উত্তর: পদাবলী সাহিত্যের আলোচনায় যে দু’জন কবির নাম সর্বপ্রথম উচ্চারিত হয় তারা হলেন বিদ্যাপতি এবং চণ্ডীদাস। বিদ্যাপতি ও চণ্ডীদাস বৈষ্ণব সাহিত্যের দুই প্রধান দিকপাল। চৈতন্য পূর্ববর্তী যুগে আবির্ভূত এই দুই কবি জীবনবোধের ভিন্নতায় এবং শিল্পরূপের স্বাতন্ত্র্যে স্ব স্ব রচনায় সমুজ্জ্বল। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে যেসব বিরল প্রতিভা তাদের মেধা স্পর্শে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন বিদ্যাপতি ও চণ্ডীদাস তাদের সাধ্য অন্যতম। নিচে বিদ্যাপতি ও চণ্ডীদাসের কবিপ্রতিভার তুলনামূলক আলোচনা করা হলো:

১. বিদ্যাপতি বহুদর্শী পণ্ডিত কবি। তাঁর জীবনকাল আনুমানিক ১৩৮০-১৪৬০ খ্রিষ্টাব্দ। তিনি মিথিলার রাজসভার কবি ছিলেন। রাজসভার পৃষ্ঠপোষকতা ও আপন পাণ্ডিত্য শক্তিকে বিভিন্ন ভাষার ছন্দ নিয়ে ব্রজবুলি ভাষায় কাব্য রচনা করেন। চণ্ডীদাস গ্রামবাংলার নিভৃত পল্লির কবি। তিনি চতুর্দশ শতকের শেষভাগে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর কবিতার ভাষা সরস, সকল প্রকার জটিলতা মুক্ত, সরল, প্রত্যক্ষ এবং অলংকার বর্জিত। চণ্ডীদাস একান্ত নেতিক অর্থাৎ সর্বসাধারণের ভাষায় কাব্য রচনা করে মানুষের মন জয় করেন।

২. বিদ্যাপতির কাব্যে পার্থিব ভোগাস্বাদের প্রতি সর্বশেষ দৃষ্টি ছিল। তাই রাধাকৃষ্ণের প্রণয়লীলা বর্ণনায় তিনি পার্থিব সুখ-সম্ভোগ প্রত্যাশী প্রেমিক-প্রেমিকার চিত্রাঙ্কন করেছেন। তাঁর পদাবলীতে আধ্যাত্মিক প্রণয় কাহিনী অপেক্ষা লৌকিক প্রেমচিত্রই ফুটে উঠেছে। সে কারণে তার কাব্যে আদিরসের আধিক্য এসেছে তিনি বলেছেন, রাধাকৃষ্ণের মিলনাত্মক অংশের বিভিন্নপদে মিলনের কোনো কোনো চিত্র এত বেশি বাস্তব ও দেহসর্বস্ব যে আধুনিক পাঠক ন্যায়সঙ্গতভাবেই রুচির প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারে।

জীবন চাহি যৌবন বড় রখা

তবে যৌবন জ্ঞান সুপুরুষ সর্বস্ব।

অন্যদিকে, চণ্ডীদাস সাধক কবি। তিনি রাধাকৃষ্ণের ছদ্মাবরণে বৈষ্ণব তত্ত্বের আধ্যাত্মিক প্রেমলীলাকেই বর্ণনা করেছেন। পদাবলীতে তিনি প্রেমচিত্র আঁকতে গিয়ে সেখানে কাম-গন্ধহীন পবিত্র প্রেমচিত্র অঙ্কন করেছেন-

এমন পিরীতি কভু দেখি নাই শুনি।

পরানে পরান বান্ধা-আপনা-আপনি ।।

৩. বিদ্যাপতির পদগুলোতে বিবর্তনের একটা ছাপ সহজেই ধরা পড়ে। এই বিবর্তন স্কুল দেহ সম্ভোগের জগৎ থেকে ভাবের জগতে উপনীত হওয়ার বিবর্তন, রূপ আস্বাদনের পৃথিবী হতে অপরূপ ভাবের সীমানায় রূপান্তরিত হওয়া। পক্ষান্তরে, চণ্ডীদাসের পদগুলোতে বিবর্তনের ধারা অনুপস্থিত। বৈষ্ণবতত্ত্ব প্রকাশই ছিল ভক্ত কবি চণ্ডীদাসের মূল লক্ষ্য।

৪. চণ্ডীদাসের রাধা প্রথম থেকেই কুল চেতনায় কাতর। ধীরে ধীরে কৃষ্ণপ্রেম তাঁর অন্তরে দানা বেঁধে উঠলেও তাঁর কুল ভয় কাটেনি এবং কৃষ্ণের সাথে মিলনের পরও বার বার কুলের বন্ধন অমান্য করার অপরাধে তাকে সবসময় পীড়া দিয়েছে। যেমন-

একে কুলবতী ধনী তাহে সে অবলা,

ঠেকিল বিষম প্রেমে শত সবে জ্বালা।

চণ্ডীদাসের সমকালীন সমাজব্যবস্থার প্রভাবেই তাঁর বাধা কুলধর্মের চিন্তায় সম্ভবত বেশি চিন্তিত। বিদ্যাপতি সংস্কৃত কাব্যশাস্ত্রের অনুসরণে রাধার নয়ন মুগ্ধকর যে বনোজ্জ্বল লীলা বিভ্রমের চিত্র এঁকেছেন সে রাধা শ্যামল বাংলার নরম মাটির কোমল মেয়েটি নয়। তাই চণ্ডীদাসের রাধার ন্যায় বিদ্যাপতির রাধা কুল চেতনায় কাতর নয়। চণ্ডীদাসের বাংলার সমাজ এবং বিদ্যাপতির মৈথিলি সমাজ ভিন্ন ভিন্ন বলেই সম্ভবত এ প্রভেদ।

. বিদ্যাপতির রাধা স্বাধীন, ব্যক্তিত্বময়ী, বঙ্গেরমনা তাঁর বিদ্যুৎ তীক্ষ্ণ, কৌতুক রণোজ্জ্বল। মানের অবসানে কৃষ্ণের প্রতি রাধার উক্তিটির মাধ্যমেই তা প্রমাণিত।

যো বিনা স্বপনে না হেয়ারি আন।

হামার বচনে করবি জল পান৷

চণ্ডীদাসের রাধার এ জাতীয় উক্তির কথা কল্পনাও করা যায় না।

৬. বিদ্যাপতির বিরহের পদগুলোতে বেদনার চেয়ে বিলাপ বেশি। তিনি রাধার বেদনাকে অনুভব করেছেন অতি গভীর ভাবেই কিন্তু আত্মবিস্মৃত হননি। সে বেদনা রাধারই বিদ্যাপতির নয়। অপরদিকে, চণ্ডীদাস দুঃখের কবি। তার পদগুলোতে উল্লাস নেই, উচ্ছলতা নেই। পূর্বরাগ থেকে চণ্ডীদাসের বিরহ শুরু, আক্ষেপানুরাগে তার বৃদ্ধি এবং ভাব সম্মেলনের আনন্দ মুহূর্তে বিচ্ছেদের অন্তিমতম বেদনাকে প্রকাশ করেছেন কবি।

বহুদিন পরে বধূয়া এলে।

দেখা না হইল পরান গেলে।

এ পদে রাধার বেদনা ও কবির বেদনা একাকার হয়ে গেছে। চণ্ডীদাস একেবারেই আত্মবিস্মৃত কবি।

৭. বিদ্যাপতি রাধাকে মানবীয় প্রণয়লীলার নায়িকারূপে গড়ে তুলেছেন। বিদগ্ধ নাগরিক রাজসভার কবি রাধার হৃদয় ধীরে ধীরে উন্মোচন করেছেন। কৈশোর, বয়ঃসন্ধি ও নবযৌবনে পূর্বরাগ, অভিসার, মান অভিমান প্রভৃতি লীলা বিভ্রমে পাঠককে প্রতি মুহূর্তে চমকিত করে তুলেছেন। বিদ্যাপতির রাধা প্রথমে একেবারেই লৌকিক। পরবর্তীকালে প্রেমের সাধনায়। অতীন্দ্রিয়তাকে আহ্বান করলেও শেষ পর্যন্ত সে যোগিনী হয়ে উঠতে পারেনি। অন্যদিকে, চণ্ডীদাস প্রথম থেকেই রাধাকে কৃষ্ণপ্রেমে পাগলপারা এক পূর্ণ বিকশিত নারীরূপে চিত্রিত করেছেন।

৮. বিদ্যাপতি ও চণ্ডীদাসের ভাষারীতি সম্পূর্ণ পৃথক। বিদ্যাপতির ভাষা মৈথিলি প্রভাবিত ব্রজবুলি ভাষা। ব্রজবুলি ভাষার সর্বপ্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এর মাধুর্য। তবে এর মাধুর্য মধুর হলেও এটি একটি কৃত্রিম ভাষা। প্রাণের সাথে এর যোগ নেই। অন্যদিকে, চণ্ডীদাসের ভাষা বাংলার খাঁটি নিজস্ব সম্পদ। এ ভাষার মাধ্যমে * স্রোতার সাথে কবির সোজাসুজি হৃদয়ের যোগাযোগ ঘটে।

৯. প্রকাশের বুদ্ধিদীপ্ত তির্যক ভঙ্গি বিদ্যাপতির পদে যে প্রগলভ; নাগরীরূপে গ্রহণ করে চণ্ডীদাসের সহজ সরল ভাষার আন্তরিকতা তা থেকে বহুদূরে উপলব্ধির অন্য কোটিতে নিয়ে যায়।

১০. বিদ্যাপতির কাব্য তাঁর নামাঙ্কিত না থাকলেও তাঁর রচনা বলে চেনা যায়। বিদ্যাপতির ব্যক্তিত্ব তাঁর কাব্যে এমনই প্রদীপ্ত যে চিনতে দ্বিধা হয় না।

অথচ চণ্ডীদাসের ক্ষেত্রে তেমন নয়। চণ্ডীদাসের একটি শ্রেষ্ঠপদ ‘তদভারাক্রান্ত’ যেকোনো শ্রেষ্ঠ কবির রচনা বলে মনে হতে পারে। তাঁর কাব্যের নির্বিশেষত্বই তার বিশেষত্ব।

উপরিউক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, বিদ্যাপতি সুখ- সম্ভোগে নাগরিক কবি। চণ্ডীদাস দুঃখ ও সাধক কবি। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, “বিদ্যাপতি ভোগ করবার কবি আর চণ্ডীদাস সহ্য করবার কবি। চণ্ডীদাস সুখের মধ্যে দুঃখ এবং দুঃখের মধ্যে সুখ দেখতে পেয়েছেন। তার সুখের মধ্যেও ভয় এবং দুঃখের প্রতি অনুরাগ।”