছাতিয়া ॥ (পদ-২৪৯)

এখানে রূপচিত্র মননের স্পর্শে এবং বাকচাতুর্যে অনন্যতা লাভ করেছে। পক্ষান্তরে, জ্ঞানদাসে যে অলঙ্কারের ব্যবহার নেই এমন নয়, রূপের বস্তুবিদ্ধ ছবিও মাঝে মাঝে কিছু আছে। কিন্তু একান্ত লৌকিক, কিছু বা গ্রাম্য দু-একটি শব্দের ব্যবহারে, রূপ দর্শনজাত মানসহিল্লোল ব্যাক্ত করায়, বিস্ময়রসে ডুবে যাওয়ার ব্যঞ্জনায় তাঁর ব্যক্তিক বৈশিষ্ট্য অভিব্যক্ত। তাঁর ভাষায় রূপ কম, রূপাস্বাদই প্রধান। দৃষ্টান্ত :

‘ঘর কৈনু বাহির, বাহির কৈনু ঘর।

পর কৈনু আপন, আপন কৈনু পর ৷৷

রাতি কৈনু দিবস, দিবস কৈনু রাতি।

বুঝিতে নারিনু বন্ধু তোমার পিরীতি ৷৷ (পদ-১২২)

এখানেই বিদ্যাপতি জ্ঞানদাসের স্বাতন্ত্র্য। উভয়ের প্রেমদৃষ্টির মধ্যেও পার্থক্য রয়েছে। যদিও বিদ্যাপতির অনুসরণে জ্ঞানদাস কয়েকটি পদ রচনা করেছেন এবং ব্রজবুলি ভাষা ব্যবহার করেছেন; তথাপি দৃষ্টিভঙ্গির গভীরতা ও প্রীতিস্থির মুগ্ধ আবেশের অনুভবে জ্ঞানদাস বিদ্যাপতি অপেক্ষা স্বতন্ত্র। যেখানে বিদ্যাপতি কামনায় জর্জর, সেখানে জ্ঞানদাস নিমগ্ন অনুরাগে- এখানেই উভয়ের পার্থক্য। তাছাড়া বিদ্যাপতি শুধু ব্রজবুলি ভাষায় পদ রচনা করেছেন। অন্যদিকে, জ্ঞানদাস বাংলা ও ব্রজবুলি দ্বিবিধ ভাষায় পদ রচনা করেছেন।